১। ফিরে দেখা কমরেড অমল সেনের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও জীবনাদর্শকেঃ
অমল সেন ভারতীয় উপমহাদেশের তথা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। যৌবনের প্রারম্ভে সকল আরাম আয়েসকে তুচ্ছ করে তিনি সংগ্রাম আর শিক্ষার আলোকবর্তিকা নিয়ে যে নিভৃত পল্লীর কৃষকের কুঁড়ে ঘর থেকে মানবমুক্তির বিপ্লবী আকাঙ্খা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেখানে আজও তাঁর স্মৃতিসৌধের পাশে দাঁড়িয়ে তারই আদর্শে উদ্বুদ্ধ বর্তমান প্রজন্ম, বিপ্লবী সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাবার শপথ নেয়। ইতিহাসের এই দায়কে বাস্তবায়িত করার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রয়োজন এই মহান বিপ্লবীর জীবন ও সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নেবার।
১৯১৪ সালের ১৯ জুলাই কমরেড অমল সেনের জন্ম যশোর জেলার আফরা গ্রামে এক জমিদার পরিবারে। কিন্তু প্রায় শতাব্দিকাল এই ভূখন্ডে কৃষক আন্দোলন আর কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সার্বিক ভূমিকা রাখার পরও তিনি নড়াইলের অমল সেন ছিলেন এবং থাকতে চেয়েছিলেন, তাই মৃত্যুর পরেও তিনি ফিরে গিয়েছেন তারই অতি প্রিয় মানুষদের কাছে, যারা তাঁকে সম্ভবতঃ স্মরণ করবে অনাগতকাল ধরে লোকজ সংস্কৃতির আবহে ’অমল সেন’ মেলার মধ্য দিয়ে। হয়ত, কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা তাঁদের সকল অনৈক্য আর সংকট নিরসনের আকাঙ্খা নিয়ে হাজির হয় প্রয়োজনে এই মহান বিপ্লবী মানুষটির স্মৃতিসৌধের বেদীভূমিতে।
তাঁর মৃত্যুর পর দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও তাতে পার্টির ভূমিকার নতুন প্রেক্ষাপটে আজ সংক্ষেপে ফিরে দেখা যাক এই ক্ষণজন্মা বিপ্লবী মানুষটির জীবন, কর্ম ও আদর্শের মৌল কিছু বিষয়ে, যা আমাদের কাছে, এই প্রজন্মের কাছে ও সকল কালের জন্য প্রাসঙ্গিক এবং শিক্ষণীয়। তিনি জন্মেছিলেন মানব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ট ঘটনা রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে। লেনিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে শ্রমিক শ্রেণী রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই বিপ্লবের অভিঘাত, বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে তৈরী করে এক যুগান্তকারী চেতনা। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম নতুন গতিবেগ আর দিকনির্দেশনা পায়। তৎকালীন ভারতবর্ষে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের আবহে বেড়ে ওঠা কমরেড অমল সেনও জড়িয়ে পড়েন বৃটিশবিরোধী সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে এদেশেও। তিনি দ্রুতই আকৃষ্ট হন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শের প্রতি। কঠিন সেই প্রেক্ষাপটে তরুণ এক যুবকের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া অত সহজ ছিল না। এ ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন বিশিষ্ট এবং ব্যতিক্রম। তিনি সামন্ত পরিবারের আবহ অগ্রাহ্য করে, জায়গা করে নেন নড়াইলের বাকড়ির গরীব কৃষকের কুঁড়েঘরে। গড়ে তোলেন যশোর নড়াইল অঞ্চলের ঐতিহাসিক তেভাগা কৃষক আন্দোলন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই কৃষক সংগ্রাম এক নতুন মাত্রা যোগ করে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে শ্রমজীবি তথা কৃষকসমাজের ভূমিকার ঐতিহাসিক অবস্থান নির্ধারিত হয়ে যায়। বাংলার এই ভূখন্ডে বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই কৃষক আন্দোলনে কৃষকদের রয়েছে অনেক বীরোচিত ভূমিকা, কিন্তু তা সত্তে¡ও কমরেড অমল সেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যশোর নড়াইল এলাকার এই আন্দোলন সাফল্য, চেতনা আর সংগঠনের দিক দিয়ে এক অনন্য অবদান রেখেছিল, যার ধারাবাহিকতায় শুধু এ অঞ্চলে নয়, গোটা বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে গড়ে ওঠে বিপ্লবী সংগ্রাম আর সংগঠনের দৃঢ় ভিত্তি। পাশাপাশি এই আন্দোলনের দোলাচলে যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে পড়ে থাকা মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর চেতনার এক নব দিগন্ত। কমরেড অমল সেনের লেখা ’নড়াইলের তে-ভাগা আন্দোলনের সমীক্ষা’ বইটিতে তিনি তাঁর অভূতপূর্ব বিশ্লেষণী দক্ষতায় তা বিধৃত করেছেন। বইটি পাঠ্য তাই প্রতিটি বিপ্লবী কর্মীর, সঙ্গে সঙ্গে সকল রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের। এ ক্ষেত্রে তিনি শুধু আমাদের পার্টির পথিকৃত নন, এ দেশের সকল প্রগতিশীল, সমাজসচেতন মানুষের পথিকৃত।
নড়াইলের তেভাগা আন্দোলন স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসে। এ আন্দোলনের রয়েছে সমষ্ঠিগত সাফল্য, পাশাপাশি কি ত্যাগ তিতিক্ষা করতে হয়েছিল এ এলাকার জনগণের সেটাও ইতিহাসের অংশ। কত পরিবার ধবংস হয়েছে, কত জেল জুলুম আর নিপীড়ণ সহ্য করতে হয়েছে, তা কি সময়ের সাথে সাথে ভুলে যাবে ভবিষ্যত প্রজন্ম? কমরেড অমল সেনের বৈশিষ্ট ছিল, তিনি সংগ্রামে ছিলেন সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা নেতা, যখন নির্যাতন, নিপীড়ন নেমে এসেছে, তখনও তিনি সামনে দাঁড়িয়েই তা সহ্য করেছেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তি যা করতে পারেনি, তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের পর, পাকিস্তান আমলে, বিপ্লবী সংগ্রামীদের জীবনে নেমে আসে সেই নির্যাতন। পাকিস্তান আমলে ১৯ বছরই তাঁকে কাটাতে হয়েছে জেলে। শুধু তাই নয়, জেলের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী হায়েনাদের হাতে তাঁকে সীমাহীন ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, যা নাৎসী ’কনসেনট্রেসন’ ক্যাম্পের কথা মনে করিয়ে দেয়, এ ইতিহাস অনেকেরই জানা নেই। তিনি শত নিপীড়ন আর নির্যাতনে দেশত্যাগ করেননি, বিপ্লবীজীবন ত্যাগ করেননি।
ব্যক্তিজীবনে অকৃতদার এ মানুষটির রাজনৈতিক জীবনেও কম টানাপোড়েন আসেনি। তিনি তা মোকাবিলা করেছেন তাত্বিকভাবে, সাংগঠনিকভাবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও তার সেই অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক এবং আমাদের রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তি।
দেশবিভাগের প্রাক্কালে তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গৃহীত রনদিভে লাইনের বাম বিচ্যুতি পার্টিকে যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, তা তিনি তাঁর কৃষক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক চেতনা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন এবং তার বিরোধীতা করেছিলেন। ষাটের দশকে যখন বিশ্বব্যাপী চীন-সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতাদর্শগত বিতর্ক, দেশেদেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে দ্বন্দ এবং ভাঙনের মুখোমুখি করে, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিও সে বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পারেনি। তার ফলশ্রুতিতে, পার্টির ভাঙন আর তার ফলাফল এখন ইতিহাস। তিনি গোটা বিষয়টিকে তাত্বিকভাবে যেভাবে মোকাবিলা করেছেন তার দ’ুটি ঐতিহাসিক দলিলে তা তিনি লিখেছেন। একটি ’বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্যা প্রসঙ্গে’ অন্যটি ’কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শগত বিতর্ক প্রসঙ্গে’। মতাদর্শগত যে কোন বিতর্কের পরিসমাপ্তি হলো পার্টির ভাঙন, সাংগঠনিকভাবে তিনি সারাজীবন এর বিরোধীতা করেছেন। ষাটের দশকে সোভিয়েত পার্টির দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে তিনি যেমন অবস্থান নিয়েছেন, তেমনি ষাটের দশকের শেষভাগে তথাকথিত পিকিং পন্থী পার্টি যখন অতিবাম সংকীর্ণতার কথিত নকশাল লাইন গ্রহণ করে তিনি তাঁর তীব্র বিরোধিতা করেন। পার্টির বহুধা বিভক্তিতে তিনি যন্ত্রনাবিদ্ধ হয়েছেন কিন্তু হতাশ হননি। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে সামনে নিয়ে তিনি যেমন রাজনৈতিকভাবে অবস্থান নিয়েছেন, তেমনি তৎকালীন পূর্ববাংলার কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রামে অবতীর্ন হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কমিঊনিস্ট বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করার যে কাজ তিনি শুরু করেছিলেন, তা তিনি আমৃত্যু অব্যাহত রেখেছিলৈন। তিনি সত্তর, আশি এবং নব্বই এর দশকের সকল রাজনৈতিক সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা কি হওয়া উচিত, তা যেমন নির্দেশ করেছেন, তেমনি কমিউনিস্টদের ঐক্যের প্রতিভু হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছেন। তিনি গোটা আশির দশক ধরে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির তিনি ছিলেন সভাপতি। ’কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শগত বিতর্ক প্রসঙ্গে’ লেখায় কমিউনিস্ট ঐক্য প্রসঙ্গে তার একটি উদ্ধৃতি অতি প্রাসঙ্গিক বলে এটা এখানে তুলে ধরতে চাই। তিনি বলেছেন,”আমরা কমিউনিস্ট ঐক্যকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সম্প্রতি কমিউনিস্ট কর্মীদের মধ্যে ঐক্যের শ্লোগানটি খুবই জনপ্রিয়। নিজেদের কমিউনিস্ট বলে মনে করেন এমন কর্মীর সংখ্যা বাংলাদেশে কম না। তারা বিভিন্ন সংস্থায় বিভক্ত এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন। এটাও আমাদের সাহসের সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যে, এইসব কর্মীরা নানান বিভ্রান্তির শিকার হয়ে সঠিক বিপ্লবী শ্রেণীসংগ্রামের ধারায় সংগঠিত হয়ে ওঠা শ্রমিক এবং শ্রমজীবি মানুষের নেতৃত্বশীল অংশ হয়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি। একজন সত্যিকারের কমিউনিস্ট কর্মীর যে বিপ্লবী শ্রেণীসচেতন ও সংগঠিত শ্রমজীবি জনগণের কোন অংশের সঙ্গে নেতৃত্বশীল সংযোগ সম্পন্ন হওয়ার কথা, তা কর্মীরা হতে পারে নাই। সুতরাং এইসব কর্মীদের একটি সংগঠনে এসে জড়ো হওয়াতেই রাতারাতি শ্রমজীবি জনগণের বেশ একটি অংশের বিপ্লবী ঐক্য সৃষ্টি হয়ে যাবে তা মনে করি না। তবুও আমরা এইসব কমিউনিস্ট কর্মীদের ঐক্য চাই। কেন? সব কর্মীরা একটি সংগঠনে সামিল হলে সভ্য সংখ্যা ও কর্মীর সংখ্যার দিক দিয়ে মোটামুটি একটি বড় পার্টি হয়ে দাঁড়াবে, জনগণের কাছে একটা পাল্টা রাজনৈতিক শক্তির ভাবমূর্তি তুলে ধরার সুযোগ হবে এ জন্যই কি? নিশ্চয়ই না। এটা সুবিধাবাদী বিভ্রান্তি। আমরা চাই কমিউনিস্ট ঐক্য কমিউনিস্ট ধারা অনুসরণ করার জন্য ঐক্য। বিভিন্ন কারণে কমিউনিস্ট ঐক্যের বাস্তব সম্ভাবনা আজ খুবই উজ্জল । আবার এই মুহূর্তে কমিউনিস্ট ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাও খুব। এই ঐক্যকে বাস্তবায়িত করার আগ্রহ তাই স্বাভাবিক। কিন্তু কমিউনিস্ট ঐক্যের নামে আজ দায়সারা গোছের অথবা সরলিকরণের ( simplification ) পথে কোন সুবিধাবাদী ঐক্যের স্রোতে গা ভাসাই তবে সত্যিকারের কমিউনিস্ট ঐক্য তো হবেই না, উল্টো বিরোধ ও তিক্ততা বাড়বে। ঐক্যের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তাকে কাজে লাগানো যাবে না, অপরাধ হবে অমার্জনীয়।” কমরেড অমল সেনের এই সতর্কবানী কি আমাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে?
কমিউনিস্ট পার্টি শ্রেণী সংগ্রামের পার্টি। শ্রমজীবি মানুষের নেতা হয়ে ওঠার অন্য কোনো বিকল্প কমিউনিস্টদের নেই। কোন দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের আঁকেবাঁকে পার্টিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে হয়, প্রয়োজনও বটে, কিন্তু সে সকল রাজনৈতিক সংগ্রামে শ্রমজীবি মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে, শ্রমজীবি মানুষের শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য দিয়ে, তার নিজস্ব বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতেই হয়। কমরেড অমল সেন তার দীর্ঘ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের নির্যাস হিসেবে জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার তাত্বিক বিশ্লেষণ দিয়েছেন তার ’জনগণের বিকল্প শক্তি’ লেখায়। সেটা শুধু আমাদের পার্টির পথ নিদের্শক নয় ধ্রুপদী মার্কসবাদেও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও পার্টিকে এগিয়ে নিতে গেলে কমরেড অমল সেনের এই অমূল্য শিক্ষাকে আমাদের আঁকড়ে ধরতে হবে।
এটা আজ সর্বজনস্বীকৃত সত্য যে, পার্টির সামনে বড় একটা চ্যালেঞ্জ হলো পার্টির কর্মী ও নেতাদের ভাবাদর্শ ও মতাদর্শগত দূর্বলতা। দীর্ঘকাল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সৃজনশীল শিক্ষা ও বাস্তব শ্রেণী সংগ্রামে অংশগ্রহণের অপ্রতুলতা পার্টি কর্মী ও নেতাদের মধ্যেও মতাদর্শগত শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। যার ফলশ্রুতিতে পার্টির অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট আচরণ রীতির মারাত্মক ঘাটতি প্রতিনিয়ত অনুভূত হচ্ছে। এ নিয়ে অভিযোগ আর সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু এর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার রাস্তা কি সে দিকটায় পার্টি এখনও যথাযথ মনোনিবেশ করতে পারছে না। আর সেটা খুব সহজও নয়। এ ক্ষেত্রেও কমরেড অমল সেনের শিক্ষা প্রনিধান যোগ্য। এ ক্ষেত্রে, তাঁর লেখা ’কমিউনিস্ট জীবন ও আচরণ রীতি প্রসঙ্গে’ আমাদের সাহায্য করবে।
২। পার্টি গড়ে না তুললে কোন কর্মসূচীই বাস্তবায়িত হবে নাঃ
পার্টি ৮ম কংগ্রেস থেকেই শ্লোগান দিয়েছে ’পার্টিই হবে ভারকেন্দ্র’। পার্টি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ঐক্য, বামঐক্য ও কমিউনিস্ট ঐক্য করার রাজনৈতিক কর্মসূচীও গ্রহণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বলা হয়েছে, পার্টি গড়ে না উঠলে কোন লক্ষ্যই অর্জিত হবে না। এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে পার্টি গড়ে তুলতে হবে, প্রয়োজনীয় পদ্ধতি বা পদক্ষেপ কি হওয়া প্রয়োজন? এ ক্ষেত্রে আজ মনে হচ্ছে, আমাদের প্রয়াত নেতা কমরেড অমল সেনের শিক্ষা ও নির্দেশিত পথ আমাদের জন্য সবচাইতে বেশী প্রাসঙ্গিক। কমিউনিস্ট পার্টি শ্রেণী সংগ্রামের পার্টি-এ কথা অনস্বীকার্য। আবার গণতান্ত্রিক আন্দোলনও পার্টিকে করতেই হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, এ দু’টি আন্দোলনের সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে তৈরী হয় বিভ্রান্তি। কমরেড অমল সেন তাঁর ’জনগণের বিকল্প শক্তি’ লেখায় এ বিষয়ের প্রতিটি দিকে আলোকপাত করেছেন। জনগণের বিকল্প শক্তি কি এবং পার্টি গড়ে তোলার সঙ্গে তার সম্পর্ক কি তাও তিনি বলেছেন। শ্রেণীসংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দ্বান্দিক সম্পর্ক দেখাতে গিয়ে বলেছেন, ’এই ধরণের একটি ধারণা চালু আছে যে, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং শ্রেণীসংগ্রাম এ দুটো একেবারেই পৃথক দুটি কাজ। শোষকশ্রেণী অবশ্য জাতি, জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, গণতন্ত্রের সংগ্রাম এই সব কিছুকেই শ্রেণীনিরপেক্ষ, শ্রেণী উর্ধে, শ্রেণীসংগ্রাম বর্জিতভাবে হাজির করে থাকে। তাদের শ্রেণী শোষণকে নির্বিঘ্ন রাখার তাগিদেই তারা করে থাকে। তবে কি গণতান্ত্রিক আন্দোলন আর শ্রেণীসংগ্রাম একই জিনিস? না তাও আবার নয়। আসলে দুটির মধ্যে সঠিক সম্পর্কটিকে বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আজ শ্রমিকশ্রেণীসহ শোষিত অন্যান্য শ্রেণী গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে। শুধু তাই মাত্র নয়, এ যুগে গণতন্ত্রের এই সংগ্রামের নেতৃত্বের ভূমিকা বুর্জোয়া শ্রেণী আর পালন করতে পারে না, শ্রমিক শ্রেণীকেই এই ভূমিকা নিতে হয়। কিন্তু কেন? গণতান্ত্রিক অধিকার পেলেই কি শোষিতশ্রেণীর উপর শোষণের অবসান হয়? হয় না। শোষণের বিরুদ্ধে শ্রেণীসংগ্রামে সংগঠিত হবার ক্ষেত্রে কিছু অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হয়।’ তিনি বলেছেন,’সাধারণ থেকে সুনির্দিষ্ট এবং নির্দিষ্ট থেকে সাধারণ (জেনারেল টু কনক্রিট এন্ড কনক্রিট টু জেনারেল) এই যে ধারা, এই যে সম্পর্ক এটাকে উপলব্ধিতে আনতে হবে। বিপ্লবী কর্মীরা যেমন ক্রমাগত বিভিন্ন শ্রেণীসংগ্রামের সুনির্দিষ্ট কাজের মধ্যে থাকেন, আবার ঐসব বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট শ্রেণীসংগ্রামগুলির গণতান্ত্রিক অধিকারকে ছত্রছায়া দেবার জন্য সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলবেন। এই সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যাপকতম ঐক্যে প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্র রয়েছে।’ আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা এ বিষয়টিকে বুঝতে পারি। কিন্তু সুনির্দিষ্ট শ্রেণীসংগ্রামকে বাদ দিলে এই গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে অসম্পূর্ণ এটাই কমরেড অমলসেনের কাছ থেকে আমাদের বড় শিক্ষা। তাই পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যতটুকু গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জিত হয়েছে তাকে কাজে লাগিয়ে সকল স্তরের শ্রমজীবি মানুষের নির্দিষ্ট শ্রেণী সংগ্রামের কাজটি এখন দৃঢ়তার সঙ্গে ধরলেই পার্টি গড়ে উঠার শর্ত পূরণ হবে, জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে উঠবে।
৩। উপসংহারঃ ইতিহাসের এ দায় এ প্রজন্মের কাঁধে
ইতিহাসের জটিল পথপরিক্রমায় আমরা আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে সামনে এগুনোই আমাদের একমাত্র রাস্তা। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সংকট, বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের লগ্নীপুঁজির আগ্রাসন, বিশ্বায়ন, দেশের অভ্যন্তরে চরম সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান, শ্রমজীবি ও গণতান্ত্রিক শক্তির বিভান্তি, কমিউনিস্ট ও বাম শক্তির বিভাজন ও হতাশা – এ সব সংকটকে মোকাবিলা করে পার্টিকে এগিয়ে যেতে হবে। কমরেড অমল সেন তার জীবদ্দশায় এই প্রতিটি সংগ্রামে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, পার্টিকে তাত্বিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তার মৃত্যুর পর পার্টি নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সামনে চলছে। তার রেখে যাওয়া তাত্বিক লেখা পার্টি ও জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা, বাম এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অমূল্য শিক্ষা। তার দেখানো পথকে সামনে রেখে ইতিহাসের এই দায়কে কাঁধে নিতে হবে এই প্রজন্মকেই।