সুপারস্ট্রিং তত্বের ইতিকথা

Sharing Helps!

১। ভূমিকা পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতি সুপারস্ট্রিং তত্ব (Superstring Theory) এর অপরিহার্যতাঃ 

    সুপারস্ট্রিং তত্বের কথা বলতে গেলে  ‘বলের একীভূত’ (unification of force) করার প্রসঙ্গটি এসেই যায়। পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাস হলো ‘একীভূত’ করার ইতিহাস। সবচাইতে বড় ‘একীভূত’ করার অন্যতম ঘটনাটি ঘটেছিল ঊনবিংশ শতাব্দিতে। সেটা হলো বিদ্যুত আর চুম্বকের একত্বীকরণ। বিদ্যুত আর চুম্বকের যাত্রা হয়েছিল আলাদা আলাদাভাবে। এই দুটি বাস্তব প্রপঞ্চ (physical phenomenon)এর মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক আছে তা শুরুতে মানুষের জানা ছিল না। যদিও স্থির বিদ্যুত আর চুম্বকের বিষয়ে মানুষ জানে খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই। তবুও অস্টাদশ শতাব্দিতে ক্যাভেন্ডিস, কুলম্ব প্রভৃতি বিজ্ঞানীর গবেষণার হাত ধরে স্থির বিদ্যুত (static electricity)গবেষণালব্ধ ভিত্তি পায়। এর মধ্য দিয়ে স্থির বিদ্যুতের সুসংগত (consistent) তত্ব তৈরী হয়। সমসাময়িককালেই স্থির চুম্বকের তত্বও বিভিন্ন গবেষণার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক ভিত্তি পায়।কিন্তু  ঊনবিংশ শতাব্দির শুরুতেই ওয়েরস্টড, বায়োট-স্যাভার্ট, এম্পিয়ার, ফ্যারাডে প্রভৃতি জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের কাজের মধ্য দিয়ে চুম্বক আর বিদ্যুতের অঙ্গাংগী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সবার শেষে এই দু’টি প্রপঞ্চকে তাত্বিকভাবে পরিপূর্ণ মিলনের কাজটি সমাধান করেন ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ১৮৬৫ সালে তাঁর সুবিখ্যাত তড়িত-চুম্বকীয় সমীকরণের মাধ্যমে। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম সুন্দর তত্ব হিসেবে অভিহিত এই সমীকরণটি আলোর সংগে বিদ্যুত-চুম্বকের অসাধারণ সম্পর্কটিও স্পষ্ট করে দেয়। আলো যে আসলে  একটি বিদ্যুত-চুম্বকীয় তরংগ তাও এই তত্বের মাধ্যমেই আমরা জানি। এই অনন্যসাধারণ তত্বটি বল ‘একীভূতকরণ’ এর প্রথম সোপান। বিদ্যুত-চুম্বকের এই অসাধারণ মেল-বন্ধন শুধু পদার্থবিজ্ঞান নয়, সামগ্রিক বিজ্ঞানেও এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ম্যাক্সওয়েলের কাজের একশ বছর পর আর একটি যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যা বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে – তাহলো বিদ্যুত-চুম্বকীয় বল ও দূর্বল বলের (weak force) ঐক্য বা একীভূতকরণ। এর আগে ঊনবিংশ শতাব্দির শুরুতেই আইনস্টাইনের স্পেশাল রিলেটিভিটি তত্ব আর একটি ঘরানা তৈরি করে এবং আর এক ধরণের ঐক্যের  সন্ধান দেয়। এ ঐক্য হলো স্থান ও কালের। আইনস্টাইনের আগে স্থান ও কাল ছিল বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আলাদা সত্তা। আইনস্টাইন দেখালেন, না-স্থান ও কালকে একই ভূমিতে দাঁড় করাতে হবে।বিশ্বজগতের সকল ঘটনাই স্থান ও  কালের সম্মিলনে সংঘটিত হয়।

পদার্থবিজ্ঞান যখন আণুবিক্ষনিক (microscopic) স্তরে অণু, পরমাণু এবং  তারচাইতেও ক্ষুদ্র মৌলকণার যুগে প্রবেশ করলো, তখন চিরায়ত গতিবিদ্যা (Classical Mechanics) আর তাদের গতিপ্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে পারে না। তখন একে ব্যাখ্যা করার জন্য আবিষ্কার হয়, আর এক তত্বের-যার নাম কোয়ান্টাম মেকানিক্স বা কোয়ান্টাম গতিবিদ্যা (Quantum mechanics)। কোয়ান্টাম মেকানিক্স সকল পুরোনো পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের ধারণাই পালটে দিল। বলা হলো-সকল পর্যবেক্ষণই আসলে এক একটি ‘অপারেটর’ বা করক। পাশাপাশি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপপারমাণবিক (subatomic) স্তরে কতকগুলো বাস্তব স্বত্তা (physical entity) যেমন অবস্থান ও ভরবেগ, শক্তি ও সময় প্রভৃতি যাদের একই সময়ে সঠিকভাবে পরিমাপ করা যায় না, এই ঘটনাকে যে সূত্র দ্বারা প্রকাশ করা হয় তাহলো হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র (uncertainty principle)। কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর অনিশ্চয়তার সূত্র পরস্পর পরিপূরক এবং সংগতিপূর্ণ। কোয়ান্টাম মেকানিক্স তার নানা অবিস্মরণীয় সাফল্য দিয়ে বিংশ শতাব্দি জুড়ে বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করে রেখেছে। আবার সফলতার পাশাপাশি জন্ম দিয়েছে শতাব্দির দার্শনিক ও মহাবৈজ্ঞানিক বিতর্কেরও। যার কুশীলব ছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন এবং নিলস বোরের মত বিজ্ঞানীরা।  আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে কখনো সম্পূর্ন তত্ব হিসেবে গ্রহণ করেননি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রভূত সাফল্য তিনি মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু তার মৌলিক ভিত্তি ধারণাকে মেনে নেননি। এই বিতর্কের সিড়ি বেয়ে জন্ম নিয়েছে বিজ্ঞানের আরো বড় পথচলা। তার এই মেনে না নেওয়াটাই জন্ম দিয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের আর এক অধ্যায়ের। সেটা আজকের বিষয়ের সংগে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

    এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান যতটুকু জেনেছে, তা দিয়ে বলা যায়, মহাবিশ্বে সর্বসাকুল্যে বল চারটি। মহাকর্ষ বল (Gravitational force), তড়িত-চুম্বকীয় বল (Electromagnetic force), দূর্বল বল (Weak force), এবং সবল বা রঙ্গিন বল (Strong force or Clour force)। মহাপ্রতিভাধর আইজাক নিউটন হলেন মহাকর্ষ বলের জনক এবং আর এক ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানি একে পরিশীলিত করেন তার জেনারেল রিলেটিভিটির মাধ্যমে-তিনি আর কেউ নন – আলবার্ট আইনস্টাইন। বৃহৎ পরিসরে মহাজাগতিক সকল ঘটনার প্রায় নিখুঁত ব্যাখ্যা এই তত্ব দিতে পারে, কিন্তু এই তত্ব চিরায়ত বা ক্লাসিক্যাল, এটা কোয়ান্টাম তত্ব নয়। ফলে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে ( ~১০-৩৩ সেমিঃ) এই তত্বের সীমাবদ্ধতা থাকাটাই স্বাভাবিক। অনিশ্চয়তা সূত্র তথা কোয়ান্টাম থিয়োরি এবং জেনারেল রিলেটিভিটি দু’টি সফলতম তত্ব যেন দিগন্তবিস্তারী বৃন্তের দু’টি ফুল। তাদের মধ্যে যোগসূত্র যেন বিজ্ঞানে হারিয়ে গেছে। এই দু’টি তত্বের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়াটাই এ  যুগের বিজ্ঞানের আর এক অভিযাত্রা।

 প্রসংগক্রমে বলা ভালো, ম্যাক্সওয়েলের তড়িত-চুম্বকীয় তত্ব, বিশেষ আপেক্ষিকতার (special relativity) সংগে সংগতিপূর্ণ – কিন্তু নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রের সঙ্গে নয়। বিশেষ আপেক্ষিকতার সংগে সংগতিপূর্ণ করতে তাকেও সংস্কার করতে হয়েছে। তড়িত-চুম্বকীয় বলের সংগে বিশেষ আপেক্ষিকতার এই সম্পর্ক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাই এই বলের সংগে মহাকর্ষ বলের ঐক্যের সাধনায় আইনস্টাইনের জীবনের শেষ প্রায় তিনটি দশক গেছে নিঃসংগতায়।

   তৃতীয় দূর্বল বল (weak force) যা বিটা ক্ষয়ের (Beta decay) জন্য দায়ী – যেখানে নিউট্রন ভেংগে প্রোটন, ইলেকট্রন এবং এন্টি-নিউট্রিনো বা তার বিপরীত প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। আগেই বলা হয়েছে বিংশ শতাব্দির ষাটের দশকে এই বলকেই তড়িত-চুম্বকীয় বলের সংগে একীভূত করা হয়েছে- যার নাম ইলেকট্রো-উইক বল (Electro-weak force)।

  চতুর্থ বল হল হলো – সবল বা রঙ্গীন বল (Strong or colour force)। এই বল পরমাণু কেন্দ্রে প্রোটন, নিউট্রনসহ মিউওন ও অন্যান্য বস্তুকণাসমূহের (matter particle) মধ্যেকার অন্তঃক্রিয়ার জন্য দায়ী।

   

এই চারটি বলের একীভূত করার প্রক্রিয়াই আজকের পদার্থবিজ্ঞানের বড় চ্যালেঞ্জ।

   আগেই বলা হয়েছে- বিংশ শতাব্দির ষাটের দশকের শেষ দিকে বিজ্ঞানী সালাম-ওয়েনবার্গদের হাত ধরে তড়িত-চুম্বকীয় বল ও দূর্বল বল একীভূত হয়। এই প্রক্রিয়াটি দূর্বল বলকে ব্যাখ্যা করার অবধারিত পরিণতি হিসেবেই এসেছে, এটি কোন ধরে নেওয়া প্রক্রিয়া নয়।এই তত্বে চারটি কণা বলের বাহক হিসেবে কাজ করে-সেগুলি হলো W+, W, Z0 এবং ফোটন। প্রথম তিনটি কণা স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভাংগার (spontaneous symmetry breaking) মধ্য দিয়ে ভর পেয়ে দূর্বল বলের বাহক হিসেবে কাজ করে। আর স্থায়ীভরহীন কণা ফোটন হয় তড়িত-চুম্বকীয় বলের বাহক।

     ম্যাক্সওয়েলের তড়িত-চুম্বকীয় তত্ব কোয়ান্টাম তত্ব নয়, ক্ল্যাসিক্যাল বা চিরায়ত তত্ব। এই সুন্দর তত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ক্ল্যাসিক্যাল তড়িত-গতিবিদ্যা (classical electrodynamics) ব্যবহারিক জীবনের তড়িৎ সঞ্চালন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বেতার তরংগের ব্যবহারবিধি প্রভৃতি অনেক কিছুই প্রয়োজনীয় শুদ্ধতায় ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু ঘটনা যখন আণুবীক্ষণিক পর্যায়ে  যায়, তখন তা প্রয়োজনীয় সঠিকতা দিতে পারে না। তখন প্রয়োজন হয় কোয়ান্টাম তত্বের। তড়িত-চুম্বকীয় প্রপঞ্চের কোয়ান্টাম তত্বই হলো-কোয়ান্টাম তড়িত-গতিবিদ্যা (Quantum Electrodynamics, QED)। ফোটন এই কোয়ান্টাম ফিল্ডের কোয়ান্টাম কণা। দূর্বল বলের তত্বও একটি কোয়ান্টাম তত্ব। একীভূত তত্ব হিসেবে তাই তড়িত-দূর্বল তত্বের বিকাশ। উল্লেখ্য যে, পরীক্ষাগারে এই তত্বের দ্বারা পাওয়া ফলাফল অতি আশ্চর্যমাত্রায় সঠিক।

  এই সংখ্যায়ন (কণায়ন) বা কোয়ান্টাইজেশন (quantization) প্রক্রিয়া-সফলভাবে প্রয়োগ হয়েছে সবল বল বা রঙীন বলের (Strong force or colour force) ক্ষেত্রেও।  এই তত্বের নাম কোয়ান্টাম ক্রমোডাইনামিক্স (Quantum chromodynamics, QCD)। সবল বা রঙীন বলের বাহক হলো আটটি ভরহীন কণা, যাদেরকে রঙীন (colour) গ্লুয়ন (gluon) বলা হয়। কোয়ার্কদের মত এদেরকেও আলাদাভাবে দেখা যায় না। কোয়ার্ক কণা  গ্লুয়নএর ক্রিয়ায় সাড়া দেয়, কারণ কোয়ার্কও রঙ বা কালার বহন করে। কোয়ার্কের তিনটি রঙ থাকতে পারে।

  তড়িত-দুর্বল তত্ব ও কোয়ান্টাম ক্রমোডাইনামিক্স (quantum chromodynamics) মিলে তৈরী হয় – স্ট্যান্ডার্ড মডেল। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে  তড়িত-দুর্বল তত্ব এবং কোয়ান্টাম ক্রমোডাইনামিক্স উভয় তত্বই কাজ করে কারণ কিছু কণা উভয় বলই অনুভব করতে পারে। কিন্তু সমস্যাটি হলো, এই দু’টি বলের মধ্যে স্বাভাবিক গভীর মেলবন্ধন নেই। এই মিলন আরোপিত বললেও ভুল হবে না। তাই অনেক সময় বলা হয়, স্ট্যান্ডার্ড মডেল হলো- পদার্থবিজ্ঞানের সকল পরীক্ষালব্ধ সত্যের ব্যবহারিক সার-সংক্ষেপ ।   কিন্তু, মহাকর্ষ থেকে যায় এই মিলনের বাইরে। এই তত্বের কাঠামোতে মহাকর্ষ বলের একীভূত করার আর সুযোগ নাই।

    উল্লেখ্য,  স্ট্যান্ডার্ড মডেলে আছে ১২ টি বাহক (carrier) কণা। আটটি গ্লুয়োন, বাকীগুলো হলো W+, W, Z0 এবং ফোটন। আগেই বলা হয়েছে – এরা সবাই বোসন কণা (Boson particle)। আরো অনেক বস্তুকণা (matter particle) আছে – যারা ফার্মিয়ন কণা। বস্তুকণাকে প্রধানতঃ দুই ভাগে ভাগ করা যায় – লেপটন (Lepton) আর কোয়ার্ক (quark)( যাদের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে )।

   আদি কণাসমূহের মধ্যে  লেপটনের ঘরানায় আছে ইলেকট্রন (e ), মিউওন (µ) এবং টাও ( Tau) এবং তাদের সংগে সম্পর্কিত নিউট্রিনোসমূহ ।বস্তুকণার সংগে সংগে বিপরীত বস্তুকণা ( antiparticle) গুলোও এই সংসারের সদস্য। ফলে, সব মিলিয়ে লেপটনের সংখ্যা হয় ১২ (৬+৬)। আর কোয়ার্করা বহণ করে রঙ্গীন এবং বৈদ্যুতিক উভয় প্রকার চার্জ বা আধান, ফলে তারা সবল বলের পাশাপাশি দূর্বল বলের ক্ষেত্রেও সাড়া দেয়। ৬ প্রকারের কোয়ার্ক রয়েছে। এদের নামগুলো সাহিত্যের আদলে রাখা হয়েছে। এরা হলো- আপ (u), ডাউন (d), চার্ম (c ) স্ট্রেঞ্জ (s), টপ (t) এবং বটম (b)। u  এবং  d  কোয়ার্ক বিভিন্ন বৈদ্যুতিক চার্জও বহন করে এবং দূর্বল বলের ক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সাড়া দেয়। ছয়টি কোয়ার্ক আবার তিনটি রঙে প্রকাশিত হয়, ফলে কোয়ার্ক কণার সংখ্যা হয় -১৮ টি (৩ x ৬)। তাদের বিপরীত কণা ( antiparticle  ) মিলিয়ে কোয়ার্ক সংখ্যা হলো -৩৬ টি। তাহলে, লেপটন আর কোয়ার্ক মিলিয়ে সর্বমোট আদি কণার সংখ্যা হয় ৪৮ টি।

   স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সবচাইতে বড় সাফল্য হলো, এতগুলো মৌলকণার সকল অন্তঃক্রিয়াকে এই মডেল তাত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।পরীক্ষাগারেও এর সফলতা বিস্ময়কর। কিছুদিন পূর্বে সার্নের LHC তে হিগস বোসন বা ঈশ্বরকণার অস্তিত্বের প্রমান, এই তত্বের জন্য আর একটি মাইল ফলক। কিন্তু, এই তত্বের দু’টি বড় দূর্বলতা হলো, (এক) এই তত্ব মহাকর্ষকে নিজের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করতে পারে না, (দুই) এই তত্বে প্রায় ২০ টি প্যারামিটার রয়েছে, যেগুলো আরোপিত। এগুলোকে এর তাত্বিক পরিকাঠামোর মধ্যে তৈরী করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, মিউওন ও ইলেকট্রনের ভরের অনুপাত (২০৭) সংখ্যাটিকে তত্বের প্রয়োজনে আরোপ করতে হয়।

   অনেকেই মনে করেন, স্ট্যান্ডার্ড মডেল হলো, সম্পূর্ণ তত্ব (complete theory) বিনির্মাণের পথে একটি সফল পদক্ষেপ। তবে মনে রাখতে হবে, এই তত্বে দূর্বল বল এবং সবল বলের একীভূত করাটা আরোপিত, স্বয়ংসিদ্ধ নয়। তবে, আশার কথা হলো, স্ট্যান্ডার্ড মডেলের আরো সম্পূর্ণ চেহাবায়, অতিপ্রতিসাম্যতা বা সুপারসিমেট্রিকে অন্তর্ভূক্ত করতে পারে, যার মধ্য দিয়ে, বোসন ও ফার্মিয়ন কণাসমূহ একই ঘরানায় অন্তর্ভূক্ত হয়। তবে, প্রকৃতিতে যদি  অতিপ্রতিসাম্যতা থাকে, তাহলে, তার স্বতঃস্ফুর্ত ভাংগনের (spontaneous breaking) প্রক্রিয়াও থাকতে হবে যার মধ্য দিয়ে, বোসন ও ফার্মিয়ন কণা সৃষ্টি হতে পারে। তবে, এটা সত্য যে, স্টান্ডার্ড মডেলের আওতায় দূর্বল বল এবং সবল বলের ঐক্য হলেও, যদি মহাকর্ষ বল  দূরেই থাকে, তাহলে, নতুন যাত্রা করতেই হবে। উপ-আণুবীক্ষণিক স্তর থেকে শুরু করে, মহাজাগতিক স্তর সকল ক্ষেত্রেই, মহাকর্ষ হলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ। ব্ল্যাকহোল থেকে মহাবিশ্বের জন্ম রহস্যের মধ্যে মহাকর্ষ হলো ধাত্রী বল। তাকে বাদ দিয়ে কোন তত্বই সম্পূর্ণ হতে পারে না। তাই অনেক সফলতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েও – বিজ্ঞানীদের বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সেই সম্পূর্ণ তত্ব, যা মহাকর্ষকেও অন্তর্ভূক্ত করতে পারে এবং একই ধারায় উপ-আণুবীক্ষনিক ঘটনা থেকে মহাবিস্তৃত মহাবিশ্বের সকল ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারে। এখানেই সুপারস্ট্রিং থিয়োরির যাত্রা শুরু। দেখা যাক সে পথে মানুষ কতদূর এগিয়েছে।

২। সুপারস্ট্রিং তত্ব যে ভাবনার সূচনা করেছেঃ

    সাধারণ ভাবে বলা হয়, বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ (Special Relativity) এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মেল বন্ধনে তৈরী হয় “ কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরী   ( Quantum Field Theory)  । আর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ  বা  ‘General Relativity’  এবং  ‘Quantum Mechanics’ বা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার  মিলিত ফল হলো সুপারস্ট্রিং থিয়োরী। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরীর সাফল্য আর সীমাবদ্ধতা স্বাভাবিকভাবেই আরো সম্পূর্ণ তত্বের দিকে বিজ্ঞানীদের হাতছানি দেয়। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরীর তাত্বিক আর পরীক্ষাগারের সাফল্য এতটাই বিশাল যে, মানুষ বেশ কিছুকাল এই সাফল্য নিয়ে তৃপ্ত থাকতে পারতো, কিন্তু ঐ যে কথা আছে, মানুষ থামতে পারে না। তার চলার  যেন আর শেষ হয় না। তাইতো মানুষ যুগ যুগ ধরে শুধু খুঁজেই বেড়ায়। চলতে শুরু করে আরো আরো আলোর দিকে।  

  পদার্থবিজ্ঞানের  ‘Unified Theory’  বা একীভূতকরণ তত্বের  প্রতিদ্বন্দির শেষ নেই, সেই কাফেলায় এসে জোর দাবীদার হয়ে  উঠেছে স্ট্রিং থিয়োরী। সকল বলকে একীভূত করার যে চ্যালেঞ্জ বিজ্ঞানীরা নিয়েছেন, স্ট্রিং থিয়োরী তাকে ফলপ্রসু করবে বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা। সবচাইতে বড় কথা, স্ট্রিং থিয়োরী যেমন একদিকে একটি কোয়ান্টাম তত্ব, তেমনি তা অনায়াসে রিলেটিভিটি তত্বকেও সহজ স্বাভাবিকতায় অন্তর্ভূক্ত করে নেয় নিজের প্রয়োজনে, নিজের মধ্যে। তাই আশা করা হয়, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরী যে বলগুলিকে একীভূত করতে সমর্থ হয়েছে, এই তত্ব সে বলগুলিকে একীভূত করতে তো  সমর্থ হবেই, অধিকন্তু মহাকর্ষ বলকেও তাদের সংগী করে নেবে। অতি ক্ষুদ্র পরিসরে, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা যে মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করতে পারে না বলে মনে করা হয়, এই তত্ব সেই  মহাকর্ষ বলকেও ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন এবং সেই আপেক্ষিকতা বা রিলেটিভিটি থিওরী যা বৃহৎ বিস্তারে মহাকর্ষ  বল ব্যাখ্যার সর্বশ্রেষ্ট দাবীদার,  সেই তত্বকে আর বৈরী না ভেবে, পরমাত্মীয় ভাবতে পারবে। তবে তা হবে, পরিপূর্ণ বিকশিত স্ট্রিং থিয়োরীর মাধ্যমেই। প্রশ্নটা তখন আসেই যে, তাহলে এই স্টিং থিয়োরীই কি স্বপ্নের সেই সম্পূর্ণ থিয়োরী, যা বিজ্ঞানীদের অনেক দিনের সাধনা ? যে সম্ভাবনার জন্য আইনস্টাইন তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন-নিঃসংগ পথিক ?  

  স্ট্রিং থিয়োরীর প্রবক্তারা বলেন, অংকের দৃষ্টিতে, দুরূহ জটিল এই তত্বের একটি অত্যন্ত  সহজ সরল ধারণার ভিত্তি রয়েছে। এই ধারণামতে, যে স্ট্রিংকে সকল বস্তুর আদি হিসেবে ধরা হয়, আসলে বিশ্বের সকল আদিকণা হলো, সেই স্ট্রিং এর কম্পনের এক একটি হারমনিক বা ঐক্যতান সুর। হ্যাঁ, অসাধারণ নান্দনিক ধারণা। এই ভিত্তি ধারণা যদি মিলতে পারে, অসাধারণ কোন সর্বাংগ সুন্দর গাণিতিক প্রক্রিয়ার সাথে, তাহলে তার চাইতে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে ? এতে হয়ত আবার প্রমান হবে, গোটা প্রকৃতিই হলো আসলে অনেক সুরের ঐক্যতান বা অর্কেস্ট্রা। বিষয়টিকে আর একটু ব্যাখ্যা করে বলা যাক। একটি বেহালা বা গিটার বাজতে পারে বিভিন্ন সুরে। প্রত্যেকটি সুর তৈরী হয় তারের টান এবং দৈর্ঘ্যের  উপর। প্রত্যেকটা সুরই এক একটি ঐক্যতান বা হারমোনিক। ঠিক এই বেহালা বা গিটারের তারের হারমোনিকের মত প্রকৃতির প্রতিটি মৌলকণাই হলো  ষ্ট্রিং এর কম্পনের এক একটি হারমোনিক। বোসন বা ফারমিউওন সবাই, যেমন মহাকর্ষের বাহন গ্র্যাভিটন,  বিদ্যু্ত-চুম্বকীয় বলের বাহন ফোটন তেমনি লেপটন, ব্যারিওন সবাই।  আবার একটি কণা ভেংগে দু’টি কণা হবার প্রক্রিয়াটিও আসলে একটি স্ট্রিং থেকে  দু’টি   স্ট্রিং হবার সমার্থক। যদিও প্রস্তাবনা অনুসারে এই স্ট্রিংএর দৈর্ঘ্য  এতই ক্ষুদ্র যে পরীক্ষাগারে এর বাস্তব অস্তিত্বের পর্যবেক্ষণ এখনো প্রশ্নবিদ্ধ ও সুদূর পরাহত।

 স্ট্রিং থিয়োরী মহাকর্ষের একটি সম্পূর্ণ কোয়ান্টাম থিয়োরী হতে পারে। আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটিকে কোয়ান্টাইজ বা কণায়ন করলে যে সকল  বিপত্তি দেখা দেয়, স্ট্রিং থিয়োরীতে তা না হবার যে সম্ভাবনা – যা স্ট্রিং থিয়োরীর সাফল্যের একটি বড় চালিকাশক্তি।

 অন্যদিকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের তুলনায় এই তত্ব একটা দিকে এগিয়ে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় সমালোচনা হলো – এই তত্বে বিশটি মাত্রাহীন প্যারামিটার রয়েছে, যাদের সুনির্দিষ্ট মানের সমন্বয় প্রয়োজন হয়। কোন একটি তত্ব যদি এ ধরণের বহু মাত্রাহীন প্যারামিটারের বিশেষ মানের উপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে তাকে একটি একক তত্ব (Unique Theory) বলা যায় না। এর বিপরিতে স্ট্রিং থিয়োরির একটিমাত্র প্যারামিটার -তাহলো স্ট্রিং এর দৈর্ঘ্য।  তাই, স্ট্রিং থিয়োরীকে অন্ততঃ কোন বিশেষ মান নির্ধারিত প্যারামিটারের উপর নির্ভরশীল হতে হবে না -বলেই মনে হয়।

  এই তত্বের আর একটি সুবিধা হলো, স্থান-কালের মাত্রার স্থিরতা। এখন আমাদের জানা তত্বের ভিত্তিতে বাস্তব জগতে -স্থান-কালের মাত্রার সংখ্যা চার। তিনটি স্থানের, একটি কালের। স্ট্যান্ডার্ড থিয়োরীতে স্থান-কালের এই মাত্রাকে ধরে নেওয়া হয় – এটা তত্বের লব্ধ ফল নয়। কিন্তু, স্ট্রিং  থিয়োরীতে স্থান-কালের মাত্রা সরাসরি তাত্বিক গণনার মধ্য দিয়ে এসে যায়। যদিও তার সংখ্যা চার নয়, দশ। স্বাভাবিক পরিসরে কিছু মাত্রা লুকিয়ে থাকে। কিভাবে তার ব্যাখ্যা স্ট্রিং থিয়োরি  দিতে পারে বলে -বিজ্ঞানীরা দাবী করেন। যদি স্ট্রিং থিয়োরির  সঠিকতা প্রমানিত হয় তবে, এটাও এই তত্বকে প্রমান করতে হবে যে বস্তুজগতে দৃশ্যমান মাত্রা চারটি – অর্থাৎ একটি বিশেষ শর্তে দশমাত্রা বাস্তবে চারমাত্রা দেখায়। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। প্যারামিটারের মান পরিবর্তন করে স্ট্রিং থিয়োরীর রকমফের হয় না, এটা যেমন তার শক্তি, তেমনি এটার অদ্বিতীয়তা বা অনুপমতা প্রমান করতে পারাটাও আর একটা বড় চ্যালেঞ্জ। 

    স্ট্রিং থিয়োরির গড়ে ওঠার মধ্যেই কয়েকটি ভাগ রয়েছে। প্রথমতঃ একে দু’টি প্রধান ধারায় ভাগ করা যায় যেমন খোলা স্ট্রিং এবং বদ্ধ স্ট্রিং তত্ব। দ্বিতীয় যে ধারায় স্ট্রিং থিয়োরীকে ভাগ করা হয় তাহলো বোসনিক স্ট্রিং তত্ব এবং সুপারস্ট্রিং তত্ব। বোসনিক তত্ব শুধুমাত্র বোসন কণাকেই ব্যাখ্যা করতে পারে। এই তত্বে মাত্রার সংখ্যা ২৬টি। কিন্তু এটা সহজেই বোঝা যায় যে, যে তত্ব শুধুমাত্র বোসন কণাকে ব্যবহার করে, ফার্মিয়নকে যুক্ত করতে পারে না, তার সীমাবদ্ধতা আছে। অন্যদিকে, সুপারস্ট্রিং থিয়োরি  বোসন এবং ফার্মিয়ন উভয় কণাকে অন্তর্ভূক্ত করে তত্ব বিনির্মাণ করে এবং তার মাত্রা সংখ্যা ১০। এই তত্ব অনুসারে বোসন এবং ফার্মিয়ন কণাসমূহ আসলে অতিপ্রতিসাম্যতা বা সুপারসিমেট্রি দ্বারা সম্পর্কিত। এখন প্রায় সবাই ধারণা করছেন, সকল বাস্তবসম্মত স্ট্রিং থিয়োরি  সুপারস্ট্রিং দ্বারা গঠিত হতে পারে। আজও অধরা গ্রাভিটন যা মহাকর্ষ বলের ধারক তা একটি বদ্ধ স্ট্রিং থেকে উদ্ভূত হতে পারে। তাই এটা আজ প্রায় সকল পদার্থবিজ্ঞানীকেই আশার আলো দেখাচ্ছে যে, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি, স্ট্যান্ডার্ড মডেল প্রভৃতি তত্ব ইউনিফায়েড ফিল্ড থিয়োরি গড়ে তোলার পথে যে সকল প্রতিবন্ধকতাকে সামনে নিয়ে এসেছে, সুপারস্ট্রিং থিয়োরি তার সমাধানের পথ দেখানোর আলো দেখাচ্ছে।

    এটা বলে নেওয়া ভালো যে, পরীক্ষাগারে যথার্থতা প্রমানের কোন ভবিষ্যত বাণী  করার মত পর্যায়ে স্ট্রিং থিয়োরি পৌঁছেনি। পরীক্ষাগারে যথার্থতা প্রমান করতে হলে, একটা তত্বের প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যত বাণী – এটা সহজ কাজ নয়।স্ট্রিং থিয়োরি এখনো তার শৈশবে রয়েছে। তাই এই মুহূর্তে তার কাছ থেকে এখনো এত বড় কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু সম্ভাবনার কথা আসতেই পারে। দেখা যাক সম্ভাবনাগুলি কি কি? আগেই বলা হয়েছে, সুপারস্ট্রিং থিয়োরির দশটি মাত্রার -একটি কালের, নয়টি স্থানের। স্ট্রিং থিয়োরি সত্য হলে, এই অতিরিক্ত স্থানের মাত্রার বাস্তব অস্তিত্বের প্রমান থাকতে হবে। যদিও এখনো দৃশ্যতঃ এর অস্তিত্বের সরাসরি প্রমান আমাদের সামনে নাই, পরোক্ষভাবে প্রমানের সম্ভাবনা কি আছে ? খতিয়ে দেখা যাক। যদি অতিরিক্ত মাত্রার দৈর্ঘ্য প্ল্যাংক দৈর্ঘ্যের (~ 10-33  সেমিঃ ) কাছাকাছি হয় – তাহলে আমাদের হতাশ হতে হবে হয়ত। কারণ এখনো পার্টিকল এ্যাক্সিলেরেটরে পরিমাপযোগ্য দৈর্ঘ্যের পরিমাণ ১০-১৬ সেমির কাছাকাছি। প্ল্যাংক দৈর্ঘ্য তারচাইতে বহু বহুগুণ ছোট। এই মাত্রার দৈর্ঘ্য আদৌ পরিমাপযোগ্য কিনা সেটাও একটা মৌলিক প্রশ্ন হতে পারে। মনে করা হয়, স্ট্রিং এর দৈর্ঘ্য হবে এই প্ল্যাংক দৈর্ঘ্যের সমমাপের, তাই তত্বানুসারে অতিরিক্ত মাত্রার দৈর্ঘ্যও হবে প্ল্যাংক দৈর্ঘ্যের কাছাকাছি। তাই পরীক্ষাগারে এই মাত্রার অস্তিত্ব পরিমাপযোগ্য কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্তু আশার কথা হলো, স্ট্রিং থিয়োরি অতিরিক্ত  মাত্রার দৈর্ঘ্য এক মিলিমিটারের এক দশমাংশ পর্যন্ত অনুমোদন করে,  তবে সেক্ষেত্রে স্ট্রিং এর দৈর্ঘ্য হতে হয় ~ ১০-১৮ সেমির মত। উপরন্তু, আমাদের তিনমাত্রার স্থান, নয় মাত্রার স্থানের মধ্যে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ বা গ্রথিত থাকতে হবে। এই হাইপারস্পেস বা বেশীমাত্রার তলকে বলে ডি-ব্রেন। ডি-ব্রেনের বাস্তবতা হলো স্ট্রিং থিয়োরির বাস্তবতার ভিত্তি।এই ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত মাত্রার অস্তিত্ব পরীক্ষিত হতে পারে কেবল মহাকর্ষিক পরীক্ষার দ্বারা। যদি এই বৃহৎ স্কেলে অতিরিক্ত মাত্রার অস্তিত্ব পাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তা হবে স্ট্রিং থিয়োরীর যথার্থতার  একটি বড় প্রমান।

   অন্য আর একটি সম্ভাবনা হতে পারে সুপারসিমেট্রি বা অতিপ্রতিসাম্যতার পরীক্ষাগারে প্রমান। যদি ১০ মাত্রার সুপারস্ট্রিং থিয়োরিতে ৬ মাত্রা সুপ্ত সংবদ্ধ থাকে, তাহলে বাকী চার মাত্রার তত্ব অতিপ্রতিসাম্যক ( supersymmetric ) হবে। আর ভবিষ্যত অ্যাক্সিলেরেটরে চারমাত্রিক তত্বের অতিপ্রতিসাম্যতা প্রমানিত হলে তা হবে সুপারস্ট্রিং থিয়োরির জন্য আর একটি বড় মাইলফলক।

   স্ট্রিং থিয়োরিকে নতুন কোন মৌলকণা, ঘটনা বা প্রপঞ্চের অস্তিত্বের ভবিষ্যদবানী করতে পারা ছাড়াও আরো একটি পরীক্ষায় পাশ করতে হবে, তাহলো স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সকল ফলাফলের আত্তীকরণ করতে পারা। যেহেতু, স্ট্রিং থিয়োরি সকল বলের একীভূত করার দাবীদার, সেহেতু কম শক্তির ক্ষেত্রে এই তত্বকে অবশ্যই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সকল ফলাফলের পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা থাকতে হবে। অর্থাৎ যে শক্তিতে স্ট্যান্ডার্ড মডেল যে সকল মৌলকণার অস্তিত্বএর ভবিষ্যত বাণী  করতে পারে এবং যে বলগুলির একীভূত করতে পেরেছে – স্ট্রিং থিয়োরিকেও তা পারতে হবে। হ্যাঁ খুশীর খবর হলো, স্ট্রিং থিয়োরির কোন কোন মডেল দাবী করে যে,  তা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ফলাফলের সংগে অবিকল সাদৃশ্য দেখাতে সমর্থ। আগেই বলা হয়েছে, স্ট্রিং থিয়োরি অনুসারে, আমাদের বাস্তব জগৎ আসলে, স্ট্রিং থিয়োরির ডি-ব্রেনের অংশ বিশেষ। ডি-ব্রেনের অতিরিক্ত মাত্রাগুলি গুটিয়ে যেন লুকিয়ে থাকে সংবদ্ধভাবে এবং স্ট্রিং থিয়োরি মতে খোলা বা মুক্ত স্ট্রিং এর প্রান্তগুলি ডি-ব্রেনের সংগে যুক্ত থাকে। স্ট্যান্ডার্ড মডেল বর্ণিত সকল গেজ বোসন বা ফার্মিয়ন মৌলকণা আসলে ডি-ব্রেনের সংগে সংযুক্ত খোলা বা মুক্ত স্ট্রিং এর কম্পনের সর্বনিম্ন বা মূল হারমোনিক বা ঐক্যতান।

     স্ট্রিং থিয়োরি আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্বের সংগে এক অভিনব সম্পর্ক তৈরী করতে পারে বলে ধারণা করা হয়। আইনস্টাইনের মহাকর্ষ সমীকরণএর অনেকগুলি সমাধান  হতে পারে, যেগুলি আবার এক একটি মহাজগতের নির্দেশক, তার মধ্যে একটিমাত্র সমাধান আমাদের বাস্তব মহাজগত। এই সকল সমাধানই নির্ভর করে আদি শর্ত (initial condition), প্রতিসাম্যতা(symmetry) এবং সারল্যের (simplicity) উপর। যে তত্বের সমাধান যত কম, সেটা তত বেশী সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদবানী করতে সমর্থ। স্ট্রিং থিয়োরির মজা হলো, এর সমাধানগুলো, বিচ্ছিন্ন (discrete) এবং অবিচ্ছিন্ন (continuous) উভয় ধরণের প্যারামিটারকে সংশ্লিষ্ট করে। এটা এই তত্বের একটি শক্তি। তবে, যদি স্ট্রিং থিয়োরিকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পুনরুৎপাদন করতে হয় তাহলে, স্ট্রিং থিয়োরির সমাধানের বিচ্ছিন্ন প্যারামিটার থাকতে হবে, শুধু অবিচ্ছিন্ন প্যারামিটার থাকলে চলবে না, কারণ  তা ভরহীন বস্তুকণার ভবিষ্যৎ বাণী  করবে, বাস্তবে যার পর্যবেক্ষণ সম্ভব নয়। যদি এমন হয় যে কোনো স্ট্রিং মডেলই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ভবিষ্যৎ বাণীকে পুনরুৎপাদন করতে পারছে না, তখন  সে মডেল ত্যাগ করতে হবে, কারণ পরীক্ষাগারে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ভবিষ্যৎ বাণী  যতটা সফলভাবে পরীক্ষিত হয়েছে, তাকে উপেক্ষা করা যায় না। এমনটা যদি হয় যে, কোনো একটি স্ট্রিং মডেল দিয়ে স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে পরিপূর্ণভাবে পুনরূৎপাদন করা সম্ভব হলো, অধিকন্তু স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ধরে নেওয়া সকল প্যারামিটারগুলোকেও তত্ব থেকে স্বাভাবিকভাবেই পাওয়া যায় – তাহলে তা হবে সর্বোত্তম।

   স্ট্রিং থিয়োরির প্রবক্তারা বলেন, এই তত্বের বড় সফলতা হলো, এই তত্ব মহাকর্ষকে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে অর্থাৎ মহাকর্ষ বল এই তত্বের একটি স্বাভাবিক ফল। যদি তাই হয় তাহলে এটি  একটি বড় সফলতা। কারণ মহাকর্ষ বলই হলো, জানা বলগুলোর মধ্যে সবচাইতে পুরনো বল, যাকে কোন তত্বই অন্য বলের সংগে একীভূত করতে সমর্থ হয়নি। আর সবচাইতে বড় কথা মহাকর্ষকে স্ট্রিং থিয়োরিতে বাইরে থেকে আরোপ করতে হয়না – এটা এই তত্বে স্বয়ংপ্রকাশিত। সংগে এটাও বলা হয়, স্ট্রিং থিয়োরি হলো,   রিলাটিভিস্টিক কোয়ান্টাম থিয়োরি । ক্লাসিক্যাল বা চিরায়ত রিলেটিভিটিতে স্ট্রিং এর কোনো কম্পনই মহাকর্ষ বলের বাহক গ্র্যাভিটনের সমার্থক নয়, অথচ, কোয়ান্টাম কম্পনে এটা একটা স্বাভাবিক ফল। স্ট্রিং থিয়োরি দিয়ে মহাকর্ষ বলের এই স্বাভাবিক ব্যাখ্যা চিত্তাকর্ষক না বলে পারা যায় না।

   স্ট্রিং থিয়োরির আর এক সফলতা হলো- এটা প্রচলিত কণা পদার্থবিজ্ঞানের (particle physics) এর সকল তত্ব বিশেষ করে গেজ থিয়োরি (guage theory)কে পরিপূর্ণভাবে এবং পরিস্কারভাবে বোঝার জন্য শক্তিশালী সহায়ক ভূমিকা রাখে। গেজ থিয়োরির অনেক ফলাফলই পাওয়া যায় স্ট্রিং থিয়োরির ডি-ব্রেন ধারণা থেকে। চারমাত্রার গেজ থিয়োরি এবং বদ্ধ সুপারস্ট্রিং থিয়োরির মধ্যে এক আশ্চর্য সাদৃশ্য রয়েছে।

   স্ট্রিং থিয়োরি ব্ল্যাক-হোলের স্ট্যাটিস্টিক্যাল গতিবিদ্যা (statistical mechanics) বিষয়ক ব্যাখ্যাকে নিজেও ব্যাখ্যা করতে পারে, যা আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ব দিয়ে পাওয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন প্রকারের ডি-ব্রেন এবং স্ট্রিং ব্যবহার করে তত্বগত ভাবে ব্ল্যাকহোল তৈরী করা সম্ভব, যার মধ্য দিয়ে, ব্ল্যাকহোলের প্রস্তাবিত এনট্রপি ও তাপমাত্রা ব্যাখ্যা করা যায়।

  তাই কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তত্ব যা একটি স্ট্রিং মডেল তাকে অবশ্যই মহাকর্ষের অন্য সব ঘটনার সংগে সংগে মহাজগতের জন্ম ও আজ পর্যন্ত বিকাশের সকল প্রপঞ্চ (phenomenon) কে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতে হবে। মনে করা হয়, মহাবিশ্বের যে রহস্য ক্ল্যাসিক্যাল মহাকর্ষ তত্ব বা জেনারেল রিলেটিভিটি ব্যাখ্যা করতে পারে না, বুঝতে হবে মহাবিশ্বের বিপুল রহস্য রয়েছে সেখানেই। আর স্ট্রিং থিয়োরির বড় চ্যালেঞ্জ হলো – সেই রহস্যকে উদ্ঘাটন ও ব্যাখ্যা করতে পারা।

৩। উপসংহারঃ সভ্যতা এগিয়ে চলে প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটন করেই

      শিশু মহাবিশ্বের অপার জন্ম রহস্য থেকে শুরু করে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অভিনব সাফল্যকে ধারণ করে নিজেকে একটি সম্পূর্ণ ও একক তত্ব হিসেবে সামনে আসার এক বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে সুপারস্ট্রিং থিয়োরি বিজ্ঞানীদের সামনে হাজির হয়েছে। এর সফলতা বিজ্ঞানীদের অপার আনন্দ সাগরে ভাসাবে আর এর ব্যর্থতা আবার বিজ্ঞানীদের নতুন পথ অন্বেষনের শক্তি যোগাবে। স্ট্রিং থিয়োরি তাই এখন অশেষ সম্ভাবনার প্রতীক। নতুন প্রজন্মের পদার্থবিজ্ঞানীদের প্রথম প্রেমের উন্মাদনা আর বৃদ্ধ বিজ্ঞানীদের সংশয়ের দোলাচলে সুপারস্ট্রিং থিয়োরি এগিয়ে চলছে। এর অগ্রগতি মানব সভ্যতার অগ্রগতির সমার্থক। আইনস্টাইনের মত অমিত প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা যাঁরা ইউনিফায়েড ফিল্ড থিয়োরি সৃষ্টির স্বপ্ন নিয়ে মহাকালের বুকে আশ্রয় নিয়েছেন-তাঁদের অসমাপ্ত কাজের পরিপূর্ণতার পথে সুপারস্ট্রিং থিয়োরির পথ বেয়ে হয়ত জন্ম নেবে অনেক আইনস্টাইন। এক ব্যর্থতা আর এক সফলতার সোপান তৈরী করবে।

References

1. Brian Greene, The Elegant Universe, New York, Vintage Books, A division of random House, Inc. 

2. A Zee, Quantum Field Theory, Princeton University Press, Princton and Oxford.

3. Michio Kaku, Einstein’s Cosmos, W. W. Norton & company, New York, London.

4. Barton Zwiebach, A First Course in String Theory, Cambridge University Press.


Sharing Helps!