ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বাংলার সংস্কৃতি এবং আর্থ-সামাজিক বিকাশ

Sharing Helps!

(ঈশ্বরচন্দ্রের বিদ্যাসাগরের জন্ম তৎকালীন বাংলার তথা ভারতীয় সমাজের রাজনৈতিক  আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাঃ  

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ( জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০, মৃত্যু ২৯ জুলাই ১৮৯১) দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০। তিনি ছিলেন  উনবিংশ শতকের একজন ক্ষণজন্মা বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও সাহিত্যিক গদ্যকার। তার প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম ও কর্মময় জীবনকালে বাংলা তথা ভারতের যে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক  প্রেক্ষাপট ছিল তা প্রনিধানযোগ্য। ১৭৫৭ সালে পলাশী প্রান্তরে নবাব সিরাজদৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বৃটিশ  ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শুধু বাংলা বিহার উড়িষ্যায় তাদের বাণিজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরী করেনি, বরং এর মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ স্থাপনের গোড়াপত্তন করে। একে একে তারা তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তাদের শোষণের প্রক্রিয়া দৃঢ়তর করতে থাকে, যা পরবর্তিকালে ভারতের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ কর্তৃক   প্রবর্তিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত,  ছিল এই পরিবর্তনের অন্যতম ভিত্তি। এর মধ্য দিয়ে প্রথমে বাংলায় পরবর্তিতে গোটা ভারতে সৃষ্টি হয় স্থায়ী জমিদারি প্রথা। এই জমিদারি প্রথা এদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি করে স্থায়ী ক্ষত। শুরু হয় নতুন শ্রেণীবিন্যাস এবং শ্রেণী দ্বন্দ। এর পাশাপাশি বাংলা তথা ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় চলে আসা ধর্মীয় রক্ষণশীলতা এই শোষণকে করে আরও দূর্বিসহ ও জটিল।  প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ  কখনো থেমে থাকেনি। তাই পাশাপাশি শুরু হয়েছিল  বিভিন্ন সমাজ সংস্কারের সংগ্রাম। এরই প্রক্রিয়ায় রক্ষণশীল  হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রচলিত সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধেও শুরু হয় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ।  রাজা রামমোহন রায় এই আন্দোলন শুরু করেন, যার ফলশ্রুতিতে এই প্রথা  আইনগত ভাবে ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর বিলুপ্ত হয় বটে,  কিন্তু তা বন্ধ হয়নি। তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলমান রাখতে হয়েছে।

ঠিক এর সমসাময়িককালে  শহীদ তিতুমীরের নেতৃত্বে  পরিচালিত হয় জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে কৃষক প্রজাদের সশস্ত্র বিদ্রোহ। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা খ্যাত এই বিদ্রোহ দমিত হয় লর্ড বেন্টিংকের কামান সজ্জিত বাহিনী দ্বারা ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর। বিদ্রোহ দমিত হয় কিন্তু তার স্থায়ী প্রভাব থেকে যায় যুগ যুগ অন্তর্লীনভাবে। 

১৮৫৫ সালের ৩০ জুন, সিধু ও কানহু মুর্মুর নেতৃত্বে শুরু হয় সাঁওতাল বিদ্রোহ – যা শুধু সাওতালদের ভারতীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ছিল না, ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গণযুদ্ধ।

প্রায় একই সময়কালে ১৮৫৭-১৮৫৮ সালব্যাপী  সমগ্র  ভারতে সিপাহীদের যে বিদ্রোহ তাকে বলা হয় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ।  

ইউরোপীয় পুঁজিবাদের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য ও শোষণ বিস্তারের প্রক্রিয়ায় ভারতে কৃষিতে বৃটিশ পুঁজির কাঁচামাল যোগানের প্রয়োজনে  বাংলায় নীলচাষ শুরু হয় বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রনের পরপরই ১৭৭৭  সালের দিকে। ইউরোপে শিল্প বিপ্লব বিশেষ করে বস্ত্র শিল্পের কারখানায় প্রয়োজন পড়ে রঙের। আর এই নীল রং ছিল তার  অন্যতম প্রধান কাঁচামালের উৎস। শুরু হয় ধান চাষের পরিবর্তে জোর করে নীল চাষ। কিন্তু বাংলার  কৃষকরা বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নেয়নি। এই নীল চাষ প্রবর্তন ছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে বাংলার সেই দুর্ভিক্ষের  অন্যতম কারণ। এই নীল চাষের অত্যাচারে জর্জরিত কৃষকরা শুরু করে সংগ্রাম। কখনো স্থানীয়ভাবে বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্তভাবে।  ব্যাপকভাবে এ  বিদ্রোহ শুরু হয় ১৮৫৯ সালে নদিয়া জেলার গোবিন্দপুর এবং চৌগাছা গ্রাম থেকে। তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান, পাবনা, খুলনা এবং নড়াইল জেলাসহ গোটা বাংলায়। এই বিদ্রোহের মূল বিশেষত্ব ছিল যে বাংলার কৃষক ও  উঠতি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিরা মিলিতভাবে এই বিদ্রোহে  অংশগ্রহণ করে। এর নেতৃত্ব ছিল মিলিতভাবে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকদের হাতে। নদীয়ার বিশ্বনাথ সরদার, যাকে পরে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল,  নদীয়ার বিশ্বাস ভাইএরা, পাবনার কাদের মোল্লা, মালদার রফিক মন্ডল ছিলেন এই বিদ্রোহের জনপ্রিয় নেতা।  এই বিদ্রোহ যেমন দমন করা হয় নির্মমভাবে, তবুও তা বৃটিশ শাসনের কেন্দ্রে আঘাত হানে, যার ফলে তারা নতুন আইন প্রবর্তনে বাধ্য হয়। এই নীলচাষের বিদ্রোহ বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতিতেও স্থায়ী আসন করে নেয়।

 তাই এটা স্পষ্ট যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং কর্মময়তা সবই এই অগ্নিগর্ভ সময়কালে  পরিব্যাপ্ত। শহীদ তিতুমীরের ভূস্বামী তথা তাঁদের পৃষ্ঠপোষক বৃটিশ বেনিয়াবিরোধী কৃষকদের বিদ্রোহ, আদিবাসী ভূমিপুত্র  সাঁওতাল যারা মূলতঃ কৃষিজীবি তাঁদের জমিদার প্রথার সঙ্গে সঙ্গে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান এবং বৃটিশ রাষ্ট্রশক্তির অভ্যন্তরে  থেকে তার বিরুদ্ধে  সিপাহীদের  এ সকল বিদ্রোহ হয়ত সফল  হয়নি, কিন্তু ভারতীয় গণমানুষের মধ্যে, তার বহমান সাহিত্য, সংস্কৃতি এমনকি  বৈজ্ঞানিক চিন্তা এবং চেতনা বিকাশের যে পটভূমি তৈরি করে তারই উর্বর মাটিতে জন্ম হয় তৎকালীন বাংলার গণমানস, যা গোটা ভারতের অগ্রদূত হিসেবে পথ দেখিয়েছে, যা গোখলের কথায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সেই প্রবহমানতাই জন্ম দিয়েছে বিদ্যাসাগরদের। গোটা বাংলা তথা ভারতবর্ষের সমাজ, সাহিত্য সংস্কৃতি, অর্থনীতি –রাজনীতির প্রক্রিয়ায় এই প্রবহমানতা স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। বেংগল রেনেসাঁও এরই সঙ্গে অন্তর্লীন হয়ে মিশে যাওয়া এক প্রক্রিয়া। ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন এই অগিগর্ভ যুগের দ্বারা সৃষ্ট সন্তান,  আবার এই সামাজিক বিপ্লব ও বিবর্তনে ভূমিকা পালনকারী অবিসংবাদী অগ্রদূতদের অন্যতম। তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে যে কোন আলোচনায় যদি তৎকালীন সময়ের এই প্রেক্ষাপটটা অনুপস্থিত থাকে তাহলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও বোঝা সম্ভব নয়, এবং তৎকালীন সমাজে তাঁর ভূমিকা নির্ধারণ করাও অসম্ভব হয়ে যায়।  

() ঈশ্বরচন্দ্রের সমাজসংস্কারঃ

নারী শিক্ষাঃ

বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বিস্তারের পথিকৃৎ। তিনি উপলব্ধি করেন যে, নারিজাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়  প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় এই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন এবং তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় এ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এটিই ভারতের প্রথম ভারতীয় বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যসাগর ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। এটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায়  স্ত্রীশিক্ষা বিধায়নী সম্মেলনী  নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মে মাসের মধ্যে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১৩০০ ছাত্রী এই স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করত। পরবর্তীকালে তিনি সরকারের কাছে ধারাবাহিক তদবির করে সরকার এই স্কুলগুলোর কিছু আর্থিক ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮ টি। এরপর কলকাতায় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত) এবং নিজের মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয়  প্রতিষ্ঠা করেন।

বিধবা বিবাহ আইনঃ

সংস্কৃত শাস্ত্রের বিরাট পণ্ডিত হয়েও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণে দ্বিধা করেননি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।  নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন তিনি। হিন্দু বিধবাদের অসহনীয় দুঃখ, তাদের প্রতি পরিবারবর্গের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল তাকে। এই বিধবাদের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সর্বস্ব পণ করে সংগ্রাম করেছেন। হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছেন, যে লোকাচার ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত, আসলে তা ধর্মবহির্ভূত স্থবিরতার আচারমাত্র। তার আন্দোলন সফল হয়েছিল। ১৮৫৬ সালে সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন। তবে শুধু আইন প্রণয়নেই ক্ষান্ত থাকেননি বিদ্যাসাগর মহাশয়। তার উদ্যোগে একাধিক বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। তার পুত্রও ( নারায়ণচন্দ্র) এক ভাগ্যহীনা বিধবাকে বিবাহ করেন। এজন্য সেযুগের রক্ষণশীল সমাজ ও সমাজপতিদের কঠোর বিদ্রুপ ও অপমানও সহ্য করতে হয় তাকে। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বহুবিবাহের মতো একটি কুপ্রথাকে নির্মূল করতেও আজীবন সংগ্রাম করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। প্রচার করেন বাল্যবিবাহ রোধের সপক্ষেও। এর সঙ্গে সঙ্গে নারীশিক্ষার প্রচারেও যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। শুধু কলকাতায় নয়, নারীমুক্তির বার্তা বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে, বিভিন্ন জেলাতেও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে নারীশিক্ষার সপক্ষে জোর প্রচার চালান তিনি। যদিও তার এই উদ্যোগও সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা নিন্দিত হয়। এমনকি কবি  ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পর্যন্ত অত্যন্ত হীন বাক্যবাণে নারীমুক্তি আন্দোলনের ব্যঙ্গ করেন। তবু তার জীবদ্দশাতেই নারীশিক্ষা আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

() শিক্ষাবিস্তার সংস্কারে তাঁর ভূমিকাঃ

১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর সোমপ্রকাশ  নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়   । এই পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনার নেপথ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যথেষ্ট অবদান ছিল। দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম পত্রিকা যাতে রাজনৈতিক বিষয় স্থান পেয়েছিল। ১৮৫৯ সালের ১ এপ্রিল পাইকপাড়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়  স্কুল। কিছুকাল এই প্রতিষ্ঠানের অবৈতনিক তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন তিনি। মে মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা  ব্রাহ্ম সমাজের  সঙ্গে মিশে গেলে উক্ত সভার সভাপতির পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর গণশিক্ষার প্রসারে সরকারি অনুদানের জন্য বাংলার গভর্নরের নিকট আবেদন করেন। ১৮৬০ সালে বোর্ড অফ একজামিনার্সের পদ থেকেও ইস্তফা দেন তিনি। এই বছরই ১২ এপ্রিল ‘ভবভুতির উত্তর রামচরিত’  অবলম্বনে  তার বিখ্যাত গ্রন্থ  সীতার বনবাস  রচিত  ও প্রকাশিত হয়।

১৮৬১ সালের এপ্রিল মাসে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের সেক্রেটারি মনোনীত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই বছর ডিসেম্বর মাসে  হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় অকাল প্র্যাত হলে তিনি গ্রহণ করেন তার সম্পদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার পরিচালনভার। ১৮৬২ সালে কৃষ্ণদাস পালকে এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেন তিনি। এই বছর তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাণভট্টের কাদম্বরী । মাইকেল মধুসূদন দত্ত  তাকে উৎসর্গ করেন স্বরচিত বীরাংগনা কাব্য।  ১৮৬৩ সালে সরকার তাকে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। উল্লেখ্য, ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী নাবালক জমিদারদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৮৫৬ সালে এই ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক গদ্যরচনা ‘প্রভাবতী সম্ভাষন’ এ বছর রচিত হয়। ১৮৬৪ সালে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের নাম পরিবর্তন করে কলিকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন রাখা হয়। ৪ জুলাই    ইংল্যান্ডের রয়াল  এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে সাম্মানিক সদস্য নির্বাচিত করে। খুব কম ভারতীয়ই এই বিরল সম্মানের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। ১৮৬৫ সালের ১১ জানুয়ারি ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যাসাগর মহাশয় তার প্রথম রিপোর্টটি পেশ করেন।

১৮৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বহুবিবাহ রদের জন্য দ্বিতীয়বার ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার নিকট আবেদনপত্র পাঠান বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই বছরই প্রকাশিত হয় তার পরিমার্জিত আখ্যান মঞ্জরী পুস্তকের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। ১৮৬৭ সালের জুলাই মাসে জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতার সঙ্গে গোপালচন্দ্র সমাজপতির বিবাহ হয়। এবছর অনাসৃষ্টির কারণে বাংলায় তীব্র অন্নসংকট দেখা দিলে তিনি বীরসিংহ গ্রামে নিজ ব্যয়ে একটি অন্নসত্র স্থাপন করেন। ছয় মাস দৈনিক চার-পাঁচশো নরনারী ও শিশু এই অন্নসত্র থেকে অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছিল। ১৮৬৮ সালে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু  রামগোপাল ঘোষ প্রয়াত হন। ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারির পদ ত্যাগ করেন। এপ্রিল মাসে তার সম্পাদনায় কালিদাসের  মেঘদূতম  প্রকাশিত হয়। ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়  উইলিয়ম শেক্সপিয়ার    রচিত কমেডি অব এররস  অবলম্বনে রচিত বাংলা গ্রন্থ  ভ্রান্তিবিলাস । উল্লেখ্য, শোভাবাজার রাজবাড়িতে  আনন্দকৃষ্ণ বসুর কাছে তিনি শেকসপিয়রের পাঠ নেন। কথিত আছে, মাত্র পনেরো দিনে তিনি কমেডি অফ এররস-এর এই ভাবানুবাদটি রচনা করেছিলেন। এবছরই বীরসিংহ গ্রামে তার পৈতৃক বাসভবনটি ভস্মীভূত হয়। তিনি তারপর চিরতরে জন্মগ্রাম বীরসিংহ ত্যাগ করেন ।

১৮৭০ সালের জানুয়ারি মাসে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় এক হাজার টাকা দান করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। ২০ ফেব্রুয়ারি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।  দুর্গাচরণ ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা। ১১ আগস্ট বাইশ বছর বয়সী পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণনগর নিবাসী শম্ভুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্দশবর্ষীয়া বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৮৭১ সালের ১২ এপ্রিল তাঁর মা ভগবতী দেবী প্রয়াত হন।  তাঁর জীবনে তাঁর মার প্রভাব ছিল প্রবাদপ্রতিম।

১৮৭১-৭২ সাল নাগাদ তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। জলহাওয়া পরিবর্তনের জন্য এই সময় তিনি কার্মাটারে (বর্তমানে ভারতের  ঝাড়খন্ডে রাজ্যে অবস্থিত) একটি বাগানবাড়ি কেনেন। সেখানে একটি স্কুলও স্থাপন করেন। ১৮৭২ সালের ১৫ জুন হিন্দু বিধবাদের সাহায্যার্থে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড নামে একটি জনহিতকর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। স্বল্প আয়ের সাধারণ বাঙালির মৃত্যুর পর তার স্ত্রী-পুত্র পরিবারবর্গ যাতে চরম অর্থকষ্টে না পড়েন, তার উদ্দেশ্যেই এই প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা। বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন এর অন্যতম ট্রাস্টি। ১৮৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে স্থাপিত হয় মেট্রোপলিটান কলেজ। সেযুগের এই বেসরকারি কলেজটিই বর্তমানে কলকাতার বিখ্যাত বিদ্যাসাগর কলেজ। ঐ বছরে  এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়  তাঁর  বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (দ্বিতীয় পুস্তক)। এই সময়েই মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউটের শ্যামপুকুর শাখাটির প্রতিষ্ঠা। মে মাসে বিধবা বিবাহ বিরোধী পণ্ডিতদের প্রতিবাদের জবাবে  কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য  ছদ্মনামে রচনা করেন অতি অল্প হইল এবং আবার অতি অল্প হইল  নামে দু’টি  পুস্তিকা। ১৬ আগস্ট মাইকেল মধুসূদনের নাটক শর্মিষ্ঠা অভিনয়ের মাধ্যমে উদ্বোধন হয় বেঙ্গল থিয়েটার।  বিদ্যাসাগর  এই থিয়েটারের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৮৭৪ সালে মাত্র এক বছরেই ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় মেট্রোপলিটান কলেজ গুণানুসারে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল।

১৮৩৯ সালে জ্ঞানচর্চায় তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ছাত্র জীবনে প্রতি বছরই তিনি বৃত্তি এবং গ্রন্থ লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান শিক্ষকের পদ লাভ করেন। ১৮৪৬ সালে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ওই কলেজের শিক্ষকদের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের কাজে ইস্তফা দেন।

১৮৪৯ সালে মার্শম্যানের ‘হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল’ অবলম্বনে রচনা করেন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ’ বইটি। ওই  বছরই ১ মার্চ পাঁচ হাজার টাকা জামিনে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন। বন্ধু ও হিতৈষীদের সহযোগিতায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থাপনা করেন ‘সব শুভকরী সভা’। ১৮৫০ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৩৫ সংবৎ (১৮৭৪) প্রকাশিত ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থের ৫৩তম সংস্করণ। বাংলা বর্ণশিক্ষার জগতে ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত বইটি সার্ধশত বছর পরে আজও সমান জনপ্রিয়। ১৮৫০ সালের আগস্ট মাসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় ‘সব শুভকরী’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর প্রথম সংখ্যায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামে একটি বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৩ সালে জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে স্থাপন করেন অবৈতনিক বিদ্যালয়। ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভেঙে বোর্ড অফ একজামিনার্স গঠিত হলে তার সদস্য মনোনীত হন বিদ্যাসাগর।

১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ গৃহীত হওয়ার পর সরকার গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশ্যে ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের অতিরিক্ত সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর তখনই তিনি নদীয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। দুবছরের মধ্যে তিনি কুড়িটি স্কুল স্থাপন করেন। এ ছাড়া তিনি এসব স্কুলে পড়ানোর জন্য, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন। তিনি নিজ গ্রামে নিজ খরচে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এদত বিষয়ক প্রস্তাব প্রথম পুস্তক প্রকাশিত হয়। ১৮৫৬ সালের ১৪ জানুয়ারি মেদিনীপুরে পঞ্চম বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। ওই বছর ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইনসম্মত হয়। ওই বছর ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রথম বিধবা বিবাহ দেওয়া হয়।

১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি স্থাপিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বিদ্যাসাগর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির অন্যতম সদস্য তথা ফেলো মনোনীত হন । ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।

  ১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রকাশ করেন ‘সোমপ্রকাশ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম পত্রিকা যেখানে রাজনৈতিক বিষয় স্থান পেয়েছিল। ১৮৬১ সালের এপ্রিলে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের সম্পাদক মনোনীত হন বিদ্যাসাগর। এই বছর ডিসেম্বরে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার পরিচালনার ভার নেন তিনি। ১৮৬২ সালে কৃষ্ণদাস পালকে এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেন বিদ্যাসাগর। ওই বছর মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাকে উৎসর্গ করেন স্বরচিত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য। ১৮৬৩ সালে সরকার তাকে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। ১৮৬৪ সালের ২ আগস্ট ফ্রান্সে ঋণগ্রস্ত  মাইকেল মধুসূদনের সাহায্যার্থে ১৫০০ টাকা প্রেরণ করেন তিনি। শুধু তাই নয়, মধুসূদন দত্তের মত প্রতিভাকে টিকিয়ে রাখতে তিনি আজীবন তাঁর এবং তাঁর পরিবারের  পাশে থেকেছেন।  ১৮৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বহুবিবাহ রদের জন্য দ্বিতীয়বার  ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার কাছে আবেদনপত্র পাঠান বিদ্যাসাগর। ১৮৬৭ সালের জুলাইয়ে জ্যেষ্ঠ কন্যা হেমলতার সঙ্গে গোপালচন্দ্র সমাজপতির বিবাহ হয়। ১৮৬৮ সালে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রামগোপাল ঘোষ প্রয়াত হন। ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের সম্পাদক পদ ত্যাগ  করেন। ১৮৭০ সালের জানুয়ারিতে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় এক হাজার টাকা দান করেন বিদ্যাসাগর। ১৮৭১-৭২ সাল নাগাদ তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়।

১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি বিদ্যাসাগর মহাশয় সিআইই উপাধি পান। ১৮৮৭ সালে মেট্রোপলিটান কলেজ স্থানান্তরিত হয়। বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রয়াত হন ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই।

বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিক্ষামূলক গ্রন্থ : ‘বর্ণপরিচয়’ (১ম ও ২য় ভাগ, ১৮৫৫), ‘ঋজুপাঠ’ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ, ১৮৫১-৫২), ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ (১৮৫১), ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ (১৮৫৩); অনুবাদ গ্রন্থ : হিন্দি থেকে বাংলা ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭), সংস্কৃত থেকে বাংলা ‘শকুন্তলা’ (১৮৫৪), ‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০), ‘মহাভারতের উপক্রমণিকা’ (১৮৬০), ‘বামনাখ্যানম্’ (১৮৭৩); ইংরেজি থেকে বাংলা ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১৮৪৮), ‘জীবনচরিত’ (১৮৪৯), ‘নীতিবোধ’ (১৮৫১), ‘বোধোদয়’ (১৮৫১), ‘কথামালা’ (১৮৫৬), ‘চরিতাবলী’ (১৮৫৭), ‘ভ্রান্তিবিলাস’ (১৮৬১); ইংরেজি গ্রন্থ : ‘পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্’, ‘সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ’, ‘সিলেকশনস্ ফ্রম ইংলিশ লিটারেচার’; মৌলিক গ্রন্থ : ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৩), ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৫), ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৭১), ‘অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩), ‘আবার অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩), ‘ব্রজবিলাস’  (১৮৮৪), ‘রত্নপরীক্ষা’ (১৮৮৬) প্রভৃতি। 

() বাংলাসাহিত্য ঈশ্বরচন্দ্রঃ

বাংলা সাহিত্যে গদ্যের যদি শৈল্পিক রূপের আদিপুরুষ হিসেবে বিদ্যাসাগরকে চিহ্নিত করা হয় তাহলে তা অত্যুক্তি হবে না। ঐতিহাসিকভাবে সেটাই সত্য।  সাধু বাংলা গদ্যের শিল্পরূপটি ঠিক কি রকম হতে পারে, তার প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল, সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনূদিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাংলা রচনাগুলিতে। ১৮৫৪ সালে শকুন্তলা  ও ১৮৬০ সালে সীতার বনবাস গ্রন্থে তার সেই বিশিষ্ট গদ্যশৈলীর পরিচয় পাওয়া যাবে :

“ শকুন্তলার অধরে নবপল্লবশোভার সম্পূর্ণ আবির্ভাব ; বাহুযুগল কোমল বিটপের বিচিত্র শোভায় বিভূষিত ; আর, নব যৌবন, বিকশিত কুসুমরাশির ন্যায়, সর্বাঙ্গ ব্যাপীয়া রহিয়াছে। (শকুন্তলা, প্রথম পরিচ্ছেদ)  ।“

“ লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্য্য! এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমান জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলংকৃত ; অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয় ; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবলবেগে গমন করিতেছে। (সীতার বনবাস, প্রথম পরিচ্ছেদ, আলেখ্যদর্শন) ।“

এই অপরূপ চিত্রকল্প, কাব্যিক ও অলংকার বহুল গদ্যভাষার পাশাপাশি প্রয়োজন বোধে বিদ্যাসাগরকে  লৌকিক ভাষার আদর্শে দ্রুতগামী ও শ্লেষাত্মক গদ্য রচনা করতেও দেখা যায়। জীবনের শেষ পর্বে রচিত ব্রজবিলাস  তার একটি উদাহরণ:

“ এই কয় প্রশ্নের উত্তর পাইলেই, বিদ্যারত্ন ও কপিরত্ন, উভয় খুড় মহাশয়ের সঙ্গে, নানা রঙ্গে, হুড়হুড়ি ও  গুঁতোগুঁতি আরম্ভ করিব। প্রশ্নের উত্তর পাইলে, হাঙ্গাম ও ফেসাৎ উপস্থিত করিবেক, এমন স্থলে উত্তর না দেওয়াই ভাল, এই ভাবিয়া, চালাকি করিয়া, লেজ গুটাইয়া, বসিয়া থাকিলে আমি ছাড়িব না। (ব্রজবিলাস)। “

তাই সর্বজনস্বীকৃতভাবেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে মনে করা হয়, বাংলার প্রথম সার্থক গদ্যকার। যদিও তত্ত্বগত  ভাবে বাংলা গদ্যের জনক তিনি নন। কারণ বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তাঁর আগমনের বহুপূর্বেই গদ্যরচনার সূত্রপাত ঘটেছিল। কিন্তু সেই গদ্য ছিল শিল্পগুণবিবর্জিত নীরস এবং অনেক ক্ষেত্রেই অসংলগ্ন বাক্যসমষ্টি। এমনকি অনুপস্থিত ছিল যতিচিহ্ন। বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা সাধু গদ্যের একটি মানদন্ড  নির্দেশনা করেন। প্রয়োজনবোধে সেই গদ্যে চলিত ভাষার গতিশীলতাও যুক্ত করেন। কল্পনা ও স্বকীয় পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণে যে গদ্যভাষার জন্ম তিনি দেন, তা ছিল সরস, সুমধুর, সুশ্রাব্য, ছন্দোময় ও গতিশীল। এই অর্থে তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের নব জন্মদাতা।

এই ভাষা আলালি ভাষার মতো ফারসি শব্দবহুল ছিল না।  আবার হুতোমী ভাষার অশ্লীলতা দোষ থেকেও মুক্ত ছিল । বরং পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ  যে শক্তিশালী  অথচ সরস বাংলা চলিত গদ্যের সূত্রপাত করেছিলেন, এ ছিল তারই পূর্বসূরী।

সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে বিদ্যাসাগরের দখল ছিল  অসামান্য। আবার নিজ চেষ্টায় ইংরেজি শিখে সেই ভাষার সাহিত্যের সঙ্গেও সম্যক পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃত শব্দ ও পদবিন্যাসের শ্রুতিমাধুর্য ও গাম্ভীর্যকেই তিনি স্থান দিয়েছিলেন বাংলা গদ্যে; দুর্বোধ্যতা বা দুরূহতাকে নয়। অন্যদিকে কাব্যিক ছন্দোময়তায়  গদ্যকে দিয়েছিলেন এক ললিত সুখপাঠ্য পরিপূর্ণ  রূপ। গ্রহণ-বর্জনের যে অসামান্য ক্ষমতা তার মধ্যে ছিল, তার মাধ্যমে  ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক গদ্যের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহারিক গদ্য ও সমকালীন সংবাদপত্রগুলির নিকৃষ্ট গদ্যনমুনা সব থেকেই ছেঁকে নিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় সাহিত্যগুণ। আবার ইংরেজি সাহিত্যের আদর্শে যতিচিহ্নের ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যে নতুন কালের  সূচনা করছেন  তিনি। নিছক ব্যবহারিক বাংলা গদ্যকে তিনি উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক গদ্যে বিবর্তনের যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন,    “ বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কর্মকুশলতা দান করিয়াছিলেন। “

 () উপসংহারঃ বাংলার সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক বিবর্তনে ঈশ্বরচন্দ্রঃ    

আগেই বলা হয়েছে বিদ্যাসাগর ছিলে যুগের সৃষ্টি এবং যুগস্রষ্টা। হাজার বছরের বাংগালীর গণনাতেও তিনি  অগ্রগণ্য। বাঙ্গালী স্বত্বা, বাংলা ভাষা এবং  বাংগালী জাতীয়তাবাদের বিকাশে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা অনস্বীকার্য।  তিনি ছিলেন  ক্ষণজন্মা অমিত প্রতিভাবান। শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজসংস্কার প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি স্থাপন করেছেন অনন্য মাইলফলক। ভূমিপুত্র সাওতাল থেকে সমাজের অবহেলিত, পীড়িত আর্ত সকল জন মানুষের কাছে তিনি ছিলেন দয়ারসাগর। আর্তমানবতার সেবায় তিনি যে উদাহরণ স্থাপন করেছেন, তারই পথ বেয়ে বাংলার মানবতাবাদী সংস্কৃতি বহমানতা পেয়েছে। এই ঐতিহ্য বাংলার গণ-মানসকে সমৃদ্ধ করেছে। বাঙ্গালী জাতিস্বত্বা বিকাশের যে ভ্রূণ তখন তৈরি হতে শুরু করে বিদ্যাসাগর তাকে লালন করেছেন। নারী অধিকার বিশেষ করে রক্ষণশীল সমাজ দ্বারা নিগৃহীতা নারী বিধবা, অসহয়াদের পূনর্বাসন, নারী শিক্ষা , শিক্ষা প্রসার, সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ, বিজ্ঞান মনস্কতা সৃষ্টির প্রয়াস, আদিবাসী মানুষদের কল্যান, কৃষক প্রজা বিশেষ করে নীলচাষীদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পাশে থাকা, সর্বোপরি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদ বিকাশে যারা ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন,তাঁদের কাছে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠা- সবটাই তাঁর সারাজীবনের কর্মময়তার নিদর্শন । তিনি আলো জ্বেলেছেন, আলো জ্বালতে সাহায্য করেছেন। আসলে  ‘বেঙ্গল রেনেসাঁয়’ তিনি ছিলেন অগ্রপুরুষ। তৎকালীন সমাজ বিকাশে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার সকল প্রয়াসে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। সকল কূপমন্ডুকতা, রক্ষণশীলতাকে পরিহার করে বাংগালী সমাজ ও গণমানসকে তিনি এগিয়ে নিয়েছেন। তাঁকে  কখনই ধর্মীয় সংকীর্ণতা বা জাত পাতের  জীর্ণতা  স্পর্শ করেনি। তিনি কখনই গোষ্ঠী, গোত্র বা সম্প্রদায়ের আবর্তে আটকে থাকেননি, তিনি মানবতার সার্বজনীনতা স্থাপন করেছেন। তিনি বাংগালীর আবহমানকাল ধরে চলে আসা অস্তিত্বকে ধারণ করেছেন তাঁর নিজস্ব ধরণে, স্বকীয়তায়। আজ বাংগালী স্বত্বা হয়ত রাজনৈতিক, ভৌগলিক এমনকি সম্প্রদায়গতভাবে খন্ডিত, ,কিন্তু  বিদ্যাসাগর ঐতিহাসিক বাস্তবতায় তার উর্ধে। তিনি বাংগালী সংস্কৃতির উৎসধারা। এটাই তাঁর ঐতিহাসিক অবদান। বাংলা ভাষা আমদের জননীস্বরূপ  আর সেই ভাষার বর্ণ পরিচয়টি হয়েছিল বিদ্যাসাগরের হাতে।


Sharing Helps!