গ্রামের মানুষের কথা বলছি

Sharing Helps!

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের মত করে করোনার ব্যাপারে সজাগ। আমি বাংলাদেশের যত গ্রামের সংগে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি, তাদের থেকে তাদের কথা বোঝার চেষ্টা করি, তাতে আমার মনে হয়েছে, গ্রামের মানুষ অনেক সজাগ। প্রথমে আসি করোনা সম্পর্কে তারা জানে কি না। আমি সুন্দরবনের প্রান্ত থেকে রংপুরের সুদূর গ্রামের খোঁজ নেবার চেষ্টা করেছি। তাদের কথা তারা করোনা যে কি তা তাদের মত করে বোঝে।  শুধু বোঝে না,  কোন গ্রামে, কোন বাড়ীতে কার একটু জ্বর হয়েছে সে খবরও  রাখে। বাইরের থেকে এলাকায় কোন লোক এসেছে কিনা  তাও তাদের জানা। কিন্তু তাদের প্রধান সমস্যা আমাদের দেশের গ্রামীন একটা সমাজ ব্যবস্থা রয়েছে, তাদের বহুকাল ধরে হাটবাজারে যাবার  অভ্যাস আছে। একজন গ্রামীন মানুষ সারাদিন কাজ করে। বাড়ী ফেরার পথে বাজার থেকে চাল, ডাল আটা নুন, দৈনিন্দিন টুকিটাকি জিনিস, সাথে ছোট মেয়ের আব্দারের কোন জিনিস সাধ্যমত কিনে সাঁঝের বেলায় বাড়ী ফেরে। করোনা তার আবহমান কাল  থেকে চলে আসা জীবনকে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের দেশের মানুষ বন্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে জানে, ঘূর্ণিঝড় আইলার বিরুদ্ধে লড়াই করতে জানে। সেখানে তারা সবার সংগে সবাই মিলে  এককাট্টা হয়ে লড়ে। কেউ আলাদা হয় না। আমাদের দেশের সংস্কৃতি হলো একসংগে হওয়া, একসংগে মসজিদে যাবে, মন্দিরে যাবে, গির্জায় যাবে, প্যাগোডায় যাবে। কিন্তু করোনা একঝটকায় আমাদেরকে একা করে দিল, আলাদা করে দিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের কৈশোরে আমাদের এলাকার গুটিবসন্ত হয়েছিল, গ্রামে বলে ‘পুসকরা’ লাগা। তার অর্থ বাড়ীর মানুষ বাড়ীতেই মারা যাবে, সৎকার করার কেউ থাকবে না। আমরা অনেক তরুণ হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে মৃতদেহ সৎকারের উদ্যোগ নিয়েছি, তা মাঝে মাঝে পরিবারকে লুকিয়ে। কিন্তু পরিবার যে তাতে বাধা দিয়েছে তা নয়, কিন্তু সংগত কারণে উদ্বিগ্ন হয়েছে। মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়ানো এটাই তো বাংগালীর আবহমানের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। আমরা নতুন এ ধাক্কায় একটু থমকে গেছি। আজ সকালেই অনেক গ্রামের খোজখবর নিলাম। প্রথম কয়দিন মানুষ গ্রামের বাজারে যাওয়া, দোকানে গল্প করা এগুলো করেছে, তাতে অনেক জায়গায় ক্ষতিও হয়েছে।  কিন্তু গ্রামের মানুষ সামলে নিয়েছে। এখন সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তি, বেসরকারি সংস্থা সবাইকে স্থানীয়ভিত্তিতে এককাট্টা হতে হবে। সরকারকে বিন্দুমাত্র দেরী না করে, গরীব, নিম্নবিত্ত, এমনকি অনেক নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের বাড়ীতে খাবার পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় সরকারের যারা প্রতিনিধি রয়েছে তাদেরকে এলাকাভিত্তিক মানুষের কাছে সকল উদ্যোগের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিন চাল, ডাল, তেল চুরির খবর বেরুছে, এর আগে আমি সরকারের কাছে, এ ব্যাপারে সরকারের প্রেসনোটের দাবী করেছিলাম, সেই দাবী পূনর্ব্যক্ত করছি। এটা জনমনে দারুণ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে হতাশা তৈরি করছে। হতাশ জনগণকে নিয়ে এতবড় লড়াইএ জেতা যায় না। সর্বোপরি, আমাদের মনে রাখতে হবে, এই যুদ্ধে মাঠের সৈনিক হলো ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী এবং তার সংগে সংশ্লিষ্ট সকলে। তাদের সুরক্ষিত করার বিষয়টি প্রথমে ভাবতে হবে। ইতিমধ্যে  দু’জন তরুণ ডাক্তার মৃত্যুবরণ করেছেন করোনার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে, কোন সুরক্ষা না নিয়ে। এটা আমাকে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিককার কথা মনে করিয়ে  দেয়। আমরা জানতামই না শ্ত্রুর বিরুদ্ধে কি অস্ত্র নিয়ে লড়াই করতে হবে। তারফলে অনেককে জীবন  দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন তো আমরা জানি আমাদের কি প্রয়োজন, তাহলে কেন এই মৃত্যু? এই দু’জনের মধ্যে একজনের সংগে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। আমার এক ছাত্রকে ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করেছিলাম। তার প্রায় ২২ দিন জ্বর ছিল, কোন এ্যান্টবায়োটিক কাজ করছে না। অনেকে তাকে ভারতে নিয়ে যাবার পরামর্শ দিল।  কিন্তু আমার এক কলিগ বন্ধু তিনি এই ডাক্তারের কথা বললেন। আমি তার উপর ভরসা করলাম। ডাক্তার মঈন। খুব শান্তশিষ্ট মানুষ, আস্তে কথা বলেন। আমি তাকে ‘আপনি’ করে কথা বলায়, অত্যন্ত নীচুস্বরে বললেন, ‘স্যার, আমাকে আপনি বলবেন না, আমি আপনার ছাত্রের মত’। পত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ফটো দেখে চোখ জলে ভরে গেল। বারবার তাঁর মৃদু কন্ঠস্বর কানে বাজছে। কেন অহেতুক এই অপচয়? তাকে একটা এয়ার এ্যাম্বুলেন্স দেওয়া গেল না?  এখন সরকার ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের বড় বড় হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছেন, শুনে খুশি হলাম।  সেখানেও কি হোটেলে সিট পাবার জন্য পদ পদবী লাগবে? শুনলাম, ডাক্তার মঈন প্রফেসর নয় বলে, তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া যায়নি। এই অবিমৃশযকারিতার মাফ হয়?  আজ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক, যেকোন গ্রাম মফস্বল যেখান থেকেই হোক না কেন, করোনার সংগে লড়াইএ আক্রান্ত কোন ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মী, প্রচ্ছন্নতা কর্মীকে প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনায় এমনকি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সবচাইতে কাছের সবচাইতে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ভিয়েতনামের কথা আগে উল্লেখ করেছিলাম, তাদের দেশে একজনও করোনায় মারা যায়নি।  কারণ তাদের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ‘আমাদের সর্বাধুনিক চিকিতসাব্যবস্থা নেই কিন্তু সর্বোচ্চ সেবা দেবার সামর্থ্য আছে।‘  আমরা জানি করোনার ওসুধ এখনও মানুষের হাতে নেই, ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হতে কমপক্ষে ১৮ মাস সময় লাগবে, তাতে মি. ট্রাম্প যে নাটকই করুন না কেন। এই বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে জিততে হবে। সবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলি চোর ঠেকান, মনে হয় আপনি ছাড়া কাউকে বলে লাভ নেই।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, আমাদের গ্রামের মানুষ যুদ্ধের জন্য তৈরি। কৃষকের শষ্য নষ্ট না হতে দিয়ে কেনার ব্যবস্থা করা হোক, কৃষককে বিনা সুদে ঋণ দেওয়া হোক তারা শোধ দেবে কোন সুদ রাখা চলবে না। তারা  গায়ে খেটেই শোধ  দেবে। গ্রামীন শ্রমজীবি মানুষের এখন বাঁচাতে হবে, করোনার উপশম হলে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। বড়লোকদের বেশি মুনাফার লোভ থেকে সরে আসতে হবে। এই ছোট কয়টি কথা মনে রাখলে এ যুদ্ধে বাংলাদেশ জিতবেই।


Sharing Helps!