(১ম অংশ)
১। ভূমিকা ও পর্যালোচনাঃ
কার্ল মার্কস তাঁর ‘Thesis on Feuerbach’ প্রবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদটি শেষ করেছিলেন যে বাক্যটি দিয়ে আজ তা বিশ্ব জ্ঞানভান্ডারের অন্যতম চালিকাশক্তি, ‘The philosophers have only interpreted the world, in various ways; the point is to change it.’ পৃথিবীর সকল জ্ঞান শুধু অর্জনের জন্য নয়, পৃথিবীকে বদলে ফেলার জন্য। তাকে আরও সামনে এগিয়ে নেবার জন্য। মার্কস ও এংগেলস তাঁদের প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য ( Intellectual ability) দিয়ে পুঁজিবাদের বিকাশ, তার অন্তর্নিহিত মর্মবস্তু, দ্বন্দ ও ঐতিহাসিক বিকাশের তত্ব হাজির করেছেন প্রায় দেড় শতাধিক বছর আগে। যে তত্বকে বলা হয় মার্কসবাদ ( এংগেলসের নাম এর সংগে অংগীভূত)। ঐতিহাসিকভাবে মার্কস-এংগেলস তাঁদের জীবদ্দশায় তাঁদের তত্বের সফল প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন দেখে যাননি। শুধু ১৮৭০ সালে সংঘটিত ‘প্যারী কমিউন’ কে তাঁরা ইতিহাসে ভবিষ্যত বিপ্লবের রিহার্সেল হিসেবে দেখেছিলেন। যার আয়ু ছিল মাত্র ৭০ দিন। এরপর লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় ১৯০৫ সালে বিপ্লবের ‘ড্রেস রিহার্সেল’ ও ১৯১৭ সালে ‘সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ মার্ক্সিয় তত্বের বাস্তব প্রয়োগ। ইতিমধ্যে মার্কসবাদের বিকাশ হয়ে তা হয়েছে ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’। লেনিনবাদকে বলা হয়, সাম্রাজ্যবাদ যুগের মার্কসবাদ। অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝিতে যে মার্কসবাদের জন্ম, অর্ধ শতাব্দির মধ্যেই সমাজবিকাশের গতিধারায় বাস্তবতার পরিবর্তন ও বিকাশের প্রয়োজনে লেনিনবাদের জন্ম। তাতে মার্কসবাদ ভুল প্রমানিত হয়নি। পুঁজিবাদের বিকাশ হয়েছে, যা লেনিন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ,পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’ বইতে তত্বায়িত করেছেন। শুধু তত্বায়িত করেননি তার নিরিখে মার্ক্সবাদের বাস্তব প্রয়োগ করেছেন, বিপ্লব সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে। তারপর একশ বছর অতিক্রান্ত। ৭৫ বছর পর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত ( বিলুপ্ত নয় ) হয়েছে। সভ্যতা দু’টি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। অসংখ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়েছে, বিকশিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে তার সব বিষয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে, মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে গণ্য সাম্রাজ্যবাদের তত্বায়নের ধারাবাহিক রূপায়নের পর্যালোচনার উপর। এই তত্বায়নেরও একটি ক্রমবিকাশ আছে যা সাম্রাজ্যবাদের নিজস্ব রূপান্তরের সংগে সাযুজ্যপূর্ণ। মার্কসবাদের দৃষ্টিভংগী ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদের এক শতাব্দিকালের স্বরূপ ও ক্রিয়াকর্ম মানব জাতির উপর কি প্রভাব ফেলেছে তার উপরও রয়েছে বহু মূল্যবান তত্বায়ন ও দালিলিক প্রমাণ। এই শত বছরে প্রকাশিত হয়েছে শত শত বই, হাজার হাজার প্রবন্ধ, থিসিস, সাহিত্য, সংগীত যা বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের সকল কার্যকলাপের সামাজিক, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভাবের অবিস্মরণীয় দলিল। তার সব উল্লেখ করাতো সম্ভব নয়ই কিছু উল্লেখ করাই সম্ভব নয়। তবুও, তার প্রতিনিধিত্বমূলক হলেও, কিছু উল্লেখ করতেই হবে। কারণ মিথ্যা আর মিথের ডামাডোলে আজ প্রকৃত সত্য হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এ অমূল্য সম্পদ পূনঃপর্যালোচনা করতেই হবে। যা তাদের সামনের দিনগুলোর জন্য জরুরি হয়ে উঠবে। করোনা আক্রান্ত পৃথিবী অন্ততঃ সে দিকই নির্দেশ করছে। তাই এই পর্যালোচনায় তার কিছু বিষয় আসবে। সাম্রাজ্যবাদের উপর মার্ক্সীয় তত্বগুলির মধ্যে পার্থক্য আছে, মতভেদ আছে, যা স্বাভাবি্ক কিন্তু, সব তত্বায়নেই সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াস রয়েছে, যা অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই মতপার্থক্য নিরূপন করে, তার অনুপুংখ বিশ্লেষণ করে তার সঠিকতা, বেঠিকতা নির্ধারন করার লক্ষ্য এই প্রবন্ধের নেই। তা সীমিত পরিসরে এবং সামর্থ্যে সম্ভবও নয়। কিন্তু সেটাও যে ভবিষ্যত করনীয়ের একটা অংশ তা বলাই বাহুল্য। কাউকে পরিবর্তন করতে হলে, তাকে জানতে হয় অনুপুংখ্যভাবে। এটাই বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার ভিত্তি।
২। যে সকল বই নির্মোহভাবে সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছে তার কয়েকটিঃ
মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক তত্বায়ন সম্পর্কিত আলোচনার পূর্বে, সাম্রাজ্যবাদের মার্ক্সীয় তত্বায়নের সংগে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয়, অথচ সাম্রাজ্যবাদকে তুলে ধরা হয়েছে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে অনুপংখভাবে এ অনুচ্ছেদে তাদের বিশেষ কিছু বইএর উল্লেখ করা হচ্ছে। যেগুলি উল্লেখিত হচ্ছে না তারা কম গুরুত্বপূর্ণ তা নয়। স্থানাভাবে তা করা হচ্ছে না। এ বইগুলো সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক – অর্থনৈতিক দৃষ্টিভংগীর নিরিখে পৃথিবীর মোটামুটি সকল মহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন, আধিপত্য, নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরেছে। বইগুলো কিছুটা প্রতিনিধিত্বমূলকও বটে।
( ব্রাজিলের সাও পাওলো যাদুঘরে লাতিন আমেরিকায় ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ ও তার ক্রীতদাস প্রথার ও ক্রীতদাসদের উপর অত্যাচারের ভয়াবহ যে জীবন্ত প্রমাণ দেখার সুযোগ হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল সভ্যতা কাদের হাতে তৈরি? এই রক্তাক্ত হাতের উত্তরাধিকার বহণ করছে কারা? তাই ব্রাজিলের প্রান্তে প্রান্তে নিও লিবারিজমের বিরুদ্ধে যখন ঘৃণা দেখেছি, তখন মনে হয়েছিল, না ইতিহাস হারিয়ে যায় না। )
প্রথমেই বলা যাক Dee Brown এর কথা। একজন আমেরিকান লেখক, নিজে রেড ইন্ডিয়ান নন, কিন্তু লিখেছেন ‘Bury My Heart at Wounded Knee: An Indian History of the American West’ বই। আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের নির্মূল করে ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের এক রক্তক্ষয়ী ইতিবৃত্ত। এই বই বহু মানুষের চিরাচরিত ভাবনাকে নাড়া দিয়েছে গভীরভাবে। তথাকথিত সভ্যতার উলংগ জিঘাংসার অনন্য প্রামান্য চিত্র এ বইটি।
Madhusree Mukerjee র লেখা Churchill’s Secret War: The British Empire and the Ravaging of India during World War II বইটি বৃটিশ জাত্যাভিমানের ধারক হিসেবে উইনস্টন চার্চিলের হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতার ভাবমূর্তির আড়ালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বৃটিশ ভারতে ৩০ লক্ষ মানুষের অনাহারে মৃত্যুর করুণ ইতিহাসে তার দায় কতটুকু তার চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। সাম্রাজ্যবাদের মুখোশের আড়ালে মুখটা কি সেটা জানা যে জরুরি সে সত্যটা বইতে আছে।
Confessions of an Economic Hit Man বইএ John Perkins মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের আকাংখায় কত দূর্নীতি আর অনাচারের আশ্রয় নিয়েছে এ বই তার প্রামান্য দলিল। অন্ধকারকে আলোতে আনার এ এক দঃসাহ;সী প্রয়াস।
Chimamanda Ngozi Adichie আফ্রিকার মানুষের প্রতিনিধি। তিনি তাঁর Half of the Yellow Sun এই বইতে দেখিয়েছেন অন্ধকার আফ্রিকায় সাম্রাজ্যবাদের ক্ষমতালিপ্সার চিত্র। পাশাপাশি স্বাধীনতা আর জাতিস্বত্বার বিকাশের লড়াইকেও চিত্রিত করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কি নৃশংসতায় আফ্রিকার দেশে দেশে তাদের রক্তাক্ত পদক্ষেপ রেখেছে, তা তিনি বলেছেন তার এই বইএ।
Noam Chomsky, যে নামটা প্রায় অর্ধ শতাব্দি ধরে উচ্চারিত হচ্ছে। সেই আপোষহীন কন্ঠ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বৈশ্বিক প্রাধান্য বিস্তারের রণনৈতিক চিত্রনাট্যের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন Hegemony or Survival: An America’s Quest for Global Dominance বইএ। কোন দলীয় মতাদর্শের পক্ষে নয়, তাঁর প্রতিটি ছত্র নির্মোহ মানবিক যুক্তিবাদের আলোকে সাম্রাজ্যবাদের সকল মুখোশ খুলে দিয়েছে। এই বইএর ধারাবাহিকতায় তিনি শতবর্ষী প্রায় হয়েও এই করোনাকালেও আক্রান্ত মানুষের সামনে সাম্রাজ্যবাদের অমানবিক মূর্তি তুলে ধরছেন।
ঠান্ডাযুদ্ধের প্রাক্কালে মানুষ যখন প্রায় ভুলতে বসেছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুখোশের আড়ালে আসল মুখ। মূল্ধারার বুদ্ধিবৃত্তির বৃত্ত যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মুক্ত দুনিয়ার নায়ক আর গনতন্ত্রের ত্রাতা হিসেবে চিত্রিত করতে ব্যস্ত, তখন John Bellamy Foster তাঁর Naked Imperialism বই লিখেছেন। দেখিয়েছেন প্রকৃত সত্য, প্রকৃত চিত্র, সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ।
Ngugi Wa Thiong’o এর Petals of Blood কৃষ্ণ আফ্রিকায় সাম্রাজ্যবাদের রক্তাক্ত হাতের নির্মোহ চালচিত্র। মুনাফা আর আধিপত্যের করাল গ্রাসে কি করে মানবতা ভুলুন্ঠিত -তাই এঁকেছেন এই বইএ।
নয়া-উদারবাদ আর মুক্তবাজার অর্থনীতির সর্বগ্রাসী মুনাফা, সংগে মানবজাতির চিন্তা, যুক্তি আর বোধকে বাজার আর মুনাফার অধীন করার বৈশ্বিক উদ্যোগ যখন বিজয়ের ডংকা বাজাচ্ছে, তখন Naomi Klein লিখেছেন The Shock Doctrine: The Rise of Disaster Capitalism বইটি। প্রকৃত চিত্র, প্রকৃত সত্য উন্মোচন করেছেন। ১৯৭৩ সালে চিলি থেকে ’৯০ এর দশকের ইরাক সর্বত্রই তথাকথিত গণতন্ত্র আর শান্তিপ্রতিষ্ঠার পিছনে যে সন্ত্রাস, ষড়যন্ত্র আর রক্ত বয়ে গেছে তাই তিনি চিত্রিত করেছেন।
Frantz Fanon আফ্রিকার মানুষের উপনিবেশবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধের তাত্বিক নেতা লিখেছেন The Wretched of the Earth বই যা উপনিবেশের অধীনে বাস করা মানুষের উপর সাম্রাজ্যবাদের যে গভীর প্রভাব যা তাদের মুনাফা আর ক্ষমতাকেই চিরস্থায়ী করার প্রয়াস তারই চিত্র তিনি তুলে এনেছেন তার বৈপ্লবিক মেধায়।
Edward Said, তাঁর Orientalism বইএ প্রাচ্যের মানুষের বৌদ্ধিক অভিভাবক হিসেবে প্রাচ্যে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক আগ্রাসনের সংগে , চিন্তায় আর সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের যুক্তিগ্রাহ্য মহাকাব্যিক চিত্র এঁকেছেন। তাঁর Culture and Imperialism বইএ উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দির সাম্রাজ্যবাদ যা অষ্ট্রেলিয়া থেকে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল, সেই সাম্রাজ্য বিস্তারের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অভিনিবেশ বিশ্লেষণ করেছেন তিনি এই বইএ।
এই সব বইএর দৃষ্টিভংগী এক নয়, বিশ্লেষণের রূপও এক নয়। এমনকি অনেক বিষয়ে বিতর্কও আছে, তবুও এ বইগুলো তাদের নিজেদের অবস্থান থেকেই বিভিন্ন মহাদেশে সান্রাজ্যবাদের ক্ষমতালিপ্সা, মুনাফার লোভ আর অমানবিকতার চিত্র তুলে ধরেছে। সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক তত্বায়ন না থাকতে পারে, আছে বাস্তবতার নিষ্করুণ নির্যাস।
(ক্রমশঃ)
(২য় অংশ পরে প্রকাশিতব্য)