( এঙ্গেলস এর জন্ম দ্বি-শতবার্ষিকী উপলক্ষে)
১। ভূমিকা :
মার্ক্সবাদ কি? সহজে বললে বলা যায়, মার্ক্সবাদ এমন এক সামগ্রিক ধারণার দার্শনিক রূপ যা কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫) প্রথমবারের মত উদ্ভাবন ও সূত্রায়ন করেন। তাঁদের সামগ্রিক এ ধারণাগুলি মানব সমাজকে একটি উন্নততর সমাজ-ব্যবস্থা, সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর জন্য শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণী সংগ্রামের পরিপূর্ণ তাত্বিক ভিত্তি হিসেবে গৃহীত। সংক্ষেপে বললে বলতে হয়, মার্ক্সবাদ হলো শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজ পরিবর্তনের দর্শন বা বিশ্বদৃষ্টিভংগী।
পরিপূর্ণ মার্ক্সবাদ মূলতঃ তিনটি মূল শিরোনামে বিন্যস্ত। এগুলি হল দর্শন যা দ্বান্দিক বস্তুবাদ, সমাজ ইতিহাসের গতি বা বিকাশ যা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং মার্কসীয় অর্থনীতি। এগুলি লেনিনের কথায় মার্ক্সবাদের তিনটি অঙ্গ নামে সুবিদিত।
মার্ক্সবাদের মূলনীতিগুলি বোঝার আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত হ’লো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে উপলদ্ধি করা, আত্মস্থ করা এবং প্রয়োগ করতে পারা। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এমন একটি দর্শন, যা দিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সামগ্রিক জগতকে পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যা করা যায়। এ হ’ল সেই দার্শনিক ভিত্তি এবং পদ্ধতি যার উপর মার্ক্সবাদের সামগ্রিক মূলতত্ত্বগুলি দাঁড়িয়ে আছে।
এঙ্গেলসের ভাষায়, ‘দ্বান্দিকতা বা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি হ’ল আমাদের ( বিপ্লবী শ্রমজীবিদের) কাজের শ্রেষ্ঠ উপকরণ এবং আমাদের সবচেয়ে ধারালো হাতিয়ার।‘ শ্রমজীবি শ্রেণীর আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁদের সকল বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের মূল নির্দেশিকা। এ অনেকটা দিগদর্শনযন্ত্র বা মানচিত্রের মত, যা বিপ্লবী শ্রেণী হিসেবে শ্রমিকশ্রেণীকে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ঘটনাপ্রবাহের ডামাডোলের মধ্যেও নিজেদের দ্বায়িত্ব পালনে সক্ষম করে এবং যে সকল অন্ত:সলিলা জাগতিক প্রক্রিয়া পারিপার্শ্বিক জগতকে নির্দিষ্ট রূপে গঠন করে তাদের বুঝতে সাহায্য করে। প্রতিমুহূর্তে ভুল ও ঠিকের মধ্যে পার্থক্য করতে সহায়তা করে।
২। বস্তুবাদ বনাম ভাববাদ।
দর্শন (philosophy) প্রাথমিকভাবে দু’টি বৃহৎ শিবিরে বিভক্ত যেমন ভাববাদ এবং বস্তুবাদ। লেনিন লিখেছেন, ‘মার্ক্সবাদের দর্শন হল বস্তুবাদ’। কিন্তু, শুধু মার্ক্সবাদই কি বস্তুবাদ? তা নয়। এ হল বিশেষ ধরণের বস্তুবাদ, যাকে বলা হয় দ্বান্দিক বস্তুবাদ। এই বস্তুবাদী দর্শনের বিকাশের যেমন ইতিহাস আছে, দ্বান্দিক পদ্ধতি বিকাশেরও তেমনি ইতিহাস রয়েছে।
সাধারণভাবে, দার্শনিক বস্তুবাদ হল সেই দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে চেতনা নিরপেক্ষভাবে বস্তু জগতের অস্তিত্ব স্বীকার ও ব্যাখ্যা করা হয়। বিশ্বজগৎ নিত্য অস্তিত্বশীল একটি বিষয় এবং তা কোন অতিপ্রাকৃতিক সত্ত্বা দ্বারা সৃষ্ট নয় । এখানে স্বর্গ ও নরকের বা সেই ধরণের কোন অধিবিদ্যক চিন্তার কোন স্বীকৃতি থাকে না।
চেতনা নিরপেক্ষ বস্তুর অস্তিত্বের এই বস্তুবাদের ভিত্তিতে দ্বান্দিকতার দৃষ্টিতে মনে করা হয়, বস্তুজগত হলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে গতিশীল এক বাস্তবতা। মানুষ প্রকৃতির একটি অংশ এবং এককোষী শ্রেণীর জীব থেকে তা বিবর্তিত হয়ে এই পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এই বিবর্তনের রয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক একটি প্রক্রিয়া। প্রায় ৬ বিলিয়ন বা তার কাছাকাছি বছর পূর্বে প্রাণহীন বস্তুজগৎ থেকে তা উদ্ভূত হয়েছিল। এটা ছিল একটা উল্লফন। এই বিবর্তনের বিশেষ এক পর্যায়ে প্রাণিদের মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রের উন্মেষ ঘটে এবং ঘটনাচক্রে বৃহৎ মস্তিস্ক সম্পন্ন মানুষ প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। মানুষের মস্তিষ্কেরও বিকাশ হয়েছে প্রাকৃতিক নিয়মেই। মানুষের উদ্ভবের সাথে সাথে মানবচিন্তা ও চেতনার উন্মেষ ঘটে। মানুষের মস্তিস্কের এই সাধারণ ধারণা উৎপাদন তথা চিন্তার সক্ষমতা আছে। এই চেতনার অস্তিত্ব তাই বস্তু থেকে আলাদাও নয়, আর বস্তুর অস্তিত্বও এই চেতনার উপর নির্ভরশীল নয়। অতএব বস্তু যা চিরকাল অস্তিত্বশীল ছিল এবং তা এখনো মানুষ ও তার চেতনা–স্বতন্ত্র বা নিরপেক্ষ স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল আছে। বস্তু তার মধ্যে সচেতনতার উন্মেষের বহুপূর্ব থেকে অস্তিত্বশীল ছিল, এমনকি প্রাণির (মানুষরূপী) মধ্যে চেতন–ক্ষমতার উন্মেষের পূর্বেও বস্তুর অস্তিত্ব বর্তমান ছিল। এই চেতনা প্রক্রিয়া বিলুপ্ত হলেও বস্তুর অস্তিত্ব থাকবে।
মার্ক্সবাদ বস্তুবাদের এই সাধারণ ভিত্তিকে সঠিক মনে করে, তবে মার্ক্সবাদ (দ্বান্দ্বিক–বস্তুবাদ ) মন, চেতনা, চিন্তা, ইচ্ছা, অনুভূতি অথবা সংবেদনের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে না।
দ্বান্দিক বস্তুবাদের মতে, জীবিত–মস্তিস্ক থেকে বিছিন্ন কোন চেতনা নেই,আর মস্তিস্ক নিজেই বস্তুগত দেহের একটি অংশ মাত্র। দেহ ছাড়া মনের অস্তিত্ব একটি অসম্ভবতা বা অর্থহীনতা মাত্র। বস্তু মন বা চেতনার উৎপাদ বা উপজাত নয় বরং চেতনা হল বস্তু থেকে উৎপাদ বা উপজাত বিষয়। ধারণাসমূহ আমাদের চারপাশের স্বাধীন (চেতনা নিরপেক্ষ) বস্তু –জগতের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়। দর্পনে প্রতিফলিত বস্তু তার অস্তিত্বের জন্য প্রতিফলিত প্রতিবিম্বের উপর নির্ভর করে না।
দ্বান্দিক বস্তুবাদ যা অস্বীকার করে তা হল, মন বা চেতনা নামক কোন সত্ত্বার দেহ–অতিরিক্ত ( দেহ–নিরপেক্ষ) কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে – এমন বক্তব্য।
এঙ্গেলসের ভাষায় , ‘সকল ধারণা অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া, যা বাস্তবতার সঠিক অথবা বিকৃত প্রতিফলন মাত্র।‘ অথবা মার্ক্সের ভাষায় বলা যায়, ‘জীবন চেতনা দিয়ে নির্ধারিত হয় না বরং চেতনাই জীবন দ্বারা নির্ধারিত হয়।‘
বস্তু ও চেতনার এই দ্বান্দিক সম্পর্কও একটি বাস্তবতা। আসলে দ্বান্দিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বস্তুর অস্তিত্ব চলমান।
৩। বস্তুবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
চেতনা নিরপেক্ষ বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করলেও, সকল বস্তুবাদী চিন্তা একই ধরণের নয়। তার মধ্যেও পার্থক্য আছে। বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গড়ে ওঠারও এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই ধারণা একদিনে গড়ে ওঠেনি। সমাজ, অভিজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক সত্য বিকাশের সাথে সাথে বস্তুবাদী চিন্তারও বিকাশ ঘটেছে। ইতিহাসের জানা মতে, প্রাচীন গ্রীসের এনাক্সোগোরাস ( খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ – ৪২৮ অব্দ) এবং ডেমোক্রিটাস ( খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ – ৩৭০ অব্দ) এর সময় থেকেই বস্তুবাদী ধারণার জন্ম হয়েছে । এ ছাড়া ভারতীয় দর্শনের একটা কাল বস্তুবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত, যেমন ছিলেন চার্বাক ও তাঁর মতাবলম্বীরা। তবে প্রাচীন গ্রীসের পতনের পর, এই যুক্তিভিত্তিক বস্তুবাদী দৃস্টিভঙ্গি একটি বিরাট ঐতিহাসিক কালপর্ব জুড়ে বিস্মৃতপ্রায় হয়ে যায়। এরপর খ্রিস্টীয় মধ্যযুগের পতনের পথ ধরে চিন্তার নবজাগরণের (রেনেসাঁ ) মধ্য দিয়ে দর্শন এবং প্রকৃতি-বিজ্ঞানের পূনর্জন্ম হওয়ার পরই কেবল এ দৃস্টিভংগীর পূন:আবির্ভাব ঘটে। সপ্তদশ শতক থেকে ইংল্যান্ড হয়ে ওঠে আধুনিক বস্তুবাদের নিজস্ব-ভূমি। মার্ক্স লিখেছেন, ‘ইংরেজ বস্তুবাদের যথার্থ আদি-পুরুষ হলেন বেকন।‘ ফ্রান্সিস বেকনের (১৫৬১ – ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দ) বস্তুবাদ, থমাস হবসের ( ১৫৮৮ – ১৬৭৯) হাতে সুশৃঙ্খল ও আরো বিকশিত হয়। হবসের ধারণাসমূহ জন লকের ( ১৬৩২ – ১৭০৪) হাতে আরো বিকাশ লাভ করে। জন লক ভাবতে পেরেছিলেন, বস্তর পক্ষে চিন্তার ক্ষমতাকে ধারণ করা সম্ভব। বুর্জোয়া বিকাশ ও বিজ্ঞানের মহৎ অগ্রগতি বিশেষতঃ বলবিদ্যা বা যন্ত্রকৌশলবিদ্যা, জোতির্বিজ্ঞান ও ঔষধ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানবচিন্তার সংগতিপূর্ণ অগ্রগতির সমগামীতা কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এই মহান চিন্তকদের ধারাবাহিকতায় অষ্টাদশ শতাব্দির মেধাবী ফরাসি বস্তুবাদী দার্শনিক সম্প্রদায় এক্ষেত্রে এক ব্যাপক-সাফল্য অর্জন করে, যাদের মধ্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রেনে দেকার্তে ( ১৫৯৬ – ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ)।
এদের এই বস্তুবাদী ও যুক্তিবাদী চিন্তা ১৭৮৯ সালের মহান ফরাসি বিপ্লবের মর্মবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। এ সকল বিপ্লবী চিন্তাবিদরা জগতবহির্ভূত বা বাহ্যিক-জগতাতিরিক্ত কোনপ্রকার কর্তৃত্ব স্বীকার করতেন না। ধর্ম থেকে প্রকৃতি-বিজ্ঞান, সমাজ থেকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান – এককথায় সকলকিছুকেই এরা অনুসন্ধানী সমালোচনার (বিচার-বিশ্লেষণ) বিষয়ে পরিণত করেছিলেন। যুক্তি হয়ে ওঠে সবকিছুর মাপকাঠি বা মানদন্ড।
এ বস্তুবাদী দর্শন তার ধারাবাহিকতায় হলবাখ (P H T Holbach) ( ১৭২৩ -১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দ) ও হেলভেটিয়াসের (Jean Claude Adrien Helvétius, 1715—1771) হাতে আরও অগ্রসর দর্শনে উন্নীত হয়। হলবাখ লিখলেন ‘বিশ্বব্রহ্মান্ড হলো সকলকিছুর (সকল পদার্থের) এক ব্যাপক ঐক্য। কাজেই, সর্বক্ষেত্রে এটি আমাদের কেবল গতির মধ্যেকার বস্তু বা গতিশীল বস্তুরই মুখোমুখি করে।‘ তিনি আরো বলেন, ‘এই হ’ল সবকিছু যা সেখানে আছে, এবং এ প্রকাশিত হয় এক অন্তহীন ধারাবাহিক কারণ-কার্য শৃংখলে; এ কারণের কিছু কিছু আমরা জানতে পারি ,যখন তারা সরাসরি আমাদের সংবেদনে আঘাত করে, অন্য কারণসমূহকে আমরা জানতে পারি না কারণ, তারা প্রথমতঃ – কারণ থেকে বহুদূরে থেকে পরিণতিমূলক ঘটনাসমূহের সাহায্যে আমাদের উপর ক্রিয়াশীল হয়।‘
এ যৌক্তিক-দর্শন ছিল গীর্জা, অভিজাততন্ত্র ও চরম রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবী বুর্জোয়াদের লড়াই-সংগ্রামের একধরণের মতাদর্শগত প্রতিফলন। এটি পুরোনো -বিধিব্যবস্থা ও মতাদর্শের উপর প্রচন্ড আক্রমণের প্রতিনিধিত্ব করে। শেষ পর্যন্ত যুক্তির সাম্রাজ্য, বুর্জোয়াদের সাম্রাজ্যের আদর্শগত প্রকাশে পরিণত হয়। অর্থাৎ যুক্তির-রাজ্য বুর্জোয়া-রাজ্যের আদর্শগত প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। বুর্জোয়াদের সম্পত্তির অধিকার পরিণত হয় মানুষের অন্যতম অনিবার্য বা আবশ্যকীয় অধিকারে। বিপ্লবী বস্তুবাদীরা নতুন বুর্জোয়া সমাজের পথকে প্রশস্ত করে এবং ব্যক্তি-সম্পত্তির কর্তৃত্বকে প্রাধান্য প্রদানকারী নতুন সমাজ-কাঠামো গড়ে তোলে। ডেনিস দিদরোর বিখ্যাত উক্তি, ‘ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন পরিস্থিতিতে বা পারিপার্শ্বিকতায়, ভিন্ন ভিন্ন দর্শন।‘
অর্থাৎ দর্শন ইতিহাসের নিরিক্ষায়,তা নির্দিষ্ট বাস্তবতায় একটি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে।
দর্শনের বা চিন্তার বিকাশ ইতিহাস আর বাস্তব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকাশমান।
৪। দ্বান্দিক বস্তুবাদের মৌলিক নিয়মাবলিঃ
এঙ্গেলস তাঁর এন্টি-ড্যুরিং বইতে এবং পরবর্তিকালে ‘প্রকৃতিতে দ্বান্দিকতা’ বইএ দ্বান্দিক বস্তুবাদের তিনটি মৌলিক প্রতিপাদ্য নির্দেশ করেছেন সেগুলি হলো,
(ক) পরিমাণ থেকে গুণে (quantity to quality) ( এবং বিপরিতক্রমে) পরিবর্তনের নিয়মঃ
পরিবর্তনকে উপলব্ধি করার এটি হল মূল ভিত্তি। পরিবর্তন বা বিবর্তন ধারাবাহিকভাবে কোন মসৃণ একরৈখিক সরল পথে চলে না। মার্ক্স সামাজিক বিবর্তনকে মাটির নিচে ব্যস্তভাবে গর্ত খোঁড়ায় রত এক বৃদ্ধ ছুঁচোর ( গন্ধমুষিক ) কাজের সাথে তুলনা করেছেন, যা দীর্ঘসময় চোখের আড়ালে থাকে কিন্তু লাগাতারভাবে পুরাতন ব্যবস্থার তলদেশে খননের কাজ চালাতেই থাকে, অবশেষে এক সময়ে হঠাৎ করে সবকিছু উল্টে দিয়ে চোখের সামনে তা উদ্ভাসিত হয়। এমনকি চার্লস ডারউইনও মনে করতেন তার বিবর্তনবাদী তত্ত্ব আবশ্যিকভাবে ধারাবাহিক এবং এ কারণে ফসিলের দালিলিক প্রমাণের মধ্যকার ফাঁকসমূহ তার বিবর্তনবাদে কোন বিচ্ছিন্নতা বা ছেদ তৈরী করে বলে তিনি ভাবতেন না। বরং তিনি মনে করতেন ভবিষ্যৎ আবিষ্কার এ ফাঁকসমূহ পূরণ করবে। এ ক্ষেত্রে ডারউইন ভ্রান্ত ছিলেন। বর্তমানে নতুন মতবাদসমূহ যা আবশ্যিকভাবে দ্বান্দ্বিক তাদের সাহায্যে বিবর্তনের ধাপসমূহ ব্যাখ্যায় ব্যবহার করা হয়। স্টিফেন জে গৌল্ড এবং নিলস্ এ্যলড্রেজ তাদের বিবর্তনের দ্বান্দ্বিক মতবাদের নাম দিয়েছেন ‘ধাক্কার মাধ্যমে সমতা’ বা ‘Punctuated Equilibria’ তত্ত্ব। তারা ব্যাখ্যা করেছেন যে বিবর্তনের একটি বিশাল কালপর্বে দৃশ্যযোগ্য কোন পরিবর্তন সংঘটিত হয় নাই, তারপর হঠাৎ করে একটি নতুন জীবন-আকার বা আকারসমূহের উন্মেষ ঘটে। অন্য কথায় পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত রূপান্তরে উর্ত্তীর্ণ হয়েছে ; যা নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটানোর উদ্দেশ্যসাধন করেছে। সমগ্র বিকাশ প্রক্রিয়া বৈশিষ্ট্য হ’ল ধারাবাহিকতার মধ্যে ছেদ, উল্লম্ফন, আকস্মিক বিপর্যয় এবং বিপ্লবসমূহ।
প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন বৎসর পূর্বে পৃথিবীর মহাসাগর সমূহে এক-কোষি প্রাণের উদ্ভব ছিল বস্তুর বিবর্তনের একটি গুণগত উল্লম্ফন। প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে ‘কেমব্রিয়ান বিস্ফোরণ’ এর মাধ্যমে শক্তঅংশবিশিষ্ট জটিল-বহুকোষী-প্রাণের দৃশ্যপটে উদ্ভব হওয়া ছিল বিবর্তনের অগ্রযাত্রায় আর একটি গুণগত উল্লম্ফন। নিম্নস্তরের পুরাজীবিয় যুগে, ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে, প্রথম মেরুদন্ড-সম্পন্ন মাছের উদ্ভব ঘটে। এ বিপ্লবী নকশা (মেরুদন্ডি-জীব-কাঠামো) প্রাধান্যবিস্তারকারী হয়ে ওঠে এবং উভচর প্রাণীর (যারা একইসাথে জলে এবং ডাঙ্গায় বাস করতে পারে) মধ্যদিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকে, সরসৃপের মধ্যদিয়ে শেষপর্যন্ত উষ্ম-রক্তসম্পন্ন প্রাণী-গোষ্ঠি, পাখি ও স্তন্যপায়ীজীবের উদ্ভব ঘটায়। এ সকল বিপ্লবী উল্লম্ফনসমূহ চরম পর্যায়ে চিন্তা করার ক্ষমতা আছে এমন প্রাণী, মানবপ্রজাতির উদ্ভব ঘটায়। বিবর্তন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া যেখানে বাহিরের ও ভিতরের অসংখ্য পরিবর্তনের সমন্বয়ের মধ্যদিয়ে জীবের ক্ষেত্রে গুণগতভাবে অপেক্ষাকৃত উন্নত বিকাশস্তরে উল্লম্ফন ঘটে।
বিষয়টি শুধু জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নয়, এই নিয়ম পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পদার্থবিজ্ঞানের পর্যায় রূপান্তর বা phase transition এর এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাছাড়া, বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির তত্বের প্রতিটি স্তরে রয়েছে পর্যায় রূপান্তরের নিয়ম। শক্তি থেকে ভরবিশিষ্ট কণার উৎপত্তি এই ‘পরিমাণ থেকে গুণে রূপান্তরের’ নিয়মটাকেই প্রতিষ্ঠিত করে।
মার্ক্স জোর দিয়ে বলেছেন বিজ্ঞানের কাজ হ’ল সদা-সর্বদা পরিদৃশ্যমান-জগতের তাৎক্ষণিক-জ্ঞান থেকে প্রকৃত-বাস্তবতা, সারবস্তু, পরিদৃশ্যমান জগতের আড়ালে লুকানো নিয়মসমূহের আবিস্কারের দিকে অগ্রসর হওয়া। মার্ক্সের ক্যাপিটাল গ্রন্থে, এ পদ্ধতির ব্যবহারের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। মার্ক্স ‘অমার্জিত (vulger) অর্থনীতিবীদদের চিন্তা প্রক্রিয়া’ সম্পর্কে এঙ্গেলসেকে লিখেছেন, ‘এগুলি হল সেই সকল ঘটনা থেকে অনুসৃত যেগুলি কেবলমাত্র মস্তিস্কে প্রতিফলিত তাৎক্ষণিক আকারে প্রতিভাত সম্পর্কমাত্র, কিন্তু তাদের অন্তস্থ সম্পর্কসমূহ নয়।‘ ( জুন ২৭, ১৮৬৭)
(খ) বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রামঃ
দ্বন্দ্বকে ধারণ করে কেবল ততক্ষণই তার মধ্যে গতি, শক্তি এবং কার্যকারিতা থাকে ( হেগেল )।
লেনিন বলেন ‘সংক্ষেপে দ্বান্দ্বিকতাকে বিরোধের ঐক্য বিষয়ক তত্ব হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, এর মধ্যই দ্বন্দ্ববাদের সারমর্ম রয়েছে।‘
আমরা যে জগতে বাস করি তা হ’ল দ্বন্দ্ব বা বিরোধের ঐক্য অর্থাৎ এদের একত্রে অবস্থান; ঠান্ডা-গরম, আলো-আধাঁর, পুজিঁ-শ্রম, জন্ম-মৃত্যূ, ঐশ্বর্য-দারিদ্র, সদর্থকতা-নঞর্থকতা, উত্থান-পতন, চিন্তা-সত্তা, সসীম-অসীম, আকর্ষণ-বিকর্ষণ, কণা-তরংগ, ডান-বাম, উপর-নিচে, বিবর্তন-বিপ্লব, আকস্মিকতা-অনিবার্যতা, ক্রয়-বিক্রয় এবং এধরনের আরো অন্যান্য বিরোধসমূহ।
ঘটনাটি হ’ল দ্বন্দ্ব বা বিরোধপূর্ণ কোন বিষয়ের দুই বিপরিত মেরুর একত্রিত উপস্থিতি বা সহাবস্থান করতে পারে এমন বিষয় প্রচলিত সমস্ত ধীশক্তির( জ্ঞান-কঠামো) কাছে একটি কূটাভাস হিসাবে পরিগণিত হয়। এ কূটাভাস হ’ল বিপরিত দ্বন্দ্ব বা বিরোধের উভয়ই সত্য হতে পারে এমন বিবেচনার একপ্রকার স্বীকৃতি। এটি হ’ল বস্তু-জগতের মধ্যকার বিপরিতের ঐক্যের চিন্তাগত প্রতিফলন।
গতি, দেশ এবং কাল বস্তুর অস্তিত্বের ধরণ বা ভঙ্গি ছাড়া আর কিছু নয়। গতিকে আমরা যেভাবে ব্যখ্যা করি তা আসল এক ধরণের বিরোধ। একই সময়ে কোন কিছুর একই স্থানে থাকা এবং অন্য কোন স্থানে অবস্থান করা। এটি এক ধরনের বিপরিতের ঐক্য। ‘অবস্থান পরিবর্তন অর্থ হ’ল একই সাথে কোন স্থানে থাকা এবং না থাকা, এ হ’ল দেশ এবং কালের ধারাবাহিকতা, এ হ’ল তাই যা প্রথমত গতিকে সম্ভব করে। ( হেগেল)
লেনিন এ স্ব-গতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তার একটি নোটে লেখেন, ‘দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি হ’ল সেই শিক্ষা যা দেখায় কিভাবে এবং কেন বিপরিতসমূহ পরস্পর তদ্মাত্যিক ( একানুরূপ ) হতে পারে বা হয়ে থাকে, কোন শর্তের অধীনে তারা তদাত্মবোধক হয়, একটি অন্যটিতে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে, কেন মানব মন এ সকল বিরোধকে মৃত, অপরিবর্তনীয় হিসাবে না দেখে জীবন্ত, শর্তমূলক, গতিশীল বা পরিবর্তনশীল পরস্পর রূপান্তরযোগ্য এমন বিষয় হিসাব ধরতে পারে।‘
লেনিন বিকাশের সঞ্চালক শক্তি হিসাবে দ্বন্দ্বের বা বিপরিতের গুরুত্বের বিষয়টির উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন, ‘এটি সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে, যে কোন সমাজের কিছু সদস্যের বা মানুষের সংগ্রাম অন্য কিছু সদস্যের বা মানুষের সংগ্রামের সাথে বিরোধাত্মক হয়ে থাকে, সমাজ জীবন দ্বন্দ্ব বা বিরোধে পরিপূর্ণ এবং ইতিহাস হ’ল জাতিতে জাতিতে ও সমাজের সাথে সমাজের সংগ্রাম, সাথে সাথে জাতি ও সমাজের নিজেদের অন্ত:স্থ সংগ্রামের বিষয়টির অনাবৃত বা প্রকাশ্য রূপ, পাশাপাশি এ হ’ল বিপ্লব ও প্রতিক্রিয়াশীলতা, যুদ্ধ ও শান্তি, স্থবিরতা এবং দ্রুত প্রগতি অথবা ধ্বংসের, পর্যায়ক্রমিক সময়ের অনুবর্তনের প্রকাশ।‘ (তিনটি অঙ্গ তিনটি উৎস; লেনিন)
(গ) নেতির নেতিকরণঃ
ইতিহাসের বিকাশধারার সাধারণ ভঙ্গি বা বিন্যাস কোন সরলরৈখিক অগ্রগতি বা উর্ধ্বগতি নয় । বরং এ হ’ল এক জটিল মিথস্ক্রিয়া যেখানে কেবলমাত্র আংশিক পশ্চাদাপসারণের মাধ্যমেই অগ্রগতি অর্জিত হয়। এ পশ্চাদগতিসমূহ,পরবর্তী বিকাশস্তরসমূহের পালাক্রমিক প্রতিক্রিয়া।
নেতির নেতিকরণের নিয়মটি কোন ঘটনা বা গুণাবলীর উচ্চতর স্তরে নিম্নতর স্তরের পুনরাবৃত্তিকে ব্যাখ্যা করে এবং অতীত ঘটনাসমূহের প্রত্যাবর্তনকে প্রতীয়মান করে তোলে। প্রতিনিয়ত আকারের সাথে উপাদানের এবং উপাদানের সাথে আকারের মধ্যকার চলমান সংগ্রামের পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত পুরাতন আকার ভেঙ্গে পড়ে এবং উপাদানের রূপান্তর ঘটে এবং তার নতুন রূপ বিকশিত হয়। কোনো কিছু পরিবর্তন হলে তা পুরনো অবস্থানে ফিরে যাওয়া নয়, তা আর একটি নতুন অবস্থান, তাঁকে সেই অর্থে দার্শনিক দৃষ্টিতে পশ্চাদপসরণও বলা চলে না।
৫। দ্বান্দিকতা ও অধিবিদ্যাঃ
অন্যান্য যান্ত্রিক বস্তুবাদের (vulgur materialism) থেকে দ্বান্দিক বস্তুবাদ বা মাক্সীয় দর্শনের পার্থক্য রয়েছে। মার্ক্সীয় বিশ্ববিক্ষা বা বিশ্বদৃষ্টিভংগী কেবল শুধুমাত্র বস্তুবাদী নয়, দ্বান্দ্বিকও বটে। সরলভাবে বললে, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি হল বাস্তব ও পরস্পর-নির্ভরশীল জগতকে আরো বেশি পরিপূর্ণভাবে জানা-বোঝার একটি প্রক্রিয়া। দ্বান্দ্বিকতা প্রসঙ্গে এঙ্গেলস তাঁর এন্টি-ডুরিং বই এ লিখেছেন , ‘এটি প্রকৃতি এবং মানবীয় সমাজ ও চিন্তার গতি ও বিকাশের সাধারণ নিয়মসমূহের বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছু নয়। অতি সহজে বলা যায় , এটি হল গতির যুক্তিবিজ্ঞান।‘ এর সমালোচকগণ দ্বান্দ্বিকতাকে একটি সম্পূর্ণ রহস্যাবৃত তথা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় হিসাবে চিত্রিত করে থাকেন। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে কোন অর্থেই ঘটনাটি তা নয়। বরং দ্বান্দিকতা সমাজ, ইতিহাস, এমনকি প্রকৃতিতেও সর্বব্যাপী। মানুষের আবিষ্কৃত তত্ব ও তার বিকাশের সঙ্গে তা প্রতিনিয়ত সংগতিপূর্ণ ও সমান্তরাল।
প্রকৃতিতে দ্বান্দ্বিকতা ( Dialectics of Nature ) পুস্তকে এঙ্গেলস পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার যে সম্বৃদ্ধ ও চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন তা এখানে তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন,
‘ এ হচ্ছে পদার্থের গতির একটা চিরন্তন চক্র। এই চক্র অবশ্যই তার কক্ষ সম্পূর্ণ করে এমন এক পর্বকালে যার পরিমাপ করার জন্য আমাদের জাগতিক বৎসর মোটেই যথেষ্ট নয়। এই চক্রে সর্বোচ্চ বিকাশের কালটুকু,অর্থাৎ জৈবজীবনের কালটুকু, এবং ততধিক, আত্ম–চেতন ও প্রকৃতি–চেতন জীবের জীবনকালটুকু ঠিক তেমনি নগণ্য, যেমন নগণ্য সে জীবন ও চৈতন্যের ক্রিয়াক্ষেত্রটুকু। এই চক্রে পদার্থের অস্তিত্বের প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট রূপ, তা সে সূর্যই হোক বা নীহারিকা হোক, স্বতন্ত্র কোন প্রাণীই হোক আর প্রাণী–প্রজাতিই হোক, রাসায়নিক সংযোজনই হোক আর রাসায়নিক বিভাজন হোক, সবই সমান ক্ষণস্থায়ী ; সেখানে চিরন্তনভাবে পরিবর্তনশীল। চিরন্তনভাবে গতিশীল পদার্থ এবং তার গতি ও পরিবর্তনের নিয়মগুলি ছাড়া কিছুই চিরন্তন নয়। কিন্তু স্থান ও কালের দিক থেকে যতবারই এবং যত নির্মমভাবেই এই চক্রটি পরিপূর্ণ হোক না কেন, যত কোটি সূর্য ও পৃথিবীর উদ্ভব ও বিলোপ হোক না কেন, কোন সৌরজগতের কোন একটি মাত্র গ্রহেও জৈবজীবনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যত দীর্ঘ সময় লাগুক না কেন, স্বল্প কালের মত একটা প্রণোপযোগী পরিস্থিতি পেয়ে জীবের মধ্য থেকে চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মস্তিস্কযুক্ত প্রাণীর বিকাশ ও পরে তেমনি নির্মমভাবে ধ্বংস হবার আগে যত অসংখ্য রকমের জীবের আবির্ভাব ও তিরোভাব হোক না কেন, – এই বিষয়ে আমরা নিশ্চিত যে, এই সমগ্র রূপান্তরের মধ্যে পদার্থ চিরকালই একই রকম থেকে যায়, তার কোন ধর্মই কোনদিন নষ্ট হতে পারে না, এবং সেই জন্যই যে অমোঘ আবশ্যিকতায় তা এই পৃথিবীতে চিন্তাশীল মন বা আত্মারূপ, তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে নিশ্চিহ্ন করবে, ঠিক সেই একই আবশ্যিকতায় তা অন্য কোন স্থানে, অন্য কোন কালে অবশ্যই তার ( অনুরূপ ঘটনার) উদ্ভব ঘটাবে।‘
৬। আধুনিক বিজ্ঞান দ্বান্দিক বস্তুবাদকে আরও সমৃদ্ধ করছেঃ
এঙ্গেলেস এর সময়কালে আবিষ্কৃত বিজ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি যে সিদ্ধান্ত টেনেছেন তা এক অসাধারণ দার্শনিক অভিব্যক্তি। যে সময়ে তিনি এই মতটি লিখেছেন, তখন বিজ্ঞানের বর্তমান অগ্রগতি হয়নি। আবিষ্কৃত হয়নি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা, বা কোয়ান্টাম গতিবিদ্যা, পরমাণুর গঠনরূপ বা পারমাণবিক প্রক্রিয়ার তত্ব, আদি বস্তুকণা বা বিপরীত আদি বস্তুকণা, আবিষ্কার হয়নি অনিশ্চয়তা সূত্র, কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রো-ডাইনামিক্স, কোয়ান্টাম ক্রোমো ডাইনামিক্স, কোয়ার্ক বা স্ট্যান্ডার্ড মডেল, বিগ ব্যাং তত্ব বা ব্ল্যাক হোল। মানুষ তখনও জানতো না ভর এবং শক্তির মধ্যে গাণিতিক সম্পর্ক। বস্তুর কণা এবং তরংগ রূপ। অর্থাৎ বস্তুর কণা এবং তরঙ্গ উভয় রূপ হতে পারে। আবিষ্কার হয়নি বস্তুর রূপান্তরের এত পরিশীলিত তত্ব। এই সকল আবিষ্কার প্রকৃতিতে দ্বন্দবাদের রূপকে আরও গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রাণ রসায়নের অনেক আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে নিষ্প্রাণ জড় থেকে প্রাণ সঞ্চারের যে সকল পরীক্ষিত তত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে, তা দিয়ে দ্বান্দিক বস্তুবাদের মৌলিক নিয়মাবলি ভুল নয় আরও সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এর পরও বিতর্ক আছে, থাকবে। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সঙ্গে সংগে দার্শনিক এই মতবাদ আরও পরিশীলিত হবে, বিকশিত হবে এটাই দ্বান্দিক বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক মর্মবস্তু। এটা স্থির অনড় এবং চুড়ান্ত নয়। দ্বান্দিক বস্তুবাদী দর্শনের এটা শক্তিশালী ভিত্তি। সাথে সাথে এটাও দৃঢ়তার সঙ্গে বলা সম্ভব যে, বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারই অধিবিদ্যক দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করছে না।
দাদা, লেখাটিতে দার্শনিক বিষয়টি খুবভালো এসেছে। আশা করি ভবিষ্যতে তার জীবনের অন্যান্য দিকগুলো নিয়ে আরো লিখবেন। এই লেখার জন্য ধন্যবাদ।