প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি আমেরিকার সংবিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন? আমেরিকার সংবিধানের মুখবন্ধে লেখা আছে,
“We the People of the United States, in Order to form a more perfect Union, establish Justice, insure domestic Tranquility, provide for the common defence, promote the general Welfare, and secure the Blessings of Liberty to ourselves and our Posterity, do ordain and establish this Constitution for the United States of America.”
‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ’ এটাই সংবিধানের প্রথম কথা। অর্থাৎ জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের মালিক। তাঁরাই সংবিধান ঘোষণা করেছেন। অথচ ২ জুন, ২০২০, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট (!) রোজগার্ডেনে দাঁড়িয়ে দেশব্যাপী লক্ষ লক্ষ বিক্ষোভরত মানুষ যারা ন্যায়বিচার চান, তাঁদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী নিয়োগের ঘোষণা দিলেন। এ ত হয় এশিয়া, না হয় আফ্রিকার অগণতান্ত্রিক (!!) দেশে । অথবা কোন মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী (!!) দেশে। এটা তো গণতান্ত্রিক দেশে অস্বাভাবিক? দেশব্যাপী এই বিক্ষোভের বিরুদ্ধে তিনি সকল স্টেটের গভর্ণর আর মেয়রদের পুলিশী ব্যবস্থা তীব্র করার নির্দেশ দিয়েছেন। যে কোন মূল্যে এই বিক্ষোভ দমন করতে হবে। তিনি বিক্ষোভকারীদের সংগে কোন আলোচনা বা মত বিনিময়ের মত গণতান্ত্রিক (!) উদ্যোগ নেননি। তিনি এই পদ্ধতিকে দূর্বলতা মনে করেন বা অস্বীকার করেন। তাঁর একটাই পথ ‘বল প্রয়োগ’। তাঁর পূর্বসূরি যারা নিজেরাও পৃথিবীর অন্য দেশে বলপ্রয়োগ করেছেন তাঁরাও তাঁকে বলপ্রয়োগের বাইরে যেতে বলছেন, কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। তিনি তাঁর ভাষায় এই সন্ত্রাসী আর অতিবামদের শায়েস্তা করবেন। রাস্তায় কিন্তু শুধু আর কৃষ্ণাংগরা নয়, সাদা কালো, বাদামি, হিস্পানী সবাই মিলে গেছেন। কেউ কেউ এটা আমেরিকার গণতন্ত্রের মহিমা হিসেবে প্রচার করছেন। গণতন্ত্র এখন রাজপথে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর পূর্বসূরিরা অনেক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন বিশ্বে বহু দেশের নিরীহ মানুষের উপর। নাপাম বোমা থেকে পারমাণবিক বোমা, সর্বাধুনিক মারনাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। সমস্ত পৃথিবী দেখেছে বিগত শতাব্দির গোটা সময়টা জুড়ে। এই বর্বরতার বিরুদ্ধে আমেরিকার জনগণও কখনও কখনও সোচ্চার হয়েছেন, বিক্ষোভ করেছেন, আত্মত্যাগ করেছেন। ( আমি নিজে দেখেছি আমেরিকার কেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ ছাত্রদের শহীদ মিনার। আমাদের শহীদ মিনারের মতই। ) কিন্তু আজ আমেরিকার জনগণ মুখোমুখি তাঁদেরই দেশের অত্যাধুনিক মারনাস্ত্রের। তাঁদের দেশের গণতান্ত্রিক (!) ভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ‘ফ্যাসিস্ট ভাষায় কথা বলছেন। তাঁরাই কিন্তু সময়ে সময়ে বাংলাদেশ থেকে হং কং, মিশর থেকে লিবিয়া, চিলি, ব্রাজিল, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া থেকে ভেনিজুয়েলা সর্বত্র রাজনৈতিক অথবা সামরিক হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছেন কখনও গণতন্ত্রের নামে কখনও মানবাধিকারের নামে। আজ মিলিয়িন ডলার প্রশ্ন কেন আজ আমেরিকার গণতান্ত্রিক(!) রাষ্ট্র নিরিহ জনগণের মুখোমুখি?
১ জুন, সোমবার, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, এটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার, জয়েন্ট চীফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলে এবং বিভিন্ন স্টেট গভর্ণরদের কনফারেন্সের অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়ে গেছে। তাতে তিনি বলেছেন, যে কোন ভাবে পুলিশ-মিলিটারি দিয়ে প্রশাসনকে এই বিক্ষোভ দমন করতে হবে। এর আগে বলেছিলেন প্রয়োজনে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হবে।
গত রবিবারে তাঁর দেহরক্ষীরা তাঁর নিরাপত্তার জন্যে তাঁকে হোয়াইট হাউসের বাংকারে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ খবর বিশ্বের কাছে মহাবিস্ময়ের। মহাশক্তিধর পারমাণবিক বোমার বোতামের ব্রিফকেস যার হাতে তিনি কিনা তাঁরই দেশের নিরস্ত্র জনগণের বিক্ষোভের মুখে বাংকারে আশ্রয় নিচ্ছেন। ( যখন আমেরিকা ভিয়েতনামে নাপাম বোমা ফেলেছে তখন ভিয়েতনামের নেতা হো চি মিন বাংকারে যান নি, কোন দেহ রক্ষী ছাড়াই নিজের দেশের জনগণের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দৃশ্য দু’টির তুলনা বড়ই বেমানান।) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিরাপত্তা দেবার জন্যে সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ২০০ জন সৈন্য ৯ টি M35 আড়াই টনী সৈন্যবহনকারী অত্যাধুনিক যানে চড়ে ‘হোয়াইট হাউসে’ ঢুকেছিল। অশ্বারোহী পুলিশ, সাঁজোয়া যান, শত শত কালো বুট পরিহিত সামরিক পুলিশ, কাঁদানে গ্যাস আর রাবার বুলেট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কয়েক হাজার নিরস্ত্র, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর।
রাষ্ট্রের এই আক্রমনের মুখে শ্বেতাংগ, কৃষ্ণাংগ, হিস্পানিক, বাদামী সকল রং এর ছাত্র, শ্রমিক সাধারণ মানুষ প্রায় ১২৫ টি শহরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। কার্ফিউ দিতে হয়েছে। বিক্ষোভরত জনতার মুখে মুখে শ্লোগান “ফ্লয়েড, ফ্লয়েড”। এসোসিয়েটেড প্রেসের রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রায় ৪,৪০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক শিকাগো শহরেই গ্রেফতার হয়েছেন প্রায় ২০০০ জন বিক্ষোভরত মানুষ। আটলান্টাতে ২০০ জন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম আমেরিকাতে ন্যাশনাল গার্ড তলব করা হয়েছে। ২১ টি স্টেটের প্রায় তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ন্যাশনাল গার্ডের ১৭, ০০০ জনকেই মোতায়েন করা হয়েছে- বিক্ষোভ দমনের কাজে। কেন্টাকি, কালিফোর্নিয়ায় রায়ট পুলিশকে সহায়তা করার জন্য ন্যাশনাল গার্ড নিয়োজিত। পুলিশের সরাসরি গুলিতে প্রথম নিহত হয়েছেন কেনটাকির লুইসভাইলে David McAtee নামে একজন সাধারণ মানুষ।
মিনিয়াপলিতে পুলিশের চরম নির্যাতনের মুখেও প্রতিবাদ অব্যাহত। সান্ধ্য আইন বলবত রয়েছে এখনও। মিনেসোটার ডেমোক্রাট গভর্ণর Tim Walz নিজেই বলেছেন, এ পর্যন্ত ৪৭৬ জন গ্রেফতার হয়েছে। সেখানেও ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভও চলছে।
করোনায় বিধ্বস্ত নিউইয়র্ক শহরে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১৬,৫০০ মানুষ। তা সত্বেও পুলিশী বর্বরতার বিরুদ্ধে সেখানে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। নিউইয়র্কে প্রায় ১০০০ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্ণিয়ায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হওয়া সত্বেও লুটের অভিযোগে প্রায় ৫০ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। লস এঞ্জেলেসে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে।
সারা আমেরিকাব্যাপী সর্বস্তরের মানুষ সকল রঙের মানুষ এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছে। তবুও ট্রাম্প সরকারের পক্ষ থেকে এটাকে বর্ণবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে, যা সংবিধানের সংগে সংগতিপূর্ণ নয়। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই বিক্ষোভকে ‘Antifa’ ও নৈরাজ্যবাদী বা Anarchist দের প্ররোচনা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যাতে রাষ্ট্র আরও জোরদারভাবে এই বিক্ষোভ দমনে ‘বল প্রয়োগ’ করতে পারে। যাতে সামনের নির্বাচনে এটাকে বর্ণবাদ বা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে ব্যবহার করা যায়। ক্ষমতায় আসার পূর্ব থেকেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এটাই ট্রাম্পকার্ড।
সরকার বা রাষ্ট্রের এই বলপ্রয়োগ আমেরিকার সংবিধানের মূলধারার সংগে সংগতিপূর্ণ কিনা সে প্রশ্ন আমেরিকার অভ্যন্তরেই উঠে এসেছে। এই মনোভাবকে অনেকে ‘failed state’ মনোভাব হিসেবে আখ্যায়িত করছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এতদিন গোটা বিশ্বে যে আগুন নিয়ে খেলা করেছেন, আজ সেই আগুনে আমেরিকার সংবিধান পুড়ে যায় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
আমেরিকার জনগণ যারা এই সংবিধানের মালিক, তাঁরা আমেরিকার সমাজের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কি ফয়সালা করে, তার দিকে গোটা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে সন্দেহ নাই।
জনগণ না ফ্যাসিবাদ বা বর্ণবাদ কে জয়ী হবে?
পুঁজিবাদের চরম সংকটে বিপ্লবও হয়, ফ্যাসিবাদেরও জন্ম হয় – এটা ইতিহাসেরই শিক্ষা।
আমেরিকায় আজ যা হচ্ছে এটাও কি পুঁজিবাদের সংকটেরই বহিঃপ্রকাশ নয়? যারা সমাজটাকে পাল্টাতে চায়, ইতিহাসের গতি তাঁদেরকে সঠিক সময়ে বুঝতেই হয়। না হলে সুযোগ অন্ধকারে হারিয়ে যায়।