করোনা ভাইরাসের বিপদ আজ আর শুধু বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্যের বিপদের মধ্যে থাকছে না। করোনা প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি-রাজনীতির যে ব্যাপক তোলপাড় আর মেরুকরণ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে- তাতে সাধারণ মানুষের মনে বিশ্বশান্তি এমনকি সভ্যতার বিপর্যয়ের শংকাও সামনে চলে আসছে। বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে যা শুধু আর অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিসরেই থাকতে চাইছে না। সামরিক শক্তি প্রয়োগ ও উস্কানি পর্যন্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। যা দৃশ্যতঃই বিশ্বশান্তি অক্ষুন্ন রাখার ক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে ভয়ংকর অনিশ্চয়তা। রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রক্রিয়াও চলছে গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাই বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে বিপদের প্রকৃতি ও উৎসটা পরিস্কারভাবে বুঝে নেওয়াটা জরুরি। কারণ তখনই কেবল বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস গড়ে উঠতে পারে। বাস্তবতা বোঝার জন্য এই আলোচনায় বিশ্বের প্রধান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সাম্প্রতিক সামরিক বাজেট ও সামরিক স্থাপনা বিশেষ করে যার যার দেশীয় সীমানার বাইরে অবস্থিত ‘সামরিক স্থাপনা’র একটি পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা হলো। মনে রাখতে হবে এই পরিসংখ্যান প্রকাশ্য। গোপনে অথবা হিসেবের বাইরেও অনেক হিসেব থাকে যা সাধারণতঃ জানা যায় না।
বৈশ্বিক সামরিক বিন্যাস বোঝার জন্য প্রধান প্রধান কিছু দেশকেই অন্তর্ভূক্ত করা হলো, কারণ কোন না কোন ভাবে এই দেশগুলোই বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
গোটা বিশ্বে ২০২০-২০২১ সালে সামরিক খাতে যে বাজেট বরাদ্দ হয়েছে তার পরিমাণ ১.৯১৭ ট্রিলিয়ন বা ১,৯১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তারমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭৩২.০ বিলিয়ন ডলার (জি ডি পির ৩.৪%), চীন ২৬১.০ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পি র ১.৯% ), রাশিয়া ৬৫.১ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পি র ৩.৯ % ), বৃটেন ৪৮.৭ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পির ১.৭% ) , ফ্রান্স ৫০.১ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পি র ১.৯% ), জার্মানী ৪৯.৩ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পি র ১.৩% ), ভারত ৭১.১ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পির ২.৪% ), পাকিস্তান ৭.৮ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পির ২.৯%), জাপান ৪৭.৬ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পির ০.৯ %), সৌদি আরব ৬১.৯ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পির ৮.০% ) , ইসরাইল ২০.৫ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পির ৫.৩% ), তুরস্ক ১৩.২ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পির ১.৭% ), দক্ষিণ কোরিয়া ৪৩.৯ বিলিয়ন ডলার ( জি ডি পির ২.৭%)।
প্রধান প্রধান দেশগুলির দেশের বাইরে সামরিক স্থাপনা বা ‘বেস’ এর পরিসংখ্যানও গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনা আছে ৫৬ টি, রাশিয়ার ১৫টি, চীনের ৪টি, বৃটেনের ১৬ টি, ফ্রান্সের ১৩ টি, জার্মানীর ২ টি, তুরস্কের ৮টি, ইসরাইলের ২ টি, ভারতের ৬টি, পাকিস্তানের ৪ টি, জাপানের ১ টি।
সামরিক ব্যয়ের নিরিখে পৃথিবীকে শতাংশে ভাগ করলে চেহারাটা দাঁড়ায়ঃ গোটা বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের ৩৮% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, ১৪% চীনের, ৩.৪% রাশিয়ার, ২.৬% জার্মানীর, ৩.২% সৌদি আরব, ৩.৭% ভারত, ২.৬% ফ্রান্স এবং বাকী বিশ্ব ৩২.৫%।
পৃথিবীর ১৫ টি বৃহৎ সামরিক বাজেটের দেশের মধ্যে ৬ টি দেশ ন্যাটোভুক্ত যেমন কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালি, বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। তাদের গোটা সামরিক বাজেটের পরিমাণ গোটা পৃথিবীর সামরিক বাজেটের ৫০%। ন্যাটোর ২৯ টি দেশের সামরিক বাজেটের পরিমাণ ১.০৪ ট্রিলিয়ন ডলার।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটে চীন এবার তার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করেছে ৫% শতাংশ। যদিও ১৯৯১ সালের পর থেকেই চীন তার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করেছে, কিন্তু তা কখনই তার জি ডি পির ১.৯% এর উপরে যায়নি। এশিয়ার মধ্যে চীনের পরই ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি। এ বার ভারত তার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করেছে ৭%, যার ফলে বাজেটের নিরিখে ভারত সৌদি আরবকে অতিক্রম করেছে। এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির মধ্যে সৌদি আরবের সামরিক বাজেট অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে। ইয়েমেনের সঙ্গে ক্রমবর্ধ্মান সামরিক উত্তেজনা ও সংঘাতের ফলে সৌদি আরব তার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সামরিক বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় ৪১ বিলিয়ন ডলার।
আফ্রিকা মহাদেশে সামরিক ব্যয় সর্বসাকূল্যে ৪২ বিলিয়ন ডলার।
লাতিন আমেরিকায় সামরিক বাজেটের পরিমাণ ৫৩ বিলিয়ন ডলার যার ৫০% ব্রাজিলের।
পরিসংখ্যান স্পষ্টতই দেখাচ্ছে, পৃথিবীর সামরিক বিপদের মূল উৎস ন্যাটো দেশভূক্ত দেশের সামরিক শক্তি বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সজ্জা। বিশ্বের যে কোন প্রান্তে যুদ্ধের উৎস হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক রণনৈতিক পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতে।
আর একটি বিষয়ও স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বের সামরিক ভারসাম্য ধীরে ধীরে এশিয়ার দিকে ঢলে পড়ছে। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এশিয়ার সামরিক্ গুরুত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এশিয়ার জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসখ্যার প্রায় তিন পঞ্চমাংশ অর্থাৎ প্রায় ৬০%। এদিক দিয়েও এশিয়ার গুরুত্ব ক্রমবর্ধমান।
করোনা ভাইরাস প্রাদূর্ভাবের সঙ্গে সংগে পৃথিবীর সকল দেশেরই নিরাপত্তা নীতিনির্ধারণীতে পূনর্মূল্যায়নের আভাস দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। সামরিক বাজেট বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকে। কিন্তু কোভিড-১৯ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা প্রধান্যের যে দৃষ্টিভংগি তা ভুল। ভাইরাসের আক্রমন কখনই অস্ত্র দিয়ে রুখে দেওয়া যায় না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বিশ্বনেতৃত্বের বড় অংশই এই সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে এবং হচ্ছে। জাতিসংঘের কার্যক্রম প্রায় শূন্যের কোঠায়। যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শক্তিবৃদ্ধি এবং ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস হওয়া উচিত ছিল প্রধান করণীয়, সেখানে দেখা গেল বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে দূর্বল করে দেবার পদক্ষেপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থ বরাদ্দ নানা অজুহাতে প্রত্যাহার করা হোল, কিন্তু তার বড় ধরণের কোন প্রতিবাদ হলো না। যখন বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে কোভিড ১৯ হামলা চালালো প্রবলভাবে, দেশের সীমান্তকে বিলুপ্ত করে দিয়ে, তখন সেই শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইএর বিপরীতে দেখা গেল, দোষারোপ আর অর্থনৈতিক অবরোধের মত অনৈতিক আর অমানবিক পদক্ষেপ নেবার খেলা, এমনকি সীমান্তে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। যখন দেশের অভ্যন্তরে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, তখন দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শান্তি স্থাপনের পরিবর্তে, পারস্পরিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের পরিবর্তে সঙ্ঘাতের পথে হাঁটছে। যেখানে প্রয়োজন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বিনিময়, যেখানে প্রয়োজন পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে সেই ভ্যাকসিন পৌঁছে দেবার মত সামরিক শৃংখলার, যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে পদক্ষেপ নেওয়া, সেখানে দেখা যাচ্ছে যুদ্ধবিমান ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন, মিসাইল স্থাপন আর পরীক্ষা। এই বৈপরিত্যের উৎস কোথায়?
মানব সভ্যতা আজ যে সংকটে এবং বৈজ্ঞানিকরা ভবিষ্যতবাণী করছেন অদূর ভবিষ্যতে এ বিপদ বাড়তে পারে, প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ের এই অশনি সংকেত জেনেও, কেন শান্তি ও সহযোগিতার প্রয়াস অনুপস্থিত- এই মৌলিক প্রশ্ন আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কোনভাবেই, সুস্থ ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন শান্তিকামী মানুষের কাছে যুদ্ধ বা সামরিক প্রস্তুতি মুখ্য বিষয় হতে পারে না।
করোনার আঘাতে বৈশ্বিক অর্থনীতি বিপর্যস্ত। তাকে পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজন বৈশ্বিক শান্তি ও সহযোগিতা, যুদ্ধ নয় বা যুদ্ধের উন্মাদনা নয়। যুদ্ধাস্ত্রের জন্য বাজেট বৃদ্ধি নয়, স্বাস্থ্যের জন্য, কর্মসংস্থানের জন্য বাজেট বৃদ্ধি। তাই আজ বিশ্বব্যাপী করোনা প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে শান্তি আর সহযোগিতার জন্য লড়াইটা বাড়িয়ে তোলার বিকল্প নাই। বিশ্বের শান্তির জন্য লড়াই দীর্ঘদিন থেকেই স্তিমিত, যুদ্ধের উন্মাদনাই প্রধান। করোনাতে মৃত্যুর মিছিল প্রমান করছে মানব সভ্যতা রক্ষায় শান্তি অপরিহার্য।