আমার এক অত্যন্ত স্নেহভাজন অনুজ সহকর্মী, সহযোদ্ধা এবং জ্ঞানী বন্ধু আমাকে প্রশ্ন এবং জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি হতাশাবাদী হয়ে যাচ্ছি কিনা । জীবন পাড়ি দেবার পথে অনেক ব্যর্থতা , হয়তঃ কিছু সফলতা, বহমান আনন্দ-বেদনা, জ্ঞান-অজ্ঞানতার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যতটুকু সামান্য বুঝতে পেরেছি, তাতে মনে হয়, এই জীবন অসামান্য। মানবজাতির দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যতটুকু জ্ঞান আমরা অর্জন করেছি, তা দিয়ে আমরা জানি, এই মহাবিশ্বে না বহুবিশ্বে কোথায়ও এখনো এই ‘জীবন’ পাওয়া যায়নি। এই ‘জীবন সৃষ্টি’ অকস্মাৎ দূর্ঘটনা না পরিকল্পিত সচেতন প্রয়াস এ নিয়ে দার্শনিক বিতর্ক চলমান, চলবে। এই মহাবিশ্বের পিছনে কারুর ‘মহাকারিগরি’ আছে নাকি এটা স্বতঃপ্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা –তা নিয়েও চলবে বিতর্ক, দ্বন্দ এবং গবেষণা। ভবিষ্যতে তার মিমাংসা নিয়েও চলবে এই দ্বন্দ। এটাই বহমান প্রক্রিয়া। কিন্তু একটি বিষয় প্রায় পরিষ্কার, মানবসভ্যতার ইতিহাস পড়ে আমরা বুঝেছি, ‘মানুষ হয়ে ওঠা’র প্রারম্ভ থেকে, যখন তৈরি হয়নি কোন গোত্র, ধর্ম, তন্ত্র বা বাদ, তখন থেকেই আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা অসীম সাহসে আর শ্রমে সংগ্রাম করেছেন, জীবন প্রবাহকে রক্ষা করতে, আদি মাতারা গর্ভে ধারণ করেছেন ভবিষ্যতের প্রজন্মকে, লড়াই করেছেন এই জীবনকে ভবিষ্যতের জন্য রেখে যেতে। সকল প্রজাতির জীবন প্রবাহই রক্ষিত হয়েছে, সবাই মিলে বেঁচে থাকার জন্য। সেই প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে দ্বন্দ, সংঘাত, লড়াই, শ্রেণী, বিদ্বেষ, ধর্ম, মতবাদ, সাহিত্য শিল্প, অন্ধকার অজ্ঞতা, আলোকিত বিজ্ঞান এবং তার সবকিছুরই শেষ কথা এই জীবন এবং তার ধারক এই মানবতার উতকর্ষতা এবং ভবিষ্যতের জন্য আরও সুন্দর কিছু রেখে যাবার নিরন্তর প্রয়াস। অনেক হতাশাবাদী জীবনকেই অর্থহীন ভাবতে পারে, তার অনেক বাস্তবতাও থাকে বা আছে। সমাজে, সভ্যতার অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ক্লেদাক্ততায় ত্যক্তবিরক্ত হয়ে জীবনকে এবং জীবন প্রবাহকেই অর্থহীন ভাবতে পারে, ভাবছেও। কিন্তু ইতিহাস কি বলে? হাজার হাজার বছরের লড়াইএর মধ্য দিয়ে ‘মানুষ’ মানুষ হিসেবে এই দায়িত্বই নিয়েছে, তা সুস্পষ্টভাবে বুঝে হোক আর অন্তর্নিহিত বোধের শক্তিতে হোক ‘জীবন’কে রক্ষা করতে হবে এবং সুন্দরতর হিসেবে ভবিষ্যতের জন্য রেখে যেতে হবে। যারা বিজ্ঞানের বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান বা প্রকৃতিবিজ্ঞানের ছাত্র তাঁরা এখন বেশ কিছুটা জানেন, ভবিষ্যতের কোন এক সময়ে ‘এন্ট্রপি’র অমোঘ নিয়মে এই মহাবিশ্বে জীবনের অস্তিত্ব রাখা সম্ভব হবে না বা অনিশ্চিত হবে। আবার এই পদার্থবিজ্ঞান এ পথেরও দিকনির্দেশ করছে যে, মানুষই সেই শক্তি অর্জন করতে পারে, যার মধ্য দিয়ে এই জীবনকে রক্ষা করার জন্য এই মহাবিশ্বের অন্য কোথাও অথবা কোন ‘সমান্তরাল মহাবিশ্বে’ যাত্রা করা সম্ভব। এই জীবনকে ধ্বংস বা নষ্ট করা নয়, তাকে আরোও সুন্দর করে এগিয়ে নেওয়া এবং রেখে যাওয়াই হলো শেষ কথা। তাই হতাশা নয়, গভীরবোধ আর সচেতন প্রয়াস নিয়ে, ‘জীবন, জীবনবোধ দিয়ে মানবজাতির বহমানতা রক্ষা করাই হলো প্রকৃত এবং পরিপূর্ণ জ্ঞানের পথে অভিযাত্রা। অনেক সংকট এবং অবিমৃশ্যকারিতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, দাঁড়াচ্ছেও, কিন্তু এই বহমানতাকে রোধ করতে পারে না – এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। এবং এই লড়াইএ শ্রম (কায়িক এবং মানসিক) এবং শ্রমশক্তির মুক্তিই হলো শেষ কথা। ‘বন্দীশ্রম’ মানুষের এই লড়াইকে এগিয়ে নেবে না। মুক্ত স্বাধীন সেই শ্রমই পারে প্রকৃতির মধ্যে থেকে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই লড়াইএ মানুষকে জয়ী করতে। যে বিশ্বাস, যে তন্ত্র, যে সামাজিক তত্ব এবং মতবাদ শ্রমকে বন্দী করতে চায় বা রাখতে চায়, তা সবই অশুভ এবং অকার্যকর। মুক্ত শ্রম, শ্রমশক্তি এবং চিন্তাই হলো মানুষের মুক্তি, বিজয় আর অগ্রযাত্রার শেষ কথা। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য সংস্কৃতি, সংগীত, শিল্পকলা, প্রযুক্তি সবকিছুরই শেষ লক্ষ্য হলো এবং উচিত হলো ‘মুক্তশ্রম ও চিন্তা’র বাস্তবতা তৈরি। সেটাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সংগ্রাম। বর্তমানের, ভবিষ্যতের এবং অস্তিত্বের।