২য় অংশ
৩। সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত মার্ক্সীয় তত্বের ধারাবাহিক বিকাশঃ
একজন সক্রিয় মার্ক্সবাদী কর্মীর কাছে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি উচ্চারণের সংগে সংগে লেনিনের বিখ্যাত বই ‘সাম্রাজ্যবাদঃ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’ বইটির নাম প্রথম মনে আসবে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে একমাত্র এবং শেষ কথা হিসেবে গণ্য করা হবে। (তাতে তাঁদের খুব বেশী দোষ দেওয়া যাবে না। সেটা অন্য প্রসংগ)। বিগত একশ বছরে লেনিনের ‘সাম্রাজ্যবাদ’ তত্বের উপর একাডেমিক বা রাজনৈতিক আলোচনা, প্রশংসা যেমন রয়েছে, তীব্র সমালোচনাও রয়েছে। সেটা যেমন আছে পুঁজিবাদী নীতিনির্ধারক ও বুদ্ধিজীবিদের তরফ থেকে তেমনি মার্কসবাদী, নিও মার্কসবাদী থেকে শুরু করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অথচ মার্কসবাদী নয় তাঁদের তরফ থেকেও। একাডেমিক পরিমন্ডলে মার্কসীয় দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদ তত্বেরও একটা ক্রমবিকাশ রয়েছে। কিন্তু বড় ধরণের বিতর্কের উদ্ভব না ঘটিয়েই বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদের লেনিনীয় তত্বের পর একশ বছর পার হয়েছে, একাডেমিক পরিমন্ডলের তার প্রেক্ষিতে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে, তত্বায়নও হয়েছে, কিন্তু কোন সক্রিয় যাকে বলা যায় এক্টিভিস্ট রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে সাম্রাজ্যবাদের উপর ঐ ধরণের ‘সেমিনাল’ বই বা তত্বায়ন হয়নি, অন্ততঃ বৈশ্বিক রূপান্তরের প্রেক্ষিতে তো নয়ই। দেশে দেশে বিভিন্ন মার্কসবাদী পার্টি আন্তর্জাতিক পর্যালোচনা করেছে, কখনও ‘নয়া ঔপনিবেশিক’ শোষণের কথা বলা হয়েছে, ‘নয়া উদারনীতিবাদের’ কথা বলা হয়েছে, বিশ্বায়নের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এই একশ বছরে পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের পরিমাণগত বা গুণগত কোন পরিবর্তন হয়েছে কিনা তাঁর কোন পরিপূর্ণ মূল্যায়নের অভাব রয়েছে। যার ফলে, কখনও সাম্রাজ্যবাদের বিপদকে ছোট করে দেখা বা সাম্রাজবাদের সংগে আপোষ করে চলা বা দেশে দেশে পুঁজিবাদের বিকাশের সঠিক মূল্যায়নের দিকেও দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সংগে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রীয় গন্ডীর মধ্যে বিকাশমান পুঁজির সম্পর্ক বা দ্বন্দের প্রকৃত রূপ ধরা পড়েনি। অধিকাংশ সময় কিছু উপরসা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শ্লোগান হয়ত উঠেছে, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচী দানা বাধেনি।
সাম্রাজ্যবাদের তত্বের বিকাশের ধারাকে সাধারণভাবে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। অনুপুংখ একাডেমিক আলোচনায় এই স্তরগুলোর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু স্তরভেদকে সাধারণভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়।
প্রথম স্তর শুরু হয় বিংশ শতাব্দির একেবারে শুরু থেকে এবং এই স্তর শেষ হয় ১৯১৭ সালে লেনিনের বিখ্যাত বইটির মধ্য দিয়ে। মার্কসীয় দৃষ্টিতে একে ‘পিনাকল’ বলা চলে। এই স্তরে যারা অবদান রাখেন, তাঁরা হলেন, হবসন যিনি মার্কসবাদী না হয়েও পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদ তত্বের প্রথম প্রবক্তা। তাঁর বই, ‘Impreialism: A study’-সেটা লেখেন ১৯০৩ সালে। দ্বিতীয় বইটি লেখেন একজন অস্ট্রিয়ান জন্মোদ্ভূত জার্মান মার্কসবাদী তাত্বিক ‘হেলফের্দিং’। তাঁর বই ‘ Finance capital’ . ১৯১০ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। এর পরবর্তী বইটি লেখা জার্মান প্রখ্যাত মার্কসবাদী নেত্রী রোজা লাক্সেমবুর্গের। তাঁর বই ‘Accumulation of Capital’ প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে। আর এক জার্মান মার্কসবাদী কার্ল কাউতস্কি, যাকে লেনিন দলত্যাগী কাউতস্কি বলেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য। তাঁর লেখা ‘Ultra-Impreialism’ এর তত্ব শুধু তাত্বিক বিতর্ক তোলেনি, সেই তত্বের ভিত্তিতে জার্মান বুর্জোয়া শাসকদের পক্ষে বিশ্বযুদ্ধ সমর্থনের জন্য তাঁর সংগে জার্মান পার্টি এস পি ডির মধ্যে রোজা লাক্সেমবুর্গ ও কার্ল লিবখনেখতসহ নেতৃবৃন্দের তুমুল বিতর্ক হয়, পার্টি ভেংগে যায়। যার ফলশ্রুতিতে ২য় আন্তর্জাতিক বিলুপ্ত হয়, তৈরি হয় তৃতীয় আন্তর্জাতিক। ১৯১৫ সালে রাশিয়ার তরুণ মার্ক্সবাদী নেতা নিকোলাই বুখারিন সাম্রাজ্যবাদের উপর তাঁর বই লিখেছেন ‘Imperialism and World Economy’ যার ভূমিকা লিখেছেন লেনিন নিজে। এরপর ১৯১৭ সালে লেনিন তাঁর লেখা ‘Imperilaism: the highest stage of Capitalism’ এর মধ্য দিয়ে ‘সাম্রাজ্যবাদের’ মার্কসবাদী তত্বের মৌলিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। এই স্তরের তাত্বিকদের মধ্যে হবসন, কাউতস্কি আর হিলফের্দিং ছিলেন সংস্কারবাদী আর রোজা লুক্সেমবুর্গ, বুখারিন আর লেনিন ছিলেন বিপ্লবী। তাঁদের তত্বের নিরিখে এভাবে ভাগ করা চলে।
দ্বিতীয় স্তর শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময় থেকে। যারা এর সূচনা করেন তাদেরকে নিও মার্কসবাদী বলা হয়, যা শুরু হয়েছে Paul Sweezy, Paul Baran এর হাত ধরে এবং Samir Amin পর্যন্ত।
তৃতীয় স্তরকে বলা চলে নিও লিবারেল বা নয়া উদারনীতিবাদী যুগের সাম্রাজ্যবাদ তত্ব, যা শুরু হয় ১৯৯০ সালের পর থেকে এবং একবিংশ শতাব্দির শুরুতে। যা এখনো চলমান। প্রসংগক্রমে বলা যায়, সোভিয়েত বিপ্লবের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মার্কসীয় ‘সামাজ্যবাদ’ তত্ব ফিরে আসে নতুন করে। সেটাও মুখ্যতঃ নয়া মার্কসবাদীদের হাত ধরেই। সোভিয়েত পরাজয়ের দুই দশকের মধ্যেই পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের নানা গভীর সংকট, বিশ্বায়নের প্রভাব, বিভিন্ন দেশের মধ্যে অসম উন্নয়ন ও বৈষম্য শুধু নয়, উন্নত পুঁজিবাদী দেশের অভ্যন্তরেও পুঁজির অবিশ্বাস্য ঘনীভবন আর বৈষম্য স্বাভাবিক ভাবেই ‘সাম্রাজ্যবাদ’ তত্বকে আরও প্রাসংগিক করে তোলে।
আলোচনার সুবিধার জন্য ‘সাম্রাজ্যবাদ’ তত্বের এই তিনটি স্তরের উপর আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হবে। তাঁদের পার্থক্যের রূপরেখা, তত্বের প্রায়োগিক দিক আলোচনা করার চেষ্টা থাকবে। তবে অবশ্যই এর আনুপুংখিক আলোচনা এই পরিসরে সম্ভব নয়। কিন্তু সে কাজটি অপরিহার্য, তা যতটা না একাডেমিক প্রয়োজনে, তাঁর চাইতে বেশি সমাজ পরিবর্তনে নিয়োজিত বিপ্লবীদের রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ধারণের জন্য। ‘করোনা’ আক্রমণ আর শুধুমাত্র একটি ব্যাধির ‘অতি মারি’ নয়। এটা বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে, আঘাত করেছে। এর অভিঘাত বহুদূর বিস্তৃত হবে। আগেই কিছুটা বলা হয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সংকটের মধ্য দিয়ে উদ্ভব হয়েছিল ‘সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা, যার অভিঘাত গোটা বিশ শতকের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি সর্বত্র পরিব্যপ্ত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যকার দ্বন্দের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে। ‘সোভিয়েত বিপ্লবে’র পর পৃথিবীতে পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যকার দ্বন্দ নিরসিত হয়নি, বরং তা আরও ঘনীভূত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গড়িয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে বিশ্বপূঁজিবাদের সংগে সমাজতান্ত্রিক শক্তির দ্বন্দ, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমনের মধ্য দিয়ে। ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে’র শুরু হয়তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিবদমান পূঁজিবাদী শক্তিগুলি্র পুরনো অনিরসিত দ্বন্দগুলির প্রেক্ষিতে, কিন্তু মূখ্যতঃ সে দ্বন্দ ঘনীভূত হয় পুঁজিবাদ বনাম সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে। তাঁর মধ্য দিয়ে বিংশ শতাব্দি প্রবেশ করে এক নতুন বিশ্বদ্বন্দের আবহে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপে নতুন অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বিন্যাস ও মেরুকরণ হয়। মাও সে তুওং এর নেতৃত্বে চীন বিপ্লব, কোরিয়া পেনিনসুলায় কিম উল সুং এর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠা, ভিয়েতনাম যুদ্ধের শুরু এবং তাঁর পরিণতিতে হো চি মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনাম বিপ্লব, ফিদেল ক্যাস্ত্রো আর চের নেতৃত্বে কিউবান বিপ্লব-এর প্রতিটি ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী আর সমাজতান্ত্রিক শক্তিবলয়ের দ্বন্দ ছিল স্পষ্ট। এর বাইরে আফ্রো-এশিয় অঞ্চলে পৃথিবীর প্রায় ৭০ টি দেশ প্রাক্তন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন করে। এই ক্ষেত্রেও সমাজতান্ত্রিক শক্তিবলয়ের সংগে সাম্রাজ্যবাদের ছিল স্পষ্ট মেরুকরণ। তাত্বিক এবং মতাদর্শিকভাবে সমাজতান্ত্রিক শক্তি সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে জাতীয় মুক্তির সকল লড়াইকে দিয়েছে অকুন্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। কোন মিথ্যা অপপ্রচারের আড়ালেই এই সত্যকে ঢেকে দেওয়া যাবে না। ফলে, বিগত একদশককালে বিকাশমান মার্কসীয় ‘সাম্রাজ্যবাদের’ তত্ব এই বিশ্ব প্রেক্ষাপটের বাইরে করা যাবে না বলেই আলোচনার শুরুতে এই ভূমিকা প্রয়োজন।
(ক্রমশঃ)