আমার একজন ছাত্র ড. এনামুল হক, যিনি এখন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি দক্ষিণ এশিয়ার করোনা সংক্রমনের গতি প্রকৃতি নিয়ে একটি গাণিতিক মডেলের ফলাফল প্রকাশ করেছেন। আমি আশাবাদী এটা তিনি গবেষণা জার্নালেও পাঠাবেন। আমি অন্ততঃ তাঁকে সেই পরামর্শ দিয়েছি। তিনি যথারীতি আমাকে লিংক পাঠিয়েছেন, ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকরা কি কাজ করেছেন তার। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশগুলিতেই উপাত্ত যথেষ্ট নয়। ফলে, গাণিতিক মডেল তৈরী শুধু কঠিন নয়, ত্রুটিমুক্ত হওয়াও কঠিন। আমি তাঁর দেওয়া ভবিষ্যত নির্দেশনা নিয়ে পরে বলবো। তাঁর আগে এর পিছনের কিছু কথা বলাটা প্রাসংগিক মনে করছি। অনেকেই জানেন, শাবিপ্রবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নয় শুধু বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে। এই বিভাগটি নিজে হাতে গড়েছিলেন, বাংলাদেশের তথা পৃথিবীর স্বনামধন্য একজন পদার্থবিদ বিজ্ঞানী এমিরিটাস প্রফেসর ড. অরুন কুমার বসাক। এখনো তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এমিরিটাস প্রফেসর। তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ছিলেন, প্রফেসর ড. ছদরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। আমার সৌভাগ্য, এই দু’জন প্রথিতযশা মানুষ আমার সরাসরি শিক্ষক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পিছনে তাঁদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। পিছনের কথা এজন্যে বললাম, এদের মত লোক ছিল বলেই শাবিপ্রবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ আজ এই পর্যন্ত আসতে পেরেছে। এই প্রসংগে আর একটি কথা বলতে হয়, যে ল্যাব থেকে এই গাণিতিকি মডেল তৈরি হয়েছে, তাঁর পিছনে একটা গল্প আছে। ড ইয়াসমিন হক, যিনি বিশ্বব্যাংকের অনুদানে দেওয়া অর্থে, ক্যান্সার সনাক্ত করার গবেষণায় অত্যন্ত আশাপ্রদ ফলাফল পেয়েছিলেন, যা এখনো চলছে, তাঁর দু’জন মূল গবেষকের একজন ড. মানস কান্তি বিশ্বাস ও আরেকজন ড. এনামুল হক। তাঁরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগের ছাত্র এবং দু’ জনেই ড. ইয়াসমিন হক ও আমার সংগে পি এইচ ডি সম্পন্ন করেন। তাঁরা নিজেদের শিক্ষকতার পাশাপাশি এখনো ওই ল্যাবেই কাজ করেন। এই ল্যাবের সংগে একটি ‘লেজার ল্যাব’ আছে এবং তাঁর সংগে সংশ্লিষ্ট ‘কম্পিউটেশনাল ল্যাব’। এই লেজার ল্যাব প্রতিষ্ঠার একটি ইতিহাস তা পরে কখনও বলা যাবে। তা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। এই কম্পিউটেশনাল ল্যাবটি প্রতিষ্ঠিত হবার সময়ে প্রথম যারা ছাত্র ছিলেন তাদের একজন ড. এনামুল হক, আরেকজন এনক সমাদ্দার এরা দু’জনে ব্যক্তিগত বন্ধুও বটে, এনকও একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত থেকে এখন যুক্ত্ররাষ্ট্রে পি এইচ ডি করছেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং চ্যান্সেলর পুরস্কার পাওয়া ছাত্র। তখন এই ল্যাবটা গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাকে, কারণ প্রজেক্টটা আমিই দিয়েছিলাম। কোর্স ডিজাইন করার জন্য আমার হাতে দুটো বই ছিল, একটা পাঠিয়েছিল আমাদের আর এক কৃতি ছাত্র অধ্যপক ড. মাসুদুল হক, যিনি আমেরিকার রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি করে, জার্মানী সহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে পোষ্ট ডক করে এখন আয়ারল্যান্ডে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন, আর একটি বই আমি নিজে আমেরিকা থেকে ফেরার সময় কিনে এনেছিলাম। কম্পিউটেশনের জন্য যে সফটওয়্যারটি আমেরিকা থেকে এনেছিলাম, তা যোগাড় করে দিয়েছিল আমার আর দু’জন ছাত্র তখন তারা সেখানে পি এইচ ডি করছে। একজন ড. তারেক আজিজ যিনি বহু বছর আমেরিকায় থেকে পি এইচ ডি করে পোষ্ট ডক করে এখন দেশে ফিরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। তাঁর মত যোগ্যতার একজনকে যে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া উচিত। কেন নেওয়া হয় না আমি জানি না। আর একজন ড. ফকরুল ইসলাম। তিনিও আমাদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম ব্যাচের মেধাবী ছাত্র, যিনি মাস্টার্সে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন, আমেরিকায় পি এইচ ডি করেছেন, এখন সুইডেনে কর্মরত। আমি বিভাগীয় প্রধান থাকার সময়ে তাকে দেশে আনার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার সময়ে কুলায়নি, অবসর নিতে হয়েছে। এরা দু’জনে কৌশলে এই সফটওয়্যারটি যোগাড় করে দিয়েছিলেন। কিন্তু, এই সফটওয়ারটি চালানোর জন্য বাংলাদেশে তখন কেউ ছিলেন কি না আমার জানা ছিল না। রাতের পর রাত জেগে তা আয়ত্ব করেছিলাম, আর আমাদের এই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্ররা তা আমার কাছ থেকে জেনে আয়ত্ব করেছিল। কার্যতঃ আমি নিজেই একজন শিক্ষানবিস ছিলাম, শুধু মনের জোর নিয়েই এই কোর্সটি শুরু করেছিলাম, এবং খুশীর বিষয় আমি যখন এই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করি, তখন এই কোর্সটি কম্পালসারি কোর্সে রূপান্তরিত হয়। তখন যারা সাহায্য করেছিলেন অনেকেই সেখানে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন, তারা এই ল্যাব থেকে মাস্টার্স থিসিস করেছেন। এই ল্যাবের সংগে জড়িত বহু ছাত্র দেশে বিদেশে রয়েছেন, যাদের নাম বলতে পারলাম না স্থানের অভাবে। কয়েকদিন আগে আমাদের কয়েকজন ছাত্র তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে আন্তর্জতিক পুরস্কার পেয়েছে তারাও এই ল্যাবের সংগে জড়িত। এই ল্যাব এখন বাংলাদেশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট ‘কম্পিউটেশনাল ফিজিক্স’ ল্যাবের মধ্যে একটি। এই ল্যাব থেকে আমার ছাত্ররা ( আমি গর্ব করে বলছি। ছাত্রদের নিয়ে আত্মশ্লাঘা দোষের নয়। ) করোনা আক্রমনের দুঃসময়ে যে কাজটি করেছেন তা প্রনিধানযোগ্য। এই মডেল অনুসারে, আমাদের দেশের করোনা সংক্রমনের মাত্রা সর্বাধিক হবে মে মাসের ১ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে। এর প্রকোপ কমে যাবে জুন মাসের ১ম সপ্তাহের মধ্যে। যদি লক ডাউন বা কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই মডেল অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানে করোনা সংক্রমনের মাত্রা বাংলেদেশের থেকে বেশী। এই পর্যবেক্ষণটাকে এদেশের অন্যান্য বিজ্ঞানী ও নীতি নির্ধারকরা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে দেশের করোনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যবহার করার জন্য বিবেচনা করতে পারেন। কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সাতটি দিনও এখন গুরুত্বপূর্ণ। দেশ পরিচালনার জন্যে অন্ধত্ব নয়, বিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া ছাড়া গতি নাই। আমাদের দেশের জৈব রসায়ন ও অনুজীব বিজ্ঞান, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারং, ফার্মেসী, চিকিতসাবিজ্ঞান সহ সকল গবেষণাগারে অনেক ভাল অভিজ্ঞ ও তরুণ গবেষক আছেন, তাদের কাজে লাগাতে হবে এবং তাদেরকেও স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গোটা মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য সকল শুভ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের দেশের প্রতিভাবান মানুষরা কেন পিছিয়ে থাকবেন? আমাদের দেশের কৃষকরা জীবন বাজি রেখে বোরো, ইরি ধান ক্ষেত থেকে ঘরে তুলছেন, শ্রমিকরাও যাবে্ন কারখানায় একটু সুযোগ হলে, কেন বিজ্ঞানীরা পিছিয়ে থাকবেন?