কমরেড মুস্তাফিজুর রহমান কাবুলের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না

Sharing Helps!

কমরেড মুস্তাফিজুর রহমান কাবুল নেই। কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটা মেসেজে উঠে এলো। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বংগবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আজই ভর্তি করা হয়েছিল।

কমরেড রাশেদ খান মেনন দুপুর তিনটায় আন্তর্জাতিক বিভাগের এক জরুরি বৈঠকেই রিপোর্ট করলেন। কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা বললেন, তিনি তাড়াতাড়ি রাজশাহী থেকে ঢাকায় ফিরে কমরেড কাবুলকে দেখতে যাবেন। কমরেড আনিসুর রহমান মল্লিক যিনি সর্বক্ষণ কমরেড কাবুলের চিকিৎসার তদারক করতেন, তিনি সকালেই টেলিফোনে সর্বশেষ রিপোর্ট বলেছিলেন। কমরেড মল্লিকের মনের অবস্থা বোঝা কঠিন নয়। তিনি প্রায়শই বলতেন, ‘এই বয়সে আজ আমার চিকিৎসার খবর নেবার কথা কাবুলের, আর আমি ওর খবর নিচ্ছি।‘

কমরেড কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই। তবে এত দ্রুত তা তাকে আঘাত করবে, এটা কেউ আশা করেনি।

তাঁর সংগে আমার শেষ দেখা যশোরে পার্টির লালপতাকা জনসভার পরদিন সকালে। সভাশেষে হোটেলে না থেকে তাঁর অনুরোধে রাতে তাঁর বাড়ীতেই রাত কাটালাম। তিনি নিজে হাতে আমার শোবার ব্যবস্থা করে মশারিটা টাঙিয়ে দিলেন। রাতে  আমি, তিনি ও তাঁর স্ত্রী একসংগে খাবার টেবিলে বসে অনেক ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা বললাম। তাঁর মেয়ে জামাই, ছেলের কথা উঠলো। রাতে ওঁর ছেলের ঘরেই শুলাম, কারণ সে তখন ঢাকায়। ভোরে উঠে তিনি আমাকে তাঁর বাড়ির ছাদে নিয়ে গেলেন। ফলের গাছ লাগিয়েছেন।ছাদের একদিকে নতুন একটি কামরা করার পরিকল্পনার কথা। তাঁর পড়ার ঘর। কথা বলতে বলতে আমার অনুমতি নিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। আমি বললাম, ‘কাবুল, সিগারেট ছাড়।“ তাড়াতাড়ি বললো, দাদা, তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেব।‘ জানি না সিগারেটটা ইতিমধ্যে  ছাড়তে পেড়েছিল কিনা। সকালের খাবার খেয়ে মোটর সাইকেলে আমাকে বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিলেন। আমার সংগে শেষ দেখা। বাস ছাড়লে হাত নেড়ে বিদায় জানালো।   

ক’দিন পরই শুরু হলো করোনার প্রাদুর্ভাব। দু’ একদিন কথা হয়েছে। বলেছিলেন, কোমরে ব্যথাটা বেড়েছে। আমি যথারীতি ডাক্তার দেখাতে বলেছি। ঢাকায় আসার উপায় নাই। যশোরেই ডাক্তার দেখাতে হবে। হঠাত একদিন ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখলাম লিখেছেন, ‘আমি অসুস্থ’। উদ্বিগ্ন হয়ে টেলিফোন করলাম। টেলিফোন ধরে বললেন,’হ্যা দাদা, আমার বাম চোখের মনিটা নড়ছে না’। আমি শঙ্কিত হয়ে বললাম,’চোখের ডাক্তার দেখিয়েছ?’ বললেন, হ্যাঁ, দেখিয়েছি, আবার যাবো। ঢাকায় তো যাবার উপায় নাই। দুদিন পর এক্সরে করবো।‘ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থেকেই ফোনটা ছাড়লাম। দু’দিন পর কমারেড মল্লিক বললেন।‘ওকে ঢাকায় আসতেই হবে। ডাক্তাররা বলেছেন।‘ ইতিমধ্যে ওঁর টেলিফোনটা উনি ধরতে পারেননি। আমার সংগে প্রতিদিন টেলিফোনে কথা হওয়া সেই বন্ধ হলো।

ঢাকায় করা ওঁর সিটিস্ক্যান রিপোর্টটার কপি কমরেড আনিস আমাকে পাঠালেন, আমার পরিচিত কোন বিশেষজ্ঞের পৃথক মতামত নেবার জন্য। তখন করোনার প্রাদূর্ভাব এই পর্যায়ে  টেলিফোনে কাউকে পাওয়া দুস্কর। হঠাত করেই মনে হলো, আমার ছোটছেলের বন্ধু লন্ডনে ডাক্তারি পড়েছে, এখনও ওখানেই ডাক্তারি করছে। তাকে পাঠানো যায় কিনা । যুক্তরাজ্যে করোনা আক্রান্তের চাপ তখন ভয়াবহ। তারমধ্যেই আমার ছেলে রিপোর্টটা তাঁর বন্ধুকে পাঠালো। এত ব্যস্ততার মধ্যেই ছেলেটি সেই রিপোর্ট পুংখানুপুংখ দেখে অন্য বিশেষজ্ঞদের সংগে আলোচনা করে তাঁর মতামত পাঠালো। রিপোর্টটা ভালো ছিল না। মনটা খুব খারাপ হলো। রিপোর্টটা কমরেড মল্লিককে পাঠিয়ে দিলাম। আমার ছেলে শুধু বললো, ‘আংকেলের অবস্থা ক্রিটিক্যাল। ওর বন্ধু টেলিফোনে বলেছে। সে দেশেই দ্রুত চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছিল। ইতিমধ্যেই দেশে চিকিৎসা শুরু করা হয়েছে। পলিটব্যুরোর জরুরি বৈঠকে তাঁর চিকিৎসার সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সাধারণ সম্পাদক একটি চিঠি পাঠালেন পার্টির সর্বস্তরে। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী এই করোনা সংকটের কালে কমরেড মুস্তাফিজুর রহমান কাবুল সময় দিলেন না।

 আজ তাঁর সম্পর্কে আমাদের লেখার কথা নয়। আমাদের সম্পর্কে তাঁর লেখার কথা। যা তিনি তাঁর অগ্রজের অনেকের ব্যাপারেই লিখেছেন। ‘পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ আর অগ্রজের কাঁধে অনুজের মৃতদেহ বহন করার মত ভারি বোঝা আর হয় না।‘ মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য। কিন্তু, কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নিতে অসম্ভব কষ্ট হয়।  

এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন, বাম আন্দোলন দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক বিভক্তি দেখেছে। তাঁর কোনটাই শুভ হয়নি। কমরেড কাবুল ছিলেন যে কোন বিভক্তির ঘোর বিরোধী। তিনি মত পার্থক্য মেনে নিতেন, কিন্তু কোন বিভক্তি মেনে নিতে পারেননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই ছিল তাঁর চিন্তা। তিনি বহুবার আমাকে বলেছেন, ‘ আমরা কমিউনিস্টরা মতপার্থক্যের মধ্যে ঐক্য রাখতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যত নাই।‘ আমার ধারণা তাঁর সমাধিতে এটাই ‘এপিটাফ’ হতে পারে। একজন মননশীল বিপ্লবীর হৃদয় নিংড়ানো কথা। জানি না তাঁর এই কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে নতুন রাস্তা দেখাবে কিনা।

সবশেষে বলতে চাই, দেখা গেছে, অনেক প্রভাবশালী নেতার ভিড়ে কর্মীদের নিজস্ব চিন্তা বিকশিত হতে পারে না। অধিকাংশ সময় তা কোন না কোন ভাবে নেতার চিন্তার প্রভাব এসে পড়ে, ফলে তা দলবাজিতে পরিণত হয়। কমরেড মুস্তাফিজুর রহমান কাবুল ছিলেন এক অনন্য ক্ষমতার অধিকারি। তিনি অনেক বড় বড় নেতার সান্নিধ্যে এসেও, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও নিজের চিন্তাকে স্বাধীনভাবে বিকশিত করতে পারতেন। অসাধারণ গুণ। তিনি বুক চিতিয়ে নিজের মত করে ভাবতে পারতেন, বলতে পারতেন এবং লিখতে পারতেন। তাঁর মৃত্যুতে শুধু বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এক অমিত সম্ভাবনার নেতাকে হারালো না, এদেশের বাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলন হারালো এক দৃঢ়চেতা যোদ্ধাকে, যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবার। এদেশের সকল প্রগতিশীল মানুষ যেন এই প্রয়াত তরুণ  বিপ্লবীকে সেভাবেই নেয়। এটাই তিনি চেয়েছিলেন। ‘বৈচিত্রের মধ্যে সৌন্দর্য্য’ এটাই ছিল তাঁর সাংস্কৃতিক মানস। কমরেড মুস্তাফিজুর রহমান কাবুল যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন অনাগত বিপ্লবীদের মাঝে। বিপ্লবীদের মৃত্যু নেই।

তাঁর অকালমৃত্যু  শোকস্তব্ধ করুক, দূর্বল যেন না করে।

৩১ মে, ২০২০

রাত ১২টা।  


Sharing Helps!