কার্ল মার্কস ও তাঁর তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা

Sharing Helps!

১। ভূমিকাঃ

 কার্ল মার্কস তাঁর বিপ্লবী তত্ত্ব এবং মানব ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক চিন্তাবিদ  হিসেবে বিপুল অবদানের জন্য যুগে যুগে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ট চিন্তাবিদ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন তাঁদের দ্বারাই যারা তাঁর তত্ত্বকে  তাঁদের অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে জানেন। সেই বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রচার মাধ্যমও তাঁকে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ট সমাজতাত্ত্বিক দার্শনিক হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। তাঁর ও এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ লেখার পর দেড়শ বছরের বেশী সময় অতিক্রান্ত হলেও আজও তা সমগ্র বিশ্বের শ্রমজিীবী মানুষের কাছে সমান প্রাসঙ্গিক ও প্রেরণার উৎস। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা, যেখানেই নিপীড়িত মানুষের লড়াই আছে সেখানেই মার্ক্স এবং তার বিপ্লবী তত্ত্ব উপস্থিত। সম্ভবতঃ এই দশকেই নতুন পৃথিবী আবার দেখবে নতুন কোনো ঘটনা, যা প্রমান করবে মার্কসের তত্ত্বের সারবত্তা। পৃথিবীব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের বাঁচার লড়াই, মুক্তির লড়াই চলতে থাকে, সেজন্যেই মার্কসের তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তার আলোচনাও থাকে প্রাসঙ্গিক।

২। কার্ল মার্কসের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও কাজের বিবরণ ঃ

১৮১৮ সালের ৫ মে, তৎকালীন প্রুশিয়ার ট্রিয়ের শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে কার্ল মার্কস জন্ম নেন । তাঁর পিতা একজন আইনজীবি ছিলেন। পারিবারিক আবহে তাঁরা কোনক্রমেই বিপ্লবী ছিলেন না। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন । জিমনেশিয়াম পাশ করে তিনি প্রথমে বন্ এবং পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন এবং দর্শন নিয়ে পড়াশুনা করেন। ১৮৪১ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেন। তাঁর পি এইচ ডি অভিসন্দর্ভ ছিল গ্রীক দার্শনিক এপিকিউরাসের উপর। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালিন সময়েই তিনি বামপন্থী হেগেলিয়ানদের সংস্পর্শে আসেন এবং বিপ্লবী ও নিরীশ্বরবাদী চিন্তায় আকৃষ্ট হন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষে তিনি শিক্ষকতার পেশায় আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন জার্মান সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির কারণে ফয়েরবাখকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পদে যোগদান করতে না দেওয়ায় এবং ব্রুনো বাউ-এর শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না পাওয়ায় তিনি শিক্ষকতার চিন্তা পরিত্যাগ করেন। সেই সময়ে মার্কসসহ তরুণ বামপন্থী হেগেলিয়ানরা ফয়েরবাখের দার্শনিক চিন্তার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এঙ্গেল্স্ও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।

১৮৪২ এর ১ জানুয়ারী, ‘রেইনিস জাইটুং’ প্রকাশিত হয় জার্মানীর কিছু প্রগতিশীল বুর্জোয়াদের উদ্যোগে। মার্কস ও ব্রুনো বাউয়ের হন তার প্রধান লেখক। পরে মার্কস তার প্রধান সম্পাদক হন। মার্কসের সম্পাদনায় পত্রিকাটি বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ভাবধারা প্রচার করতে থাকে। ফলে অচিরেই তার উপর তৎকালীন জার্মান সরকারের সেন্সরশীপের খড়গ নেমে আসে এবং ১৮৪৩ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। তার আগেই অবশ্য মার্কসকে প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়। কিন্তু তবুও পত্রিকাটি রক্ষা পায়নি। পত্রিকার সম্পাদনার এই দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে মার্কস নতুন জগতে প্রবেশ করেন। তিনি এটাও উপলব্ধি করেন রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁর আরও গভীর জ্ঞান প্রয়োজন। তিনি সেদিকে মনোযোগ নিবিষ্ট করেন।

১৮৪৩ সালে তিনি তাঁর শৈশবের বান্ধবী জেনিকে বিয়ে করেন। জেনির বড় ভাই প্রুসিয়ান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন এবং রাজনৈতিকভাবে সে সরকার চরম প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিনিধিত্ব করতো। কিন্তু তা মার্কস ও জেনির বৈপ্লবিক জীবনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। মার্কস আর জেনির প্রেম, বিয়ে আর দাম্পত্যজীবন উপন্যাসের জীবনকথার মতো কিংবদন্তিতুল্য। তাঁরা আমৃত্য ছিলেন পরস্পরের সকল কাজের সহযোদ্ধা। সঙ্গে সঙ্গে এটা বলাও অত্যুক্তি হবে না যে, জেনি মার্কসের জীবনে এমনভাবে না থাকলে মার্কসের অনেক কিছুই হয়তো করা সম্ভব হতো না।

১৮৪৩ সালের শরৎকালে মার্কস প্যারিসে যান, আর্নল্ড রুগের সঙ্গে মিলে একটি পত্রিকা প্রকাশের জন্য। পত্রিকাটির একটি মাত্র সংখ্যা বের হয়েছিল। রুগের সঙ্গেও তাঁর মতানৈক্য হয়। কারণ ইতোমধ্যে মার্কস তার বৈপ্লবিক আদর্শে স্থির নির্দিস্ট অবস্থান নিয়ে ফেলেছেন এবং জনগণের ও সর্বহারার মধ্যে তা প্রচারের ব্যাপারে আর কোনো আপোস করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

১৮৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এঙ্গেলস্ কয়েকদিনের জন্য প্যারিসে আসেন। তাঁরা দুজনে মিলে সেই সময়ে প্যারিসে যে সকল বিপ্লবী গ্রুপ ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শুরু হয় দু’টি বিপ্লবী জীবনের অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা এবং ঐতিহাসিক মানবিক বন্ধতত্ত্ব।

সেইসময়কালে প্যারিসে প্রুঁধোর মতাদর্শগত প্রভাব ছিল প্রধান। মার্কস প্রুঁধোর বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালানোর জন্যই ’দর্শনের দারিদ্র’ বইটি লেখেন, যা বলতে গেলে তাঁর নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিত্তিও প্রস্তুত করে। এ ছাড়াও এই সময়কালে সকল পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গেই তিনি তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করেন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শিক ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৮৪৫ সালে প্রুশিয়ান সরকারের প্ররোচনা ও অনুরোধে ফ্রান্স সরকার মার্কসকে বিপদজনক বিপ্লবী চিহ্নিত করে প্যারিস থেকে নির্বাসন দেয়। তিনি ব্রাসেলসে চলে যান। এখানেই তিনি ও এঙ্গেলস্ সম্মিলিতভাবে কমিউনিস্ট লীগ গঠনে অংশ নেন। ১৮৪৭ সালে নভেম্বরে লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয় এই কমিউনিস্ট লীগের দ্বিতীয় কংগ্রেস।। মার্কস এবং এঙ্গেলস্ দুজনে তাতে যোগ দেন। কংগ্রেসের অনুরোধে দুজনে প্রস্তুত করেন ’কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ যা এখন ইতিহাস। এই ইশতেহার প্রকাশিত হয় ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সূচনা হয় নতুন এক যুগের। যার মতাদর্শগত ও বুদ্ধিভিত্তিক প্রভাব বিশ্বসভ্যতায় এক অবিনশ্বর ও স্থায়ী আসন নিয়েছে অনাগত কালের জন্য। বিশ্বের শ্রমজীবি মানুষ একে গ্রহণ করেছে তাদের মুক্তির সনদ হিসেবে, আর বুর্জোয়ারা তাকে নিয়েছে তাদের মৃত্যুর সনদ হিসেবে। সর্বহারার এই মুক্তি সনদ সকল ছলচাতুরি, অত্যাচার, নিগ্রহ অগ্রাহ্য করে পৌঁছে গেছে কোটি কোটি মুক্তিপাগল মানুষের হাতে গত প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে। তার উপর ভিত্তি করেই হয়েছে সর্বহারার বিপ্লব। তৈরী হয়েছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা। এবং যতদিন মানুষের উপর শোষণ আছে, ততদিন এ ইশতেহার থাকবে মুক্তির দিক নির্দেশিকা হিসেবেই। কোন সমালোচনা বা অপপ্রচার তা রোধ করতে পারবে না।

১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রাসেল্সে বিপ্লব শুরু হতেই মার্কসকে বেলজিয়াম থেকে বহিস্কার করা হয়। তিনি আবার প্যারিসে চলে আসেন। সেখানে মার্চ বিপ্লব শুরু হলে তিনি জার্মানির কোলনে চলে যান। ১৮৪৮ সালের ১ জুন থেকে ১৮৪৯ সালের ১৯ মে পর্যন্ত তিনি প্রধান সম্পাদক হিসেবে ’নিউ রেইনিস জাইটুং’ প্রকাশ করেন। সেই সমসাময়িককালে ঘটমান সকল বিপ্লবী কর্মকান্ড তাঁর নতুন তত্ত্বকে সমর্থন করে। ১৮৪৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে জার্মান সরকার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে এবং ১৬ মে বহিস্কার করে। তিনি প্রথমে প্যারিসে আসেন। কিন্তু সেখানে জুলাই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি স্থায়ীভাবে লন্ডনে চলে আসেন এবং আমৃত্যু সেখানেই থাকেন।

৩। মার্কসীয় মতবাদঃ

মার্কসের (মার্কস এবং এঙ্গেলসের সম্মিলিত অবদান) দার্শনিক, অর্থনেতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষাই আজ মার্কসবাদ নামে পরিচিত। মার্কসের দার্শনিক মতবাদ হলো দ্বান্দিক বস্তুবাদ। উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব তাঁর মূল অর্থনৈতিক মতবাদ। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে সর্বহারার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র (শেষ বিশ্লেষণে  সাম্যবাদ এ উত্তরণ) প্রতিষ্ঠা তাঁর রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা। মার্কসের পর লেনিন সৃজনশীলভাবে মার্কসবাদে যে অবদান রেখেছেন, তা মিলিয়ে আজ মার্কসবাদকে এক কথায় বলা যেতে পারে ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’। গত দেড় শতাধিক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী বহু রাজনৈতিক, মতার্শগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অসংখ্য মানুষের অর্জন এবং সংযোজনের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদ সমৃদ্ধ হয়েছে। তাতে কার অবদান কতটুকু তা নিয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ না রেখে, মার্কসের মৌল শিক্ষা ও বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে তার প্রাসঙ্গিকতার আলোচনাই আজ এখানে রাখছি। প্রথমেই মার্কসের তত্বের মৌল দিকগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলা প্রয়োজন।

দ্বান্দিক ঐতিহাসিক বস্তুবাদঃ মার্কসবাদ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লেনিন মার্কসবাদের তিনটি উৎসের কথা বলেছেন। উনবিংশ শতাব্দির চিরায়ত জার্মান দর্শন, চিরায়ত বৃটিশ রাজনৈতিক-অর্থনীতি এবং ফরাসী সমাজতন্ত্র ও ফরাসী বিপ্লব-এই তিন উৎসের সারনির্যাস মার্কসবাদের মধ্যে সন্নিবেশিত রয়েছে। মার্কস (এঙ্গেলস সম্মিলিতভাবে) তাঁর অমিত প্রতিভা দিয়ে দর্শন, অর্থনীতি এবং সমাজনীতি তথা রাজনীতিতে তাঁর মৌলিক অবদান রাখেন। মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের তরুণ বয়সে হেগেলীয় দ্বন্দবাদের সমর্থক থাকলেও তাঁরা তাঁর ভাববাদকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ফয়েরবাখের বস্তুবাদী মতের সমর্থক হয়ে ওঠেন, যা আগেই বলা হয়েছে। এ সময়টা ছিল তাঁদের গড়ে ওঠার কাল। অচিরেই তাঁরা বুঝতে পারেন- হেগেলীয় দ্বান্দিকতাকে বস্তুবাদের উপর দাঁড়াতে হবে- এটাই যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তাঁরা বস্তুবাদকে তার যান্ত্রিকতার পরিমন্ডল থেকে বের করে গতিশীল এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেন, সঙ্গে সঙ্গে হেগেলের দ্বন্দবাদের সঠিক ব্যবহারের জায়গায় নিয়ে আসেন। এ প্রসঙ্গে মার্কস বলেছেন, “To Hegel… ,” wrote Marx, “the process of thinking, which, under the name of ‘the Idea’, he even transforms into an independent subject, is the demiurgos (the creator, the maker) of the real world…. With me, on the contrary, the ideal is nothing else than the material world reflected by the human mind, and translated into forms of thought.” (Capital, Vol. I, Afterward to the Second Edition.)

মার্কসের বস্তুবাদী দর্শনের এ দিকটার সঙ্গে সাযুয্য রেখে এঙ্গেলস লিখেছেন, “The real unity of the world consists in its materiality, and this is proved… by a long and wearisome development of philosophy and natural science….” “Motion is the mode of existence of matter. Never anywhere has there been matter without motion, or motion without matter, nor can there be…. But if the… question is raised: what thought and consciousness really are, and where they come from; it becomes apparent that they are products of the human brain and that main himself is a product of Nature, which has developed in and along with its environment; hence it is self-evident that the products of the human brain, being in the last analysis also products of Nature, do not contradict the rest of Nature’s interconnections but are in correspondence with them…..” মার্কস এবং এঙ্গেলস যান্ত্রিক বস্তুবাদের’ সীমাবদ্ধতার কথা বলতে গিয়ে তিনটি দিক উল্লেখ করেন। লেনিন-মার্কসের জীবনী

যান্ত্রিক বস্তুবাদের সীমাবদ্ধতার দিকগুলো হলো –

১.         এই বস্তুবাদ সম্পূর্ণ যান্ত্রিক কারণ এই বস্তুবাদে প্রকৃতিবিজ্ঞানের (পদার্থ রসায়ন এবং জীববিজ্ঞান) সর্বশেষ আবিষ্কারসমূহবিবেচিত হয়নি।

২.        পুরাতন বস্তুবাদ দ্বান্দিক নয়, ঐতিহাসিকও নয়।

৩.        মানুষের চেতনা বা অন্তর্বস্তুকে এই বস্তুবাদ বস্তুর এবং সমাজ বিকাশের নির্যাস হিসেবে বিবেচনা করেনি এবং তা সমাজ বিকাশের ধারাকে শুধু ব্যাখ্যাই করেছে। তাকে পরিবর্তনের দৃষ্টিতে দেখা হয়নি।

যান্ত্রিক বস্তুবাদের এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বস্তুবাদকে দ্বান্দিকতার মৌল ভিত্তির (বিপরীতের একত্ব, পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন, নেতির নেতিকরণ) উপর দাঁড় করিয়ে মার্কস-এঙ্গেলস এর বৈপ্লবিক স্বত্ত্বাকে বিকশিত করেন। বিজ্ঞানের তৎকালীন আবিস্কারসমূহের সারনির্যাসকে ধারণ করে তাঁরা দেখান, বস্তু‘র বিকাশএর ধারাতেই চেতনার উন্মেষ। চেতনা বস্তু‘ থেকে বিচ্ছিন্নও নয়, আলাদাও নয়। বস্তুর চেতনা বিকাশের এই সত্যটি বিজ্ঞান ও যুক্তির সারবত্তায়  ধারণ করাই মার্কসীয় দর্শনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। বস্তুর মধ্য দিয়েই চেতনার বিকাশ এবং বস্তু ভিন্ন চেতনার অস্তিত্ব অসম্ভব। এটা দ্বান্দিক বস্তুবাদের মৌলিক ভিত্তি। মার্কসীয় দর্শন শুধু বস্তু বা চেতনা বিকাশের দার্শনিক ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সমাজবিকাশের ধারায় বস্তুবাদ ও দ্বান্দিকতাকে মৌলিকভাবে ব্যবহার করে মানবসমাজের বিকাশের নতুন ধারণাও উপস্থাপন করেছে। যা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হিসেবে পরিচিত। মার্কস ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের গর্ভ থেকে সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদী সমাজের বিকাশের অবশ্যম্ভাবিতার ভবিষ্যত বাণী করেন। তিনি পুঁজিবাদকে ব্যাখ্যা করেন, পুঁজিবাদের অন্তস্থিত দ্বন্দ কিভাবে অবধারিতভাবে নতুন সমাজ ব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে তার পুংখানুপুংখ ব্যাখ্যা দেন। সমাজবিকাশের ধারায় কিভাবে প্রতিটি সমাজস্তরে উৎপাদন শক্তি আর উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ উচ্চতর সমাজ সম্পর্কের জন্ম দিয়েছে তার ব্যাখ্যাই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।

মাকর্সের রাজনৈতিক অর্থনীতিঃ

অর্থনীতিতে মার্কসের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ’উদ্বৃত্ত মূল্যের’ তত্ত্ব আবিস্কার করেন। তিনি তাঁর `Das Capital’ বইতে মূল্য, উদ্বৃত্ব মূল্যের তত্ত্ব, পুঁজির বিকাশ এবং তার ঐতিহাসিক পরিণতির পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি দ্বান্দিক বস্তুবাদের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করেছেন পণ্য, মূল্য এবং পুঁজির বিকাশের ধারাকে ব্যাখ্যা করার জন্য। শ্রমিকের শ্রমশক্তিই যে পুঁজির আকারে ঘণীভূত হয়, শ্রমিকের শ্রমশক্তি লুট করা ছাড়া পুঁজি হয়না- এই সত্যকে তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শিল্পায়নের ইতিহাস, তার মধ্যদিয়ে পণ্য উৎপাদনের সামাজিকীকরণ এবং তার পরিণতিতে সামাজিক মালিকানার অবধারিত প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যতবাণী মার্কসের বড় অবদান। মার্কসের সময়ে পুঁজিবাদ সা¤্রাজ্যবাদের স্তরে উপনীত হয়নি-তবুও তার প্রাথমিক উপসর্গ তিনি নির্দেশ করেছেন। লেনিন পরবর্তিকালে ’সা¤্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’ বইতে তার সবিশেষ ব্যাখ্যা করেছেন।

মার্কস অন্যান্য দার্শনিকদের মত শুধুমাত্র পুঁজিবাদের ব্যাখ্যা করেই তাঁর কাজ শেষ করেননি। তিনি উৎপাদিকা শক্তি আর উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ যে শ্রমিক-মালিকের শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয় এবং এই দ্বন্দের নিরসন সম্ভব কেবল শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে ’সর্বহারা একনায়কত্বে’র প্রতিষ্ঠা এবং সমাজতন্ত্রে উত্তরণের মধ্যদিয়ে-এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করেছেন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্যদিয়ে। এটাই বিপ্লবী মার্কসবাদের অন্যতম মূল ভিত্তি। সমাজ বিকাশের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং পুঁজির বিকাশের পরিণতি সমাজতন্ত্র এবং তা অর্জন করতে হলে শ্রমিকশ্রেণীকে তাঁর রাজনৈতিক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে হবে-এটা তাঁর রাজনৈতিক উপসংহার। শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রণী বাহিনী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির এই দায়িত্বের কথাও তিনি এবং তাঁর বিপ্লবী সহযোদ্ধা এঙ্গেলস কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারের মধ্যদিয়ে ঘোষণা করেছেন এই স্লোগান উত্থাপন করে যে, ’দুনিয়ার মজদুর এক হও’।

৪। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ এবং মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতাঃ

প্রায়শই এ কথাটি উচ্চারিত হয় যে, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক যে, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জের নির্দিষ্ট রূপ কি? উত্তর খুবই ব্যাপক এবং সঠিক অর্থে বলতে গেলে এর অনেক কিছুই মানুষের অজানা। আর এ নিয়ে দ্বিমত বা বহুমত থাকাই স্বাভাবিক। তবুও সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই চ্যালেঞ্জের কয়েকটি দিকের আশু রূপ নির্দিষ্ট করা সম্ভব। এই চ্যালেঞ্জ রয়েছে-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশে, রয়েছে অর্থনৈতিক-সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে, রয়েছে বিশ্বজাগতিক ক্ষেত্রে মানুষের নতুন কোথায়ও পদার্পনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে। ভৌতবিজ্ঞান আজ উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহন করেছে বলা যায়। তবুও সেক্ষেত্রেও রয়েছে বড় বড় চ্যালেঞ্জ। পদার্থবিজ্ঞানে মহাজাগতিক ও মৌল বলসমূহের একীভূতকরণ, রসায়ন, প্রাণ-রসায়ন, জিনপ্রযুক্তির বহু অজানা প্রশ্ন, কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তির বাস্তবায়ন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্যান্সার বা এইড্স এর মতো ঘাতক ব্যাধির মোকাবিলা সবই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আরও বড়। অর্থনীতির বৈশ্বীকরণ-সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে- প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের সংকটের  মধ্য দিয়ে রুশ বলশেভিক বিপ্লব বিশ্বব্যাপী এক নতুন অভিঘাত তৈরী করে। পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প হিসেবে সমাজতন্ত্র মানবসভ্যতার সামনে হাজির হয়। ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আর এক বিভীষিকার মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। শুধু রাশিয়া নয়, চীন, ভিয়েতনাম, পূর্ব ইউরোপ, কিউবা প্রভৃতি দেশে সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় অধিষ্ঠান হয়। দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদের  বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন অব্যাহত অগ্রযাত্রা পায়। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় একের পর এক বহু দেশ জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করে। সঙ্গে সঙ্গে বৃটিশ ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের  প্রাধান্য খর্ব হয়ে, সামনে এগিয়ে যেতে থাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শক্তি ও সামর্থ্য। সাবেক পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের  সংকটকে সামলে নিয়ে, নয়া সাম্রাজ্যবাদ  সামনে এসে দাঁড়ায়। একদিকে সমাজতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তির বিশ্ব, অন্যদিকে মার্কিন সাম্যজ্যবাদের আগ্রাসী অগ্রযাত্রা। পৃথিবী প্রবেশ করে এক ধরনের দ্বিমেরু বিভাজনে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাতেও চলতে থাকে এ প্রতিযোগিতা। ঠান্ডা স্নায়ুযুদ্ধ  থেকে শুরু করে বহু আঞ্চলিক সংঘাত ও যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে সারা বিশ্বে। কোরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, আফ্রিকার দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে প্যালেস্টাইনীদের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ইরানের গৃহযুদ্ধ ও ইসলামী বিপ্লব, আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ, গালফ ওয়ার ও ইরাক সংকট এ সবই বিশ্বের দ্বিমেরু বিভাজনের সময়কালের বিশ্ব আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে প্রভূত প্রভাব ফেলেছে। ইতোমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক মডেলের রাজনৈতিক পতন বিশ্বকে হঠাৎ করেই নতুন পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়। এ সময়কালে, বিশ্বব্যবস্থা দ্বিমেরু বিভাজন থেকে একধরণের একমেরু বিশ্বে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। মার্কিন সামরাজ্যবাদ তার কেন্দ্র। এরই মধ্যে চীন ও ভিয়েতনাম তাদের মার্কসীয় চিরায়ত তত্ত্বকে বিসর্জন না দিয়েও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মডেলের কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে নতুন অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে। সমাজতন্ত্রের বৈশ্বিক সাধারণ অভিঘাত কিছুটা স্তিমিত হলেও অনেক ক্ষেত্রে স্থানিক বিকাশ অব্যাহত থাকে। লাতিন আমেরিকায় মার্কিন সাম্যাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামগুলি সমাজতান্ত্রিক চেতনার নতুন দিক উন্মোচন ও সংযোজন করে। চিরায়ত মার্কসবাদী চিন্তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে আপাত পার্থক্য থাকলেও কিউবাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে সামাজিক বিকাশের নতুন উপাদান তৈরী হয়। ব্রাজিল, চিলি, বলিভিয়া, ভেনিজুয়েলা প্রভৃতি দেশে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ  বিরোধী সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলি। ওয়ান ইলেভেন এবং তৎপরবর্তী ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ, ইসলামি বিপ্লবের নামে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী মৌলবাদী শক্তির উত্থান বিশ্বব্যবস্থায় নতুনমাত্রা যোগ করে। পাশাপাশি, নেপালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় যাওয়া, শত বৈরী অবস্থার মধ্যেও ভারতে কমিউনিস্ট তথা বামপন্থী শক্তির প্রভাব অব্যাহত রাখা এ সবও বিশ্ব আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে নতুন নতুন উপাদান। ’সমাজতন্ত্রের মৃত্যু – পুঁজিবাদই শেষ কথা’ – এ শ্লোগানকে সামনে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের বিজয়ডংকার আওয়াজ শেষ হতে না হতেই শুরু হয় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার। পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির এই ভয়াবহ সংকট, খোদ মার্কিন সাম্যজ্যবাদসহ সকল পুঁজিবাদী দেশগুলোকে আঘাত করেছে। তার ভয়াবহ রূপ নতুন নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে এবং দেবে । পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির এই সংকট কালেও ভিয়েতনাম ও চীনের মতো দেশগুলোর অর্থনীতির নতুন শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়াও বিশেষ চিন্তার খোরাক দেবে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের দাবীতে গণবিদ্রোহ ও কোন কোন ক্ষেত্রে তার বিজয়, পাশাপাশি লিবিয়ায় মার্কিন সাম্রজ্যবাদ ও ন্যাটোর হস্তক্ষেপ আরও নতুন ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এগুলিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নাই।

বিংশ শতাব্দির ঘটনাবহুল বৈশ্বিক প্রপঞ্চকে ধারণ করে একবিংশ শতাব্দির শুরু হয়েছে – কিছু জিজ্ঞাসাকে সামনে নিয়ে।

সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা ঘাতপ্রতিঘাতের পাশাপাশি একবিংশ শতাব্দি যা ধারণ করেছে তাহলো প্রযুক্তি বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব বিকাশ, তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে জিন প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবকিছুই বিশ্বব্যবস্থাকে নতুন অভিঘাতের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের সামাজিকীকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এক অবশ্যম্ভাবী সম্ভাবনা হিসেবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাহাড়প্রমান বাধা সামাজিক অগ্রগতিকে করছে বাধাগ্রস্ত। অর্থনৈতিক বৈষম্যের এই পাহাড় ডিঙানো ছাড়া জ্ঞানবিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অগ্রযাত্রাকে সামনে এগিয়ে নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নতুন প্রেক্ষাপটে এটাই হলো নতুন সামাজিক বিপ্লবের পটভূমি। একবিংশ শতাব্দী এই বিপ্লবেরই মুখোমুখি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এটাই আজ বড় চ্যালেঞ্জ।

যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, বিংশ শতাব্দির শুরুতে পুঁজিবাদের সংকটের মধ্য দিয়ে সমাজ অগ্রগতির বিকল্প হিসেবে সমাজতন্ত্রের যে জয়যাত্রা গোটা এক শতাব্দিতে বিশ্বের কাছে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল – সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সেটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলো কি না। এটা সত্যি – সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদকেই শেষ কথা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অবিরাম চেষ্টা চলেছে। কিন্তু দু’দশকের মধ্যেই এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, এ দাবী সত্য নয়। বিশ্বব্যপী পুঁজিবাদের চরম সংকট মার্কসের মতবাদকেই সত্য প্রমান করে দিয়েছে যে, পুঁজিবাদ সমাধানহীন সংকটকে কখনই কাটিয়ে উঠতে পারে না। এখন প্রশ্ন হলো, পুঁজিবাদের সমাধানহীন সংকটের বিকল্প কি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে খুঁজে পাওয়া মার্কস নির্দেশিত সমাজতন্ত্র নাকি অন্য কিছু? মার্কসবাদীদেরকে এই প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হবে। নতুন চ্যলেঞ্জেই তাঁদেরকে নিজেদের মতবাদ বা কর্মসূচীকে সামগ্রিকভাবে উপস্থাপিত করতে হবে। এক শতাব্দি আগে বিশ্বের সামনে যে বিষয়গুলি অন্তর্ভূক্ত ছিল না আজ তা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। সমাজতন্ত্রের পুরোধা তাত্ত্বিকদের সাধারণ সূত্র ভুল প্রমানিত হয়নি দাবী করে, সেখানে থামলে চলবে না। বিশ্ব পরিস্থিতির যা পরিবর্তন হয়েছে, জ্ঞান বিজ্ঞানের আর প্রযুক্তির উন্নতি, উৎপাদন ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন এনেছে – তাকে আমলে নিতে হবে। বৈশ্বীকরণ আর বাজার অর্থনীতির নানা অনুসঙ্গ বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে নতুন রূপ ও উপাদান যুক্ত করেছে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে বিবর্তনের ধারায় নতুন অবস্থারও সৃষ্টি করেছে। এই সার্বিক পরিবর্তনকে গ্রাহ্য করেই তত্ত্ব বিনির্মান ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কৌশল স্থির করা জরুরি। কাজটা সহজ নয়। কিন্তু সেটাই চ্যালেঞ্জ। এটা প্রমানিত সত্য যে, পুঁজিবাদ শেষ কথা নয়, সমাজতন্ত্রই ইতিহাসের পরবর্তী সমাধান। এই সমাধানকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। একুশ শতকের নতুন প্রজন্মের কাছে এটা আহ্বান নয়- দাবী। প্রশ্নটা উঠে এসেছে, উত্তর খুঁজতে হবে – এটাই মার্কসবাদের শিক্ষা।

উপসংহারঃ

মার্কসীয় মতবাদ তৈরী হয়েছে সৃজনশীল, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে। মার্কসীয় দর্শনের মূল নির্দেশনাই হলো, সৃজনশীল বৈজ্ঞানিক চিন্তা। মার্কসবাদ কখনই কোন ধর্মীয় অনুশাসন ছিল না। আজও নেই। মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের মতো বিপ্লবী দার্শনিক-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সমাজ বিকাশের বৈজ্ঞানিক ধারার সাধারণ ও সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, বিগত এক শতাব্দি ধরে এবং সমসাময়িক বিশ্বের আর্থসামাজিক ঘটনাপ্রবাহ সেই দিক নির্দেশনার সাধারণ সূত্রকেই প্রতিদিন সমর্থন করছে। মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন তাঁদের ঐতিহাসিক দায় সম্পন্ন করেছেন। আজ যারা দেশে দেশে বিপ্লব চান, শ্রমজীবী মানুষ, সর্বহারা মানুষের মুক্তি চান- তাদেরকে এই ঐতিহাসিক দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হবে। নির্দিষ্ট বাস্তবতায় কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণ করে তার নিরিখে, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংগ্রামের রণকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। কোন দেশ বা সমাজের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায়, সৃজনশীল কোন বৈজ্ঞানিক ধারণা বিকাশের দায়িত্বও আসলে এ যুগের মানুষের। মার্কসবাদ- এই শিক্ষাই দেয়। সে জন্যেই মার্কসবাদ এখনও প্রাসঙ্গিক এবং দিকনির্দেশক।


Sharing Helps!