(১) ভূমিকা
আজ থেকে একশ বছর আগে, যুদ্ধ-জাহাজ ‘অরোরা’র যে বজ্রনির্ঘোষ ইতিহাসের নতুন বার্তা নিয়ে এসেছিল, তা এখনো সভ্যতার ইতিহাসে এক মাইল ফলক হয়ে রয়েছে। বিগত একশ বছরে মানব সভ্যতা দেখেছে আর একটি আত্মধংসী বিশ্বযুদ্ধ, যেখানে ছিল হিরোসিমা-নাগাসাকির মত পারমাণবিক ধ্বংসলীলা, আবার যেখানে ছিল শ্রমজীবি মানুষের প্রথম বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সোভিয়েত জনগণের অপরিমেয় আত্মত্যাগের মহিমা, যা মানব সভ্যতাকে রক্ষা করেছে। আবার দেখেছে চীনের বিপ্লব, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের বিপ্লবী জনযুদ্ধের বিজয়। দেখেছে ক্যাস্ত্রো আর চের নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লব। দেখেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশে দেশে জাতীয় মুক্তি অর্জনের বীরোচিত সংগ্রাম, দেখেছে আরো অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধ্বংস, প্রতিবিপ্লব। কালের গভীরে, সময়ের স্রোতধারায় সবই আজ ইতিহাসের সাক্ষী। এই বিপ্লবের পক্ষে –বিপক্ষে অসংখ্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আজ আর অন্ধকারে নেই। ঘৃণা আর আবেগের সকল তুচ্ছতাকে উপেক্ষা করে, ইতিহাসের এক অপরিহার্যতায়, ইতিহাসের কোলে তা স্থান পেয়েছে। স্থান পেয়েছে, সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ আর সর্বাধিক প্রভাব সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলোর অন্যতম হিসেবে।
(২) অক্টোবর বিপ্লবের অভিঘাত- ইতিহাসের অগ্রযাত্রা
যে ভাবেই চিত্রিত করার প্রয়াস থাক না কেন, অক্টোবর বিপ্লব শুধুমাত্র রাশিয়ার মতো ইউরোপের নিরিখে পশ্চাদপদ একটি পুঁজিবাদী সমাজ থেকে নতুন সমাজব্যবস্থায় উত্তরণের বিপ্লবী ঘটনাই নয়, গত শতাব্দিকাল ধরে প্রমানিত হয়েছে যে, এ বিপ্লব তার চেয়েও অনেক বেশি সর্বগ্রাহী। এটা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অক্টোবর বিপ্লবের অভিঘাত আর প্রণোদনা মানব সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে কয়েক শতাব্দি। অক্টোবর বিপ্লব সহায়তা করেছে বিশ্ব ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক তত্বায়নের নতুন চিন্তা ও অনুশীলন সামাজিক পুনর্গঠনের নতুন তত্বের ব্যবহারিক রূপকল্প তৈরীতে। এর ফলে শুরু হয়েছে জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন দ্বার উন্মোচন ও প্রযুক্তির নবযাত্রা। এ বিপ্লব প্রনোদনা দিয়েছে সমগ্র বিশ্বের দেশে দেশে শিল্প-সংস্কৃতির অভূতপূর্ব সৃষ্টির। এ বিপ্লব মানবতার নতুন স্বপ্ন আর সংজ্ঞায় উদ্ভাসিত করেছে মানব-সভ্যতাকে। শুধু রাশিয়ার জনগণ নয়, এ বিপ্লবের উত্তরাধিকার – সমগ্র মানবজাতির। অক্টোবর বিপ্লব বিশ্ব-মানবতার কাছে আন্তর্জাতিকতার এক নব দিগন্তের সূচনা করেছে। এ বিপ্লব উড়ালের প্রত্যন্ত স্তেপ থেকে এশিয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অন্ধকার দ্বীপ ও আফ্রিকার মরুভূমি হয়ে লাতিন আমেরিকার প্রাগৈতিহাসিক জনপদকে উত্থিত করেছে। এ বিপ্লব মেহনতি মানুষকে এই নতুন বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত করেছে যে, সভ্যতার লাগাম শ্রমজীবি মানুষের হাতে, শ্রমবিমুখ পরনির্ভরশীল নিপীড়ক শোষকদের হাতে নয়।
(৩) ইতিহাসের নির্মোহ দৃষ্টিতে ফিরে দেখা
১৯১৭ সালে যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল, সমাজতান্ত্রিক যুগের সূচনা, হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম, ১৯৯১ সালে সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, অক্টোবর বিপ্লব কি ইতিহাসের অপরিহার্যতা, নাকি বিচ্ছিন্ন দূর্ঘটনা। এই প্রশ্নকে আজ এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। ভয় পাবার কিছু নেই, কারণ, অসংখ্য দলিল, প্রত্যক্ষদর্শীদের বই ও প্রতিবেদন, পশ্চিমা লেখকদের লেখা অক্টোবর বিপ্লবের পক্ষে-বিপক্ষে লেখা বই, সর্বোপরি, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর তথাকথিত ‘প্যান্ডোড়া’র বাক্স খুলে দেবার অপপ্রচারের মধ্য দিয়ে, পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের সমাজতন্ত্রের সকল ইতিহাস মুছে ফেলার প্রয়াস সবকিছুর মধ্য দিয়েই অক্টোবর বিপ্লবের মহিমা অম্লান রয়েছে। প্রায়শই এটা প্রমাণ করার চেষ্টা চলে যে, অক্টোবর বিপ্লব হলো জনসমর্থনহীন অবৈধ বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে একটি সামরিক ক্যু দে তা। এ সকল অপপ্রচারের কালো পর্দা ভেদ করে শতসূর্যের আলোকে ইতিহাসের এই নবজন্ম রয়েছে দেদীপ্যমান। তবুও মনে হয়, ইতিহাসের নির্মোহ দৃষ্টিতে ফিরে দেখাটাও জরুরি। কারণ এই শিক্ষাটাই, সামনে এগুনোর পথকে প্রশস্ত করবে।
১৯১৭ সালে রাশিয়া দু’টি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যায়। একটি ফেব্রুয়ারি ২৪-২৯ (পুরাতন ক্যালেন্ডার মোতাবেক) যা জারতন্ত্রকে উৎখাত করে এবং অন্যটি অক্টোবর ২৪-২৫ (৬-৭ নভেম্বর, নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী) যা অক্টোবর বা নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নামে অভিহিত। অনেকের ধারণা, ফেব্রুয়ারি বুর্জোয়া বিপ্লবের সময় বলশেভিকদের ভূমিকা ছিল গৌণ। বলশেভিকরা অক্টোবর বিপ্লবের সময়েই শুধু উড়ে এসে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করেছিল। বিভ্রান্তির এই পথ দিয়ে অনেকে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবকে মহিমান্বিত করতে চায়। ভুলের নিরসনের তাগিদে আর উপলব্ধির পরিপূর্ণতার জন্য নতুন প্রজন্মের সামনে তাই ইতিহাসের সময় রেখার (time line) বিচারে এই বিপ্লবী ঘটনার সংক্ষিপ্ত পরম্পরার উল্লেখ বোধহয় খুবই প্রাসঙ্গিক।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই, বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তাদের বাজার ভাগ বাটোয়ারার লড়াইএর মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে (যা শেষ হয় ১১ নভেম্বর, ১৯১৮, এই যুদ্ধে প্রায় ৯০ লক্ষ সৈন্য এবং ৭০ লক্ষ বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়।)। একদিকে বৃটেন-ফ্রান্স-ইতালি-জাপান-রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র-বেলজিয়াম-পর্তুগাল-রোমানিয়া প্রভৃতি দেশ, অন্যদিকে জার্মানী, অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশ । রাশিয়ার পুঁজিবাদ ইউরোপের অন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মত শক্তিশালী না হলেও, জার দ্বিতীয় নিকোলাস এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের তিন বছরের মধ্যে ১৯১৭ সালে জানুয়ারিতেই রিগা ফ্রন্ট ব্যতিত সকল ফ্রন্টেই রাশিয়ার সেনাবাহিনীর জার্মান আক্রমনের সামনে চরম বিপর্যয়ের মধ্য পড়ে, ফলে ব্যাপক পরাজয় ঘটে। প্রায় ১৫ লক্ষ সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে। দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষককে যুদ্ধে ঠেলে দেওয়া হয়। তাদের পরিবার অনাহারে, অর্ধাহারে থাকে। কুলাকরা (জমিদার) কৃষকদেরকে তাদের জমি থেকে বিতারিত করে। ১৯১৭ সালে জানুয়ারিতে গোটা রাশিয়া জুড়ে চলে এক ভয়াবহ অবক্ষয় আর ধ্বংস। সংখ্যালঘু জাতিস্বত্তা যেমন ইহুদিদের উপর শুরু হয় চরম নিপীড়ন।
সার্বিক এই প্রেক্ষাপটে, ৯ ই জানুয়ারি, বলশেভিক পার্টির পক্ষ থেকে ‘রক্তাক্ত রবিবার’ (যা ১৯০৫ সালে ঘটেছিল) দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যুদ্ধের বিরোধীতা করার ফলে, বলশেভিক পার্টির মূল নেতৃত্ব ছিল তখন হয় জেলে, সাইবেরিয়ায় না হয় বিদেশে নির্বাসিত। বলশেভিক তৃণমূল নেতৃত্বের পক্ষ থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। মস্কোতে ৫০ হাজার এবং পেত্রোগ্রাদে প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিক এই ধর্মঘট ও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া বাকু, নিঝনি নভগোরদ, ভরোনেজ, খারকভ, দন এর রস্তভ ও দনবাস এলাকায়ও একদিনের ধর্মঘট পালিত হয়। কার্যতঃ গোটা রাশিয়া সেদিন স্তব্ধ হয়ে যায়।
৩১ জানুয়ারি, পেত্রোগ্রাদে খাবারের দাবীতে ক্ষুধার্ত নারীশ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে। তারা অধিকাংশই ছিল রণাঙ্গনে যুদ্ধরত সৈনিকদের স্ত্রী। এই তীব্র শীতের মধ্যেই খাদ্য গুদাম ভেঙ্গে তারা খাবার নিয়ে যায়।
১০ ফেব্রুয়ারি ঘটমান অবস্থার প্রেক্ষিতে স্টেট কাউন্সিলের পক্ষ থেকে জারকে ডুমার শক্তি বৃদ্ধি করে পরিস্থিতি সামাল দেবার পরামর্শ দেওয়া হয়। জার তা অগ্রাহ্য করে।
বলশেভিকদের ডাকা ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি মেনশেভিকরাও ডুমার সমর্থনে ধর্মঘট ডাকে। প্রায় ৯০ হাজার শ্রমিক ধর্মঘটে চলে যায়। পুলিশ ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করে শ্রমিকদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়। বলশেভিক পেত্রোগ্রাদ কমিটি জারকে উৎখাতের ডাক দেয়।
২২ ফেব্রুয়ারি, জার দ্বিতীয় নিকোলাস মোগিলেভে সেনাসদর দফতরে চলে যায়।
২৩ ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে – বস্ত্রশিল্পের নারী শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে। তারা অধিকাংশই ছিল রণাঙ্গনে যুদ্ধরত সৈনিকদের স্ত্রী। নিজেদের ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে পেত্রগ্রাদে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিক রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে যোগদান করে। তাদের প্রধান দাবী ছিল, ‘যুদ্ধ বন্ধ কর’, ‘খাবার চাই’। বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা নারী শ্রমিকদের নেতৃত্বে সংঘটিত এই লড়াকু বিক্ষোভকে ‘খাদ্য দাংগা’ আখ্যা দেয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি, শ্রমিক ধর্মঘট দ্বিগুণ চেহারা নেয়। ২ লক্ষাধিক শ্রমিক ব্যাপক বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। পেত্রোগ্রাদের অর্ধেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ধর্মঘটি শ্রমিকরা যুদ্ধ শেষ করার এবং স্বৈরাচারি শাসকের ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী তোলে। তারা সৈনিক ও কশাকদের সংগে একাত্মতা ঘোষণা করে, কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
২৫ ফেব্রুয়ারি ভিবর্গের বলশেভিক শ্রমিকরা পুলিশ ষ্টেশন আক্রমণ করে। সরকারি টেলিফোন কেটে দেয়। পেত্রোগ্রাদের ‘কমান্ডার ইন চিফ’ জারের নির্দেশে সকল বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবার হুমকি দেয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ব্যাপক ধর-পাকড় চালায়। বলশেভিক নেতাসহ প্রায় শতাধিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। জারের আদেশে পুলিশ গুলি চালায়। ১৬৯ জন শ্রমিক নিহত হয়, প্রায় এক হাজার শ্রমিক আহত হয়। বিকাল ৪ টায় ৪র্থ পাভলভস্কি রেজিমেন্ট বিক্ষোভরত শ্রমিকদের উপর আবার গুলি চালায়। সেনাবাহিনী আরো এগিয়ে গেলে, পুলিশদের একটি গ্যারিসন তাদের বাধা দেয়। সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। জেনারেল খাবলভ ঐ পুলিশদের নিরস্ত্র করার আদেশ দেয়। সৈনিকরা সে আদেশ অমান্য করে এবং বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে হাত মেলায়। ভিবর্গের বলশেভিক শ্রমিকরা সশস্ত্র অভ্যূত্থানের ডাক দেয় এবং শুরু করে। বলশেভিক প্রচারকারীরা ভালনস্কি বাহিনীর মধ্যে প্রচারণা চালায়। যে সৈন্যরা আগেরদিন শ্রমিকদের উপর গুলি চালিয়েছিল সেই সৈন্যরা তাদের কমান্ডারকে হত্যা করে অভ্যূত্থানকারী শ্রমিকদের পক্ষ নেয়। বিকালের দিকেই লিতভস্কি ও প্রিয়ব্রাঝেনস্কি রেজিমেন্ট বিদ্রোহি সৈনিকদের সংগে যোগ দেয়। তখন তাদের কাছে প্রায় ৪০ হাজার রাইফেল। সশস্ত্র বাহিনী ক্রেটি জেল থেকে রাজনৈতিক নেতাদের মুক্ত করার জন্য রওয়ানা হয়।
২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মধ্যেই পেত্রোগ্রাদ গেরিসনের ৬৬ হাজার সৈনিক সশস্ত্র অবস্থায় বিদ্রোহে যোগ দেয়। বলশেভিকরা নতুন সরকার গঠনের জন্য অব্যাহত চাপ ও দাবি করে যায়। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত টোবিডা রাজপ্রাসাদে দখল নেয় ও ‘কার্যনির্বাহী কমিটি’ গঠন করে। বলশেভিকরা বিপ্লবী অভ্যূত্থানে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেয়। সোভিয়েতগুলোতে মেনশেভিকরা ও সোশালিষ্ট রেভোলিউশনিষ্টরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারা এ বিপ্লবকে বুর্জোয়া বিপ্লব হিসেবে মেনে নিয়ে সমাজতন্ত্রের দাবীকে অনির্দিষ্টকালের হাতে ছেড়ে দেয়। সোভিয়েতে তারা নেতৃত্ব নেয়। ইতিমধ্যে পুরনো সরকারের প্রতিনিধিরা অবস্থা সামাল দেবার জন্য জারকে প্রধানমন্ত্রীর সংগে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দেয়। জার তা প্রত্যাখ্যান করে।
২৮ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবী জনতা মস্কো শহর দখল করে। জারের মন্ত্রীরা গ্রেফতার হয়। ‘সাময়িক কমিটি’ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
২ মার্চ, জার দ্বিতীয় নিকোলাস তার ভাই মিখাইলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু তার ভাই ক্ষমতা নিতে অস্বীকার করে। জারতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটে। গঠিত হয় ‘সাময়িক সরকার’। সশস্ত্র শ্রমিক, সৈনিক যুবকরা রাস্তা দখল করে – জারতন্ত্রের সকল চিহ্ন মুছে ফেলে। পুলিশরা অনেকক্ষেত্রে বিক্ষুব্ধ জনতার উপর গুলি ছোঁড়ে, কিন্তু সশস্ত্র সোভিয়েত সৈন্যরা তাদের প্রতিরোধ করে- অনেকের মৃত্যু হয়। ৩ মার্চ, পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত কার্যনির্বাহী কমিটি জারকে গ্রেফতারের আদেশ দেয়।
৫ মার্চ, প্রাভদা প্রথম সংখ্যা বের হয়। যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান রাখায় প্রাভদা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ৬ মার্চ, সাময়িক সরকার সকল রাজনৈতিক বন্ধীদের মুক্তির ঘোষণা দেয়।
৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম সাময়িক সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।
১২ মার্চ স্তালিন কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পেত্রোগ্রাদে ফেরেন এবং প্রাভদার সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হন। ১৮ মার্চ তিনি পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের কার্যনির্বাহি কমিটির সদস্য হন।
১৪ মার্চ পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত সমগ্র পৃথিবীর কাছে বিশ্বযুদ্ধ বন্ধ করে শান্তির জন্য আহবান রাখে।
১৯ মার্চ সাময়িক সরকার খাদ্য সংকট মোকাবিলায় নতুন কৃষি আইন পাশ করতে ব্যর্থ হয়। বরং অভুক্ত মানুষের খাদ্য গুদাম লুট বা জোর করে জমি দখল বেআইনি ঘোষণা করে। আসলে সাময়িক সরকার রাশিয়ার বিপ্লবী শ্রমিক-কৃষক- সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা থেকে সরে আসে।
২১-২২ মার্চ লেনিনের ‘বিদেশ থেকে চিঠি’ প্রকাশিত হয়। ২৭ মার্চ ট্রটস্কি আমেরিকা থেকে রাশিয়ার পথে রওয়ানা হন। ৩১ মার্চ প্লেখানভ ৪০ বছর পর দেশে ফেরেন। কিন্তু তিনি আর সেই প্লেখানভ নন। তিনি যুদ্ধকে সমর্থন করেন এবং রাশিয়ার পুঁজিবাদের বিকাশের পক্ষে দাঁড়ান। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাঁর কাছে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের বিষয়।
৩ এপ্রিল লেনিন, জিনোভিয়েভ এবং অন্যান্য বলশেভিক নেতারা সুইজারল্যান্ড থেকে দেশে ফেরেন।
৪ এপ্রিল লেনিন তার বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’ প্রকাশ করেন।
১২ এপ্রিল সাময়িক সরকার সকল সভা সমিতি ও ইউনিয়ন করার পক্ষে আইন পাশ করে।
১৮ এপ্রিল মে দিবস পালিত হয়। গোটা রাশিয়ার শ্রমিকরা মে দিবসে রাস্তায় নেমে আসে। অন্যদিকে, সাময়িক সরকারের বিদেশমন্ত্রী মিলিউকভ গোপনে আঁতাত শক্তির কাছে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার অঙ্গিকার করে। বিদেশ মন্ত্রীর এই নোট ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিক্ষুব্ধ সৈনিকরা দু’দিন ধরে রাস্তায় বিক্ষোভ দেখায়। বলশেভিকরা শুধু মিলিউকভের পদত্যাগ নয়, নতুন সোভিয়েত সরকার গঠনের দাবী তোলে।
১ মে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত নতুন কোয়ালিশন সরকার গঠনের পক্ষে ভোট দেয়। বলশেভিকরা এই কোয়ালিশন সরকারের বিরোধিতা করে। লেনিন দ্বৈত শাসনের বিপদের কথা উল্লেখ করেন। মিলিউকভ পদত্যাগ করে।
৩১ মে যুদ্ধমন্ত্রী গুচকভ পদত্যাগ করলে কেরেনস্কি তার স্থলাভিষিক্ত হয়।
৩ জুন পেত্রোগ্রাদে প্রথম সর্বরাশিয়ান সোভিয়েত কংগ্রেস শুরু হয়। কংগ্রেস প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পক্ষে মত দেয়। তবে, বলশেভিক পার্টির বিরোধিতা সত্বেও শর্তাধীনে সাময়িক সরকারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত হয়। বলশেভিকরা সকল ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে দেবার দাবি তোলে।
১০ জুন বলশেভিকরা সরকারবিরোধী শ্রমিক বিক্ষোভের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মেনশেভিকরা তার বিরোধিতা করে। কারখানায় কারখানায় তারা শ্রমিকদের এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়। সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে তখন বলশেভিকদের বিপুল সমর্থন। তারা কশাকদেরকেও বলশেভিকদের বিপক্ষে প্ররোচনা দেয়। কিন্তু কশাকরাও সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে। ১১ জুনও মেনশেভিকরা বলশেভিকদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। তাদেরকে জার্মানির চর হিসেবে গ্রেফতারের দাবি তোলে। কিন্তু দিনের পর দিন বিতর্কের পর মেনশেভিকরা শ্রমিকদের অস্ত্র ত্যাগের দাবী থেকে সরে আসে এবং ১৮ জুন বিক্ষোভের পক্ষে মত দেয়। সোভিয়েত এ প্রস্তাব পাশ করে।
১৮ জুন কেরেনস্কি পূর্ব ফ্রন্টে নতুন করে আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু, অপ্রতুল সরবরাহ আর মনোবলের অভাবে জার্মান প্রতি আক্রমনের মুখে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর প্রভূত ক্ষতি হয়। প্রায় দেড় লক্ষ সৈন্য নিহত হয় এবং আড়াই লক্ষ সৈন্য আহত হয়। বলশেভিকরা শান্তির জন্য এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রায় ৪ লক্ষ শ্রমিক-সৈনিকের বিক্ষোভ সংগঠিত করে। পেত্রোগ্রাদ, মস্কো,কিয়েভ, খারকভ, একাতারিনেস্লাভ এবং অন্যান্য শহরেও হাজার হাজার শ্রমিক জনতা বলশেভিক পার্টির শ্লোগান ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভ করে। আসলে যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির দাবি এবং সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতার দাবি তখন গোটা রাশিয়ার মানুষের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
২১ জুন, ১৮ জুনের বিক্ষোভের পর পুতিলভ কারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘটে চলে যায়। বলশেভিকরা তাদের সমর্থন করে।
২৩ জুন, সাময়িক সরকার পেত্রোগ্রাদের বহু কারখানা বন্ধ করে দেবার ষড়যন্ত্র করে। বলশেভিক পত্রিকা ‘ইজভেস্তিয়া’ তা ফাঁস করে দেয়। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মহীন হবার আশংকায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
১ জুলাই দ্বিতীয় মেশিনগান রেজিমেন্ট ‘সকল ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে’ দাবী তোলে। ৩য় ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন রণাঙ্গনে যেতে অস্বীকার করে। সশস্ত্র সৈনিকরা শ্রমিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। পেত্রোগ্রাদ বিস্ফোরণ্মুখ হয়ে ওঠে। এনার্কিস্টরা শ্রমিক-সৈনিকদের অভ্যূত্থানের উস্কানি দেয়। বলশেভিকরা তাদের শান্ত করার চেষ্টা করে।
৩ জুলাই, বলশেভিকরা কৌশল পাল্টায়। তারা সৈনিক শ্রমিক দের দাবী সমর্থন করে, তবে অধিকাংশ সোভিয়েতের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে বলে। কৌশল ফলপ্রসু হয়। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতে মেনশেভিকদের পরিবর্তে বলশেভিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের উপর বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রন আসে।
৪ জুলাই, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আবার সমবেত হয়। সরকার পুরো রেজিমেন্ট সৈন্য জমায়েত করে। কিন্তু তারা শ্রমিকদের সামনে আসেনা। লেনিন শ্রমিকদের সমাবেশে বক্তৃতা করেন এবং তাদের ‘সকল ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে’ দাবীকে সমর্থন করেন ও তাদেরকে উৎসাহিত করেন। সরকার রণাঙ্গন থেকে আসা কিছু সৈন্যদের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে গুলির আদেশ দেয়। গুলিতে প্রায় ৪ শ শ্রমিক নিহত হয়।
৫ জুলাই, সরকার প্রাভদা অফিস ভেঙ্গে দেয় ও বন্ধ করে দেয়। বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রিয় অফিস ও পেত্রোগ্রাদ অফিস তছনছ করে দেওয়া হয়। সরকার বলশেভিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমনে নামে।
৭ জুলাই, সরকার লেনিনকে জার্মান গুপ্তচর ঘোষণা করে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয় এবং বলশেভিকদের বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান প্রচেষ্টার অভিযোগ আনে।
৮ জুলাই কেরেনস্কি লভভের স্থলে সরকার প্রধান হয়। সাময়িক সরকার ১৭ সেপ্টেম্বর সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করে। শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। কোন দাবিই মানা হয়নি।
১১ জুলাই, লেনিন আত্মগোপনে চলে যান।
১৮ জুলাই জেনারেল কর্নিলভ প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হয়।
২৪ জুলাই দ্বিতীয় ‘কোয়ালিশন সরকার’ গঠিত হয়। কেরেনস্কি নিজেকে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন।
২৬-৩ আগষ্ট, বলশেভিক পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ২ লক্ষ ৪০ হাজার পার্টি সদস্যের প্রতিনিধিরা কংগ্রেসে যোগদান করে। লেনিন আত্মগোপনে থাকায় স্তালিন কেন্দ্রীয় কমিটির রিপোর্ট উত্থাপন করেন। কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নেয়-শান্তিপূর্ণ বিপ্লব সম্ভব নয়। পার্টি ‘গনতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র নীতি গ্রহণ করে।
আগষ্ট মাস- থেকে মার্চ এ পর্যন্ত ৫৬৮ টি কারখানা বন্ধ হয়। মুদ্রাস্ফীতি ১৩ সালের তুলনায় ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ বেড়ে যায়। প্রায় ৪৪০ টি জায়গায় বিক্ষুব্ধ কৃষকরা জোতদারদের কাছ থেকে জমি দখল করে। সাময়িক সরকারের পক্ষে এই অসংখ্য বিদ্রোহ বিক্ষোভ দমন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
১৪ আগষ্ট, কর্নিলভ সামরিক শাসনের প্রস্তাব করে। সাময়িক সরকার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
১৯ আগস্ট, কর্নিলভ পেত্রোগ্রাদে তার সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব করে। কেরেনস্কি অস্বীকার করে।
২১ আগষ্ট, রিগা ফ্রন্ট অরক্ষিত রেখে কর্নিলভ পেত্রোগ্রাদে বলশেভিকদের দমনের জন্য সৈন্য পাঠানোর গোপন পরিকল্পনা করে এবং তার ৪ হাজার অনুগত অফিসারকে বলশেভিকদের দেখা মাত্র খুনের আদেশ দেয়। কেরেনস্কি তা সমর্থন করে।
২২-২৭ আগষ্ট, কেরেনস্কি পেত্রোগ্রাদে সৈন্য পাঠানোর জন্যে কর্নিলভকে নির্দেশ দেয়। কর্নিলভ সৈন্য পাঠানোর অংগীকার করলেও তারা ক্ষমতার দ্বন্দে নিয়োজিত হয়। কেরেনস্কি কর্নিলভকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলে কর্নিলভ প্রকাশ্যে সাময়িক সরকারকে ‘জার্মান চর’ আখ্যা দেয়। উত্তেজনা চরমে ওঠে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বলশেভিকরা আত্মরক্ষার জন্য শ্রমিকদের সশস্ত্র করে তোলে। দেশের পুঁজিপতিরা কর্নিলভকে সমর্থন করায় কেরেনস্কি তার আদেশ প্রত্যাহার করে। এই খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় শ্রমিক-সৈনিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বৃটিশ মিলিটারি মিশন কর্নিলভকে প্রকাশ্যেই সমর্থন করে। এদিকে, বলশেভিকদের নেতৃত্বে সাধারণ শ্রমিক এবং সৈনিকরা অনেকেই কর্নিলভের বাহিনী যাতে পেত্রোগ্রাদে প্রবেশ করতে না পারে তার পরিকল্পনা করে। রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, ডাক বিভাগের শ্রমিকরা পরিকল্পনা করে সৈন্যবাহী ট্রেন শহরের বাইরে নিয়ে যায়। শ্রমিক আর বলশেভিকদের প্রচার কর্মীরা সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে বাস্তব ঘটনার ব্যাপক প্রচার চালায়। সৈনিকরা শ্রমিকদের সংগে একমত হয় এবং তাদের কমান্ডারদের গ্রেফতার করে। ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়।
২৯ আগষ্ট, ইতিমধ্যে শ্রমিকরা প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিককে সশস্ত্র করে তোলে। হাজার হাজার সাধারণ শ্রমিক পেত্রোগ্রাদ রক্ষায় এগিয়ে আসে।
৩০ আগষ্ট সোভিয়েত ঘোষণা করে যে, কর্নিলভকে পরাজিত করা হয়েছে।
১ সেপ্টেম্বর, কেন্দ্রীয় সোভিয়েত কার্যনির্বাহী কমিটিতে বলশেভিকদের সমর্থন বাড়তে থাকে। পেত্রোগ্রাদ সহ চারটি বড় বড় সোভিয়েতে বলশেভিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। সরকার কর্নিলভকে গ্রেফতার করে।
৪ সেপ্টেম্বর, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের চাপে সরকার ট্রটস্কি সহ বলশেভিক নেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
৫ সেপ্টেম্বর, মস্কো সোভিয়েত, সোভিয়েত সরকার গঠণের পক্ষে মত দেয়।
৮ সেপ্টেম্বর, বাল্টিক নৌবাহিনীর নাবিকরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং ‘সকল ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে’ শ্লোগান তোলে।
৯ সেপ্টেম্বর, মেনশেভিক এবং সোশালিষ্ট রিভউলিষ্টরা সোভিয়েতে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নিয়ন্ত্রন রক্ষার চেষ্টা চালায় কিন্তু ব্যর্থ হয়।
১২ সেপ্টেম্বর, লেনিন তার ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বই সমাপ্ত করেন।
২৫ সেপ্টেম্বর, কোয়ালিশন সরকারের তৃতীয় ও শেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এদিনই ট্রটস্কি পেত্রগ্রাদ সোভিয়েতের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১০ অক্টোবর, বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি অনেক বিতর্কের পর লেনিনের প্রস্তাবিত কৌশল গ্রহন করে এবং সাময়িক সরকার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ তার প্রবল বিরোধিতা করেন। এমনকি, ১৮ অক্টোবর মেনশেভিকদের পত্রিকায় তা প্রকাশ করে দেন। লেনিন তাদেরকে পার্টি থেকে বহিষ্কারের প্রস্তাব করেন।
১২ অক্টোবর, পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত ‘বিপ্লবী সামরিক কমিটি’ গঠন করে, যা অভ্যূত্থানে নেতৃত্ব দেবে।
২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বলশেভিকরা সারা দেশে ব্যাপক প্রচারনা চালায় সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতার দাবীতে। এ সকল সভায় লক্ষ লক্ষ শ্রমিক জনতা সামিল হয়। দেশব্যাপী অভ্যূত্থানের রাজনৈতিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
২৪ অক্টোবর, সাময়িক সরকার বলশেভিক পার্টির হেড কোয়ার্টার ‘স্মলনি’ দখলের অভিযান চালায়।
‘অক্টোবর বিপ্লব শুরু হয়’। রাতের মধ্যে ট্রটস্কির নেতৃত্বে রেড গার্ড ও সোভিয়েত শ্রমিকদের সশস্ত্র বাহিনী শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়ন্ত্রনে নেয়। লেনিন স্মলনিতে উপস্থিত হয়ে সরাসরি অভ্যূত্থানের নেতৃত্ব নেন।
২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় দ্বিতীয় সর্ব রাশিয়া সোভিয়েত কংগ্রেস শুরু হয়। লেনিন কংগ্রেসকে বলেন, ‘এই রইল সোভিয়েতে হাতে ক্ষমতা’। হতাশ মেনশেভিকরা হলত্যাগ করে এবং বিপ্লবও ত্যাগ করে।
২৬ অক্টোবর শীতপ্রাসাদ দখলের মধ্য দিয়ে বিপ্লব সম্পন্ন হয়। একটি গুলিও চলেনি, একটি লোকও মারা যায়নি। লেনিনের নেতৃত্বে সরকার গঠণের মধ্য দিয়ে শুরু নতুন যাত্রা। সেটা আরেক ইতিহাস।
(৩) অক্টোবর বিপ্লব-শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি ও জনগণের বিকল্প শক্তির ভাবনা
এই আলোচনায় অক্টোবর বিপ্লবের ঘটনাবলির দীর্ঘ হলেও কিছুটা অনুপুঙ্খ পরম্পরা বা সময় রেখা তুলে ধরা হলো বিকল্প রাষ্ট্র ভাবনা এবং বিপ্লবী পার্টির ভূমিকার চিত্রটাকে বাস্তবতার নিরিখে বুঝে নেবার জন্য। অক্টোবর বিপ্লবের ঘটনাবলি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণাকে। প্যারী কমিউনের সংক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতা ভিন্ন অক্টোবর বিপ্লবের আগে মানুষের ধারণা ছিল না শ্রমিক-কৃষকের বিপ্লবী শক্তি কিভাবে পূর্ববর্তী শাসক রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপরীতে নিজস্ব রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তোলে। পুরোনো রাষ্ট্রযন্ত্রকে দখল করে তা দিয়ে বিপ্লব হয় না- তাকে ভেংগে ফেলতে হয়। আবার পুরনো সেই রাষ্ট্রযন্ত্র ভেংগে ফেললেই চলে না –তার শূন্যস্থান পূরণে বিপ্লবী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নিজস্ব বিকল্প শক্তি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। এই বিপ্লব মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের রাষ্ট্র ভাবনার এক প্রত্যক্ষ ও বিপ্লবী প্রয়োগ। প্রায় নয় মাসের ঘটনাবলি নিরংকুশভাবে স্পষ্ট করে তুলেছে যা, তত্বগতভাবে, যে ভাবনায় সমাজবিকাশের ধারায় শ্রমজীবি মানুষের নিজস্ব শক্তি ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার বিষয়টি আসে, অক্টোবর বিপ্লব তার হাতে কলমে প্রয়োগ। এই প্রয়োগে ভুলত্রুটি হয়নি তা বলা যাবে না, বলা উচিত নয়। কারণ একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া পরিশীলিত হয় তার প্রয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের ধারণা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তার অবসান দ্রুত হবে তা মনে করার কারণ নেই। সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিলুপ্তির পর এ প্রশ্ন আরো জোরালোভাবে উঠেছে। বিপ্লব এবং বিপ্লব পরবর্তি বিনির্মান প্রক্রিয়ায় যে তাত্বিক বা প্রায়োগিক ভুল হয়েছে, তার তাত্বিক বা ব্যবহারিক বিচার হতেই পারে – হবেও। কিন্তু এই তাত্বিক বিতর্ক শেষ কথা নয়, শেষ উত্তর তার সফল প্রয়োগ। অক্টোবর বিপ্লবের মত মহিমান্বিত বিপ্লবের অনুপুঙ্খ বিচারের মধ্য দিয়েই এই বিষয়ের চিন্তা ভাবনাকে সঠিক ধারায় প্রবাহিত করা সম্ভব। অক্টোবর বিপ্লব হলো শোষক রাষ্ট্রযন্ত্রকে গুঁড়িয়ে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকের নিজস্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার জীবন্ত চালচিত্র। অক্টোবর বিপ্লব বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আবর্জনা ও অন্তঃসারশূণ্যতা প্রমানের সফল এক মঞ্চনাট্য। অক্টোবর বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়ে দেয় – শাসক ও শোষকশ্রেনীর প্রতিক্রিয়া এবং প্রত্যাঘাত কতটা তীব্র হতে পারে। তাদের নিজস্ব শ্রেণীস্বার্থে জনগণের বিপ্লবকে ধ্বংস করে দেবার জন্য তাদের উৎকট প্রয়াস কি হতে পারে-তা অক্টোবর বিপ্লবের সময়কাল ও বিপ্লব পরবর্তি গৃহযুদ্ধের কাল হাতে ধরে শিখিয়ে দেয়।
অনেকে অক্টোবর বিপ্লবকে মার্ক্সবাদের ধ্রুপদী তত্বের বিরোধী ঘটনা হিসেবে দেখে, মার্কসবাদের ভ্রান্তি খোঁজেন। পুঁজিবাদের পর সমাজতন্ত্র অবশ্যম্ভাবী মার্কসের এই সিদ্ধান্তের সংগে এই ঘটনাকে বিরোধার্থক হিসেবে চিহ্নিত করতে চান। তাছাড়া অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশে বিপ্লব না হয়ে অধিকতর পশ্চাদপদ একটি দেশে বিপ্লব হতে পারে কি না – এ তাত্বিক প্রশ্ন ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর, এ প্রশ্নকে আরো জোড়ালোভাবে আনা হয় যে, একটিমাত্র দেশে সংঘটিত বিপ্লব স্থায়ী হতে পারে কি না। যে কোন বিপ্লবী যোদ্ধার মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা হলো- বিপ্লব সংঘটিত হয় সমাজের মধ্যেকার শ্রেণীদ্বন্দ বিকাশের প্রক্রিয়ায় এবং বিপ্লব সংহত করার প্রক্রিয়াও আয়ত্ব করতে হয় তার ব্যবহারিক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। ইতিহাস সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগেও অনেক বিপ্লব দেখেছে। যারা প্রশ্নটা বেশি করে তোলে সেই বুর্জোয়া গনতন্ত্রের বা পুঁজিবাদের সমর্থকরা যাদের কাছে বুর্জোয়া ফরাসী বিপ্লব হলো বিপ্লবের আদর্শ- তারাও জানেন ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শক্তিও সরলরেখায় এগিয়ে যায়নি। ইতিহাসের নানা ঘটনা আর ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তা এগিয়েছে। ধনতন্ত্রের বিকাশের পথও সরলরৈখিক নয়। অক্টোবর বিপ্লবই মানবজাতিকে প্রথম দেখিয়েছে যে শ্রমজীবি মানুষ কিভাবে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তার অধিকার অর্জন করতে পারে নিজস্ব রাষ্ট্রশক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। অক্টোবর বিপ্লবের শিক্ষাতেই মানবজাতি নতুন করে, নতুন পৃথিবী ও সভ্যতা গড়ে তোলার বাস্তবতাকে চাক্ষুষ করেছে। শ্রমজীবি মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে- ইতিহাসকে বদলে দেবার শক্তি তার আছে। গত শতাব্দীতে মানব সভ্যতা এ পর্যন্ত যা কিছু ইতিবাচক হিসাবে পেয়েছে তার অনেকটাই অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে উত্থিত চেতনার ফসল।
অক্টোবর বিপ্লবের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ন শিক্ষা হলো- একটি বিপ্লবী পার্টি কি ভাবে বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারে তার শিক্ষা। সমাজের মধ্যে জনগণের মধ্যে একটি বিপ্লবী পার্টি কিভাবে তার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তার জীবন্ত প্রয়োগ অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিক পার্টির ভূমিকা। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি অক্টোবর বিপ্লবের প্রতিটি ঘটনায় যে ভাবে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, বিপ্লবী অভ্যূত্থানমুখী সশস্ত্র শ্রমিক কৃষকের সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তা অভূতপূর্ব। ঘটনার পরম্পরা দেখলে মনে হয় যেন, এ এক পূর্বনির্ধারিত চিত্রনাট্যে মঞ্চনাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্যও বলশেভিক পার্টি বিপ্লবী এই অভ্যূত্থানের পিছনেও পড়েনি আবার বেশী সামনে গিয়ে অতিবাম বালখিল্যতা দেখায়নি। একটি বিপ্লবী পার্টি কি এবং কিভাবে তা গড়ে ওঠে- অক্টোবর বিপ্লব সেই শিক্ষার জীবন্ত প্রয়োগ। প্রতিটি দেশেই জনগণের নিজস্ব বৈশিষ্টকে ধারণ করে জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা জীবন্তভাবে সম্পৃক্ত একটি পার্টি ছাড়া বিপ্লব সফল হয় না। আর একটি বিষয় না বললেই নয় তাহলো- পার্টি আর রাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়টি। বলশেভিক পার্টি যখন শ্লোগান তোলে, ‘সকল ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে’ তখনই এই দ্বান্দিক রূপটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পার্টির হাতে ক্ষমতা নয়, জনগণের নিজস্ব বিকল্প শক্তির হাতে ক্ষমতা। জনগণের বিপ্লবী ক্ষমতায়নের বাস্তব প্রয়োগ অক্টোবর বিপ্লবের সর্বপ্রধান শিক্ষার একটি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্বিক প্রশ্নেও এ এক নির্ধারক মীমাংসা।
(৫) উপসংহার
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি অক্টোবর বিপ্লবের অপরিহার্যতাকে ভুল প্রমাণ করে না। অনেক পশ্চিমা পন্ডিতরা বলতে চান, অক্টোবর বিপ্লব না হয়ে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবেই থেমে থাকা উচিত ছিল-তাতে পুঁজিবাদের বিকাশের পথ প্রশস্ত হতো। অনেক মেনশেভিক নেতাও তাই বলেছিলেন। শুধু তাই নয় অক্টোবর বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবের শক্তি যখন পশ্চিমা আঁতাত শক্তির প্রত্যক্ষ সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তায় গৃহযুদ্ধ শুরু করে, তখন অনেক নেতৃত্বও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের গৃহযুদ্ধের শেষে ১৯২২ সালে বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লব সংহত হয়-শুরু হয় লেনিনের প্রস্তাবনায় ‘নয়া অর্থনৈতিক কৌশলে’র যাত্রা। কিন্তু, পশ্চিমা ধনিকশ্রেণীর ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি, থাকেনি তাদের অর্থনৈতিক অবরোধের কঠিন আক্রমণ। সোভিয়েত জনগণকে লড়াই করতে হয়েছে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে। ভুল করে, ঠিক করে তারা এগিয়েছে। ইতিহাসের প্রথম অভিজ্ঞতার ফলে, পার্টির নীতি কর্মকৌশলেও ভুল হয়েছে, বাড়াবাড়ি হয়েছে-সেটাও সত্য। কিন্তু এই অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টির কাজ থেমে থাকেনি। বিপ্লবের পঁচাত্তর বছর পর কেন ইতিহাসের এই পশ্চাদপসরণ, তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে হবে, ভুলগুলো নির্দিষ্ট করতে হবে- কারণ ভবিষ্যতের যাত্রাপথে বিপ্লব অনিবার্য-তাতে সেই ভুলের শিক্ষার প্রয়োজন পড়বে। ইতিহাসের গতিপথে এ রকম ঘটনা নতুন নয়। আগেই বলা হয়েছে, অতীতের সকল বিপ্লবের পথেই এই আঁকবাঁক ছিল। ইতিহাস সরল পথে চলে না। শেষ পর্যন্ত তা এগিয়েই চলে, প্রতিক্রিয়া ব্যর্থ হয়। অক্টোবর বিপ্লব ইতিহাসের দায় পালন করেছে, মানব সভ্যতায় নবদিগন্তের সূচনা করেছে -তার অভিঘাত কোনকালেই শেষ হবে না। শ্রমজীবি মানুষের সেই মহিমান্বিত লড়াই যুগে যুগে সৃষ্টি করবে নতুন সংগ্রামের দিক নির্দেশনা। অক্টোবর বিপ্লবের মৃত্যু নেই। অক্টোবর বিপ্লব ইতিহাসের অনিবার্যতা।
২৬ মে, ২০১৭