করোনা ভাইরাস বিশ্বের মানুষকে যে নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছে এটা আজ সর্বজনস্বীকৃত। বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার জন্ম দিচ্ছে।
১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার শ্লোগান নিয়ে যে পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছিল, গত দু’শো বছরে তার কিছুই আর অবশিষ্ট নাই- পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ বিকাশের দেশগুলোতেই সে প্রশ্নগুলো আজ জোরেশোরে উঠেছে। করোনার মৃত্যুর মিছিল আজ দম্ভ আর উন্নাসিকতাকে চ্যালেজ্ঞ করছে। মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, তাহলে এরপর কি?
১৯১৭ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বৈশ্বিক সংকট দেখেছিল সোভিয়েত বিপ্লব। তার সবটা রক্ষা করা যায়নি। ১৯৩৯-১৯৪৫ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে পৃথিবী ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তারও সবটা রক্ষা হয়নি। ২০২০ থেকে ২০৩০ সাল মানুষ নতুন পৃথিবী দেখবেই। যদি মানুষ এই সুযোগ হারায়, হয়তো ৫ দশক বা এক শতক অন্ধকারে চলে যাবে সভ্যতা, এ রকম উদাহরণ ইতিহাসে আছে। যারা নতুন পৃথিবী চায়, তাদেরকে এককাট্টা হয়ে নামতে হবে, তাকে অর্জন করতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সংকটের মধ্যে লেনিন বুঝেছিলেন পথটা কি। স্টালিনের বিরুদ্ধে যতকিছুই বলা হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি সোভিয়েত জনগণকে নিয়ে মানব সভ্যতাকে রক্ষার অন্যতম মূখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, ইতিহাসের সেই সত্য কোন অজুহাতেই মুছে ফেলা যায় না। বর্তমানের এই সংকটের রূপ আলাদা কিন্তু মর্মবস্তু খুব আলাদা নয়। এই সংকটের সমাধা্নের দায় এ যুগের মানুষকেই নিতে হবে, একজন নেতা না হলে হাজার হাজার নেতা হতে পারে। গত তিন দশক জুড়ে যে তরুণ-তরুণীদের বোঝানো হচ্ছে, ব্যক্তি সর্বস্বতাই সব। ব্যক্তি-মালিকানা, ব্যক্তির জোরে বেঁচে থাকা, একা একা বেঁচে থাকা, স্বার্থপর হিসেবে বেঁচে থাকা, বাজার আর মুনাফাই শেষ কথা, গত এক মাসেই সেই তরুণ-তরুণীরাই বলছে, এ সব মিথ্যে। সবার ঘরে কান পাতলেই তা বোঝা যায়। কিউবা নামে ছোট্ট দ্বীপ এখন পৃথিবীর পোষ্টার, চে আর ফিদেল আবার তরুণ-তরুণীদের সামনে মিথ। কার জোরে ইতালি, স্পেন আর গ্রানাডায় কিউবার ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীরা বুক চিতিয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইএ নামছে? কবে তাদের নেতা ফিদেল বলেছিলেন, ‘আমাদের অ্যাট্ম বোমা নেই, অন্যের দেশে বোমা ফেলি না, আমরা ডাক্তারদের পাঠাই মানুষকে বাঁচানোর জন্য’। সেই কথা মনে রেখে তারা জীবন বাজি রাখছে, জীবনকে জয় করতে। ভিয়েতনাম নামের মাঝারি মানের দেশ, একদিন যারা হো চি মিনের নেতৃত্বে মার্কিন আর ফরাসি সাম্রাজ্যবাদকে রুখে দিয়েছিল। তিন দশকের ডামাডোলে তাদের নাম হারিয়ে গিয়েছিল প্রায়, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা প্রমান করেছে, তারা অজেয় যোদ্ধা, একজনকেও না মরতে দিয়ে তারা করোনাকে পরাস্ত করেছে। ধীরে হলেও পৃথিবীর সামনে তা আসছে। ছোট ছোট পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে , যেখানে সমাজতন্ত্র ছিল এখন নাই, কিন্তু বোধটা আছে, তারাও করোনাযুদ্ধে এগিয়ে আছে। রাশিয়া এখন সমাজতন্ত্র নয়, তবুও মানুষ ভাবছে, ওদেশের মানুষই তো সমাজতন্ত্র দেখিয়েছিল, তারা নিশ্চয় মানুষের পাশে থাকবে, তারাও থাকবে, তারাও থাকছে। সবশেষে চীনের কথা বলতেই হয়, মাও সে তুং আর চৌ, দেং এর দেশ এখন যেমন আক্রমনের শিকার, তেমনি এ লড়াইএ সামনের নেতা। সমাজতন্ত্র বলে অনেকের চক্ষুশূল, ভাল আদর্শ সমাজতন্ত্র নয় বলে অনেকের চক্ষুশূল। তবে সামনের দিনে পৃথিবীতে চীন যে প্রধান প্রাসংগিক এটা আর কারুর পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই।
সবচাইতে বড় কথা, সমাজতন্ত্র যে বৈষম্যর বিরুদ্ধে বলে, সাম্যের পক্ষে বলে, শ্রমজীবি মানুষের উপর শোষণের বিরুদ্ধে বলে, ব্যক্তি সর্বস্বতার বিরুদ্ধে বলে, সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলে, প্রকৃতিকে রক্ষার কথা বলে আজ তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। করোনার মত বৈশ্বিক বিপদকে যে একা লড়াই করে ঠেকানো যায় না, উন্নত প্রযুক্তির স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকলেই হয় না, সেই উন্নত প্রযুক্তি কার জন্য, কিভাবে তা কাজে লাগবে, সেই নীতিটা মূল বিষয়। আজ সেটাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
গত তিন চার দশকের অন্ধকার করোনা যুদ্ধে কেটে যেতে পারে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে এ লড়াইএ অনেক মৃত্যু আছে, এ লড়াইএ জীবনও আছে। জীবনকেই বেছে নিতে হবে। মানুষই পারে তার শুভ বুদ্ধি আর লড়াইএর ক্ষমতা দিয়ে নিজেকে এবং প্রকৃতিকে রক্ষা করতে।