১। ভূমিকাঃ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১০-১২ জানুয়ারী ভারত সফর করেন। এই সফরে ৫১ দফার একটি স্মারক ঘোষণা হয়। এই ঘোষণার ৩৫ ধারা অনুসারে ২০১০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী, দু’দেশের সংশ্লিষ্ট সচিবরা একটি সমঝোতা স্মারক (MoU) সই করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারী, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (BPDB) এবং ভারতের এন টি পি সি (NTPC) ‘বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী বিদ্যুত কোম্পানি’ নামে খুলনা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য একটি যৌথ উদ্যোগ চুক্তি স্বাক্ষর করে। প্রকল্পটি ঘোষণার পরপরই এর পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনা এবং আন্দোলনও শুরু হয়েছে। প্রথম থেকেই এই আন্দোলন তেল গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃত্বেই হয়েছে। মূলতঃ এর নেতৃত্বে ছিলেন বিভিন্ন বামপন্থী দল, বুদ্ধিজীবি ও পরিবেশবাদী সংগঠন ও বেসরকারী সংস্থা। এই আন্দোলন ও আলোচনা দেশের বাইরে বিদেশেও বিস্তৃত হয়েছে। এ সম্পর্কিত কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি বি এন পি এই প্রকল্প বন্ধ করার জন্য আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ায় বিষয়টির একটি রাজনৈতিক মেরুকরণের অবস্থা তৈরি হয়েছে। সকল আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে যে বিষয়গুলো প্রকল্পের পক্ষ বিপক্ষ হিসেবে সামনে এসেছে, তার সার-সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়- (এক) দেশের উন্নয়ন তথা শিল্পায়নের স্বার্থে বিদ্যুতায়নের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য আর সেজন্য এই প্রকল্পের কোন বিকল্প নাই। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে-তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি এই প্রকল্প বিরোধীতাকারীদের বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন, রাজনৈতিক আক্রমনও করেছেন। তাঁর মতে, এই প্রকল্পের প্রযুক্তিগত মান যথেষ্ট উন্নত এবং তা সুন্দরবনের বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবেশের উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেছেন, আন্দোলনকারীরা দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতেই এই আন্দোলন করছে। বিশেষ করে বি এন পির আন্দোলনের ঘোষণাকে তিনি তীব্র ভাষায় আক্রমন করেছেন এবং তেল-গ্যাস-রক্ষা জাতীয় কমিটিকে বি এন পির আন্দোলনের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি এও বলেছেন, এই প্রকল্প স্থাপনার ফলে দেশের সার্বিক বিদ্যুৎ ঘাটতিতে সমূহ ভূমিকা রাখবে, পাশাপাশি এর ফলে এ এলাকার পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও আর্থিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।
(দুই) সুন্দরবন, তার জীববৈচিত্র ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ রক্ষা করতে এই প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। কারণ, সুন্দরবন শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে সংরক্ষিত এলাকা নয়, বরং এই প্রাকৃতিক বনভূমি গোটা বদ্বীপের জন্যেই প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ। তাই, উন্নয়নের নামে এই প্রাকৃতিক সম্পদ ধংসের আশু বা দীর্ঘমেয়াদী কোন ক্ষতির সম্ভাবনার ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। (তিন) এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে ভারতীয় আধিপত্যের প্রবেশ ঘটছে এবং এই প্রকল্প জাতীয় স্বার্থবিরোধী। (চার) যেকোন কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশ দূষণকারী বিধায় কয়লা নির্ভর কোন বিদ্যুত বাংলাদেশে তৈরী উচিত নয় বা করা যাবে না। আলোচনা, সমালোচনা, আন্দোলন সবকিছুর সারসংক্ষেপ করলে মূলতঃ এই চারটি বিষয়ই প্রধান হয়ে আসে। এর মধ্যে প্রথম বক্তব্যটি সরকারের পক্ষে বা প্রকল্পের পক্ষে বলা চলে।পরবর্তী তিনটি বক্তব্য প্রকল্পবিরোধী। যদিও তিনটি বক্তব্যের মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য রয়েছে। কোন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে সকল বক্তব্যের বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিসংগত বিবেচনা থাকা উচিত।কারণ, প্রকল্পটি শুধুমাত্র একটি প্রকল্প নয়-এর সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতি, দেশের তথা এই অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপট রয়েছে। এমনকি রয়েছে রাজনৈতিক মেরুকরণের উপাদান। ফলে, যে কোন ধরণের একদিকদর্শি চিন্তা বা প্রয়াস সামগ্রিকভাবে জাতীয় স্বার্থবিরোধী অবস্থা তৈরী করতে পারে। ঘোলাজলে মাছ শিকারের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির অনুঘটনকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পৃথিবীর বহুদেশে এর উদাহরণ রয়েছে।
২। প্রকল্পের প্রেক্ষাপট
দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে সহনীয়, টেকসই (sustainable) প্রযুক্তির বিরামহীন বিদ্যুৎ সরবরাহের কোন বিকল্প নাই। কোন দেশ এই বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়টি কতটা উন্নত প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব করতে পেরেছে তার উপর নির্ভর করেছে তার উন্নয়ন মাত্রা। এটা আজ সর্বজনবিদিত যে, উন্নত দেশগুলিতেও তাদের উন্নয়নে শক্তির উৎস ব্যবহারে প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি বা ধ্বংসের সমালোচনা উঠেছে। সেখানেও নানা ধরণের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। মুনাফার লোভে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস বা ক্ষতি করার উদাহরণ পৃথিবীতে কম নেই। সেজন্যে বিশ্বব্যাপীই শক্তির উৎসকে আরো উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর, পরিবেশবান্ধব ও ঝুঁকিহীন করার দাবী রয়েছে। সমগ্র মানবজাতির জন্যই এটা আজ একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ নিয়ে মতভেদও রয়েছে প্রচুর। বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে কার্বন নিঃসরনের মাত্রা এখন এমন বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে- তা বিশ্ববিবেকের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। সবচাইতে শক্তিশালী ও বৃহৎ অর্থনীতির দাবীদাররাও তাদের উন্নয়নের চাপে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে বাধ্য হচ্ছে। বৈশ্বিক এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই জাতীয় ক্ষেত্রে উন্নয়ন ভাবনাকে এগিয়ে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়।সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের কথা বলছে। সরকার আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সকল জনগনের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের হিসেব মোতাবেক বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। কিন্তু মাথাপ্রতি বিদ্যুতের পরিমান মাত্র ২৭২ কিলোওয়াট-ঘন্টা। সরকারের ভাষ্যমতে, ২০১৭ সালের মধ্যে দেশে ১৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই প্রয়োজন বা দাবী পৌঁছাবে প্রায় ৩৪০০০ মেগাওয়াট। সরকার পি এস এম পি (Power System Master Plan-2010)-২০১০ এ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্যাস নির্ভরতা কমিয়ে অন্ততঃ ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন কয়লানির্ভর করার পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনা রেখেছে। এই পরিকল্পনামতে এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় ও আমদানীজাত কয়লার উপর নির্ভর করতে হবে। আর তার ফলশ্রুতিতে পরিবেশ দূষণের চাপ এসে যাবে সন্দেহ নাই। সরকারের এই পরিকল্পনা যুক্তিযুক্ত বা বিজ্ঞানসম্মত কিনা বা তা সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন করার সামর্থ্য বা সদিচ্ছা আছে কিনা, সে বিতর্কে না যেয়ে শুধুমাত্র প্রেক্ষাপট বিবেচনায় উপাত্তগুলি তুলে ধরা হলো। এই সার্বিক পরিকল্পনার অংশহিসেবে সরকারের দু’টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রস্তাবনা রয়েছে। একটি খুলনা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প (নির্মানের প্রাক্কলিত ব্যয় ১৪৫.১ বিলিয়ন টাকা), অন্যটি মাতারবাড়ি ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্প (নির্মানের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৬০ বিলিয়ন টাকা)। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে প্রথমটি ‘সুপারক্রিটিক্যাল পাল্ভারাইজড কোল জেনারেটর’ দ্বিতীয়টি ‘আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল পাল্ভারাইজড কোল জেনারেটর’। দেখাই যাচ্ছে, দ্বিতীয়টির নির্মান ব্যয় প্রথমটির চেয়ে অনেক বেশী। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়-পৃথিবীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই দুটি প্রযুক্তিই ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে, অনেকক্ষেত্রে কার্বন-অক্সাইড এবং সালফার অক্সাইড সহ অন্যান্য উড়ন্ত উৎপাদ (Flue product) সহনীয় মাত্রায় রাখার জন্যে আরো কিছু প্রযুক্তি এর সঙ্গে সন্নিবেশিত হচ্ছে। আলোচিত ‘রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পটি আসলে খুলনা -১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামান্তর। প্রসংগক্রমে বলা ভালো, এই প্রকল্পটির স্থান হিসেবে যে দুটি এলাকা IEE (Initial Environmental Examination) তে বিবেচনা করা হয়েছিল, তারমধ্যে একটি খুলনার বটিয়াঘাটা এলাকার লবনচোরা, আরেকটি বর্তমান প্রস্তাবিত রামপাল উপজেলার অন্তর্গত সাপমারি কাটাখালি এলাকা। প্রথমটির সুন্দরবন থেকে নিকটতম দূরত্ব হলো ৩৩ কিলোমিটার, দ্বিতীয়টির ১৪ কিলোমিটার। মধ্যবর্তি কোন স্থান বিবেচনা করা হয়নি।
৩। প্রস্তাবিত প্রকল্পের স্থান সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক বিবেচনা ও বিতর্কঃ
প্রকল্পের স্থান বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের সাপমারি কাঁটাখালি ও কৈঘর দাসকাটি মৌজার অন্তর্গত। মোট জমির পরিমাণ ১৮৩৪ একর। স্থানটি খুলনা শহর থেকে ২৩.৩৩ কিলোমিটার দক্ষিণ এবং সংরক্ষিত সুন্দরবনের সীমানা থেকে নিকটতম দুরত্ব ১৪ কিলোমিটার উত্তরে। রামপাল সদর উপজেলা থেকে ১১.৫ কিলোমিটার পশ্চিম ও প্রস্তাবিত খানজাহান আলী বিমানবন্দর থেকে ১২.১২ কিলোমিটার দক্ষিন-পশ্চিমে। মোংলা পোর্ট থেকে ১৪.১৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম এবং নেভাল পাইলট স্টেশন থেকে মাত্র ৯.৭৬ কিলোমিটার উত্তরে। খুলনা-মোংলা মহাসড়ক থেকে ১৪.৪৬ কিলোমিটার পশ্চিম এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে ৬৭ কিলোমিটার উত্তরে। প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র এ্যাংকর থেকে ৭০ কিলোমিটার, ইউনেস্কো ঘোষিত সুন্দরবনের ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ সীমানা থেকে ৬৯.৬ কিলোমিটার এবং হিরন পয়েন্ট থেকে ৯৭ কিলোমিটার উত্তরে। নির্ধারিত স্থানের কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ, স্থান ও সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বনের দূরত্বের জন্য স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সুন্দরবনের মত অতি স্পর্শকাতর একটি প্রাকৃতিক সম্পদের এত কাছে এ ধরণের একটি মেগা প্রজেক্ট স্থাপনের আগে নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক বিবেচনা নেয়া হয়েছে কিনা। অর্থাৎ সুন্দরবন থেকে এই দূরত্বে প্রস্তাবিত এই প্রকল্প স্থাপন দেশিয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও বিধিনিষেধের (ECR-Environmental Conservation Regulation-97), ECA-Environmental Conservation Act-95, UNESCO declaration for world Heritage) প্রেক্ষিতে কতটা যুক্তযুক্ত? এই ধরণের মেগাপ্রকল্প স্থাপনার ফলে, আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর উপর আশু ও দীর্ঘমেয়াদী কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে, তার অনুপুঙ্খ বৈজ্ঞানিক বিবেচনা করা হয়েছে কিনা? ECA-95 ও ECR-97 এর বিধি অনুসারে, Environmental Critical Area র ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে রেড ক্যাটেগরির কোন স্থাপনা নির্মান নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রস্তাবিত স্থান Ecological Critical Area র বাইরের সীমানা থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আইনের দৃষ্টিতে বা তর্কের খাতিরে এ স্থাপনাকে বেআইনি বলা চলে না। কিন্তু যে বৈজ্ঞানিক বিবেচনায় এই দূরত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে, তার মর্মবস্তুর দিক দিয়ে এই দূরত্ব কখনই যথাযথ নয়। পরিবেশের উপর প্রভাবের বিষয় বিবেচনা করলে ১০ কিলোমিটার বা ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে খুব পার্থক্য হয় না। সেজন্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিরাপদ দূরত্ব ধরে নেয়া যায়। সেই বিবেচনায় এই নির্মানের স্থান নির্ধারণ করা উচিত। তাই প্রকল্পের স্থানটি সুন্দরবনের নিকটতম সীমানা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে নির্ধারণ করলে এ সম্পর্কীয় বিতর্কের অবসান হতে পারে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে বিবেচ্য তাহলো, প্রকল্পের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা কতটুকু?
৪। এক নজরে প্রকল্পের প্রযুক্তিগত দিকঃ
প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্পটি একটি ‘রেড-ক্যাটেগরি, ক্লাশ ডি’ প্রকল্প। আগেই বলা হয়েছে-এটি একটি ‘সুপার-ক্রিটিক্যাল পাল্ভারাইজড কোল প্ল্যান্ট’। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধানতঃ তিনটি প্রযুক্তি রয়েছে। (এক)সাব-ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট (দুই) সুপার-ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট (তিন) আল্ট্রা-সুপার-ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। সাব-ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রযুক্তি এখন আর ব্যবহার হয় না। এদের দক্ষতা মাত্রা কম এবং ক্ষতিকারক গ্যাস (NOx, COx) উদগীরণ মাত্রা বেশী। সুপার-ক্রিটিক্যাল ও আল্ট্রা-সুপার-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিই বেশী ব্যবহৃত হচ্ছে। এর সংগে FGD ( Flue Gas desulfurization) এবং SCR (NOx) পরিশোধন প্রযুক্তি অঙ্গীভূত হয়েছে- যার ফলে পরিবেশ সংরক্ষণের উচ্চমাত্রা অর্জিত হয়েছে বলে-প্রযুক্তিগত দাবী রয়েছে।রামপাল (খুলনা) প্রকল্পে ব্যবহৃত প্রযুক্তির প্রধান প্যারামিটারগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ১৩২০ মেগাওয়াট (১০০ শতাংশ কর্মদক্ষতায়), কার্বন capture শূন্য, প্রতিদিনে ১২,৯২০ মেট্রিক টন কয়লার প্র্য়োজন হবে (১০০ শতাংশ কর্মদক্ষতায়), উৎপন্ন ভস্ম বা ছাই এর পরিমাণ ব্যবহৃত কয়লার ১৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ১৯৩৮ মেট্রিক টন, উৎপন্ন উড়ন্ত গ্যাসের প্রবাহের পরিমাণ ঘন্টায় ৪.৪৭ মিলিয়ন ঘনমিটার, চিমনি থেকে নিঃসরিত গ্যাসের তাপমাত্রা প্রায় ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, উৎপাদিত সালফার অক্সাইড এর সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রতি ইউনিটে প্রতিসেকেন্ডে ৮১৯ গ্রাম, উৎপন্ন সালফার অক্সাইড এর পরিমাণ প্রতি ইউনিটে ৪৯০ গ্রাম/ সেকেন্ড, উৎপন্ন কণাজাত ধুলির পরিমাণ প্রতি ইউনিটে ১০০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার। চিমনির উচ্চতা ২৭৫ মিটার। প্রতি ঘন্টায় পানি আহরণের পরিমাণ ৯১৫০ ঘনমিটার, প্রতিঘন্টায় বর্জিত পানির পরিমাণ ৫১৫০ ঘনমিটার-অর্থাৎ মোট ব্যবহৃত পানির পরিমাণ ঘন্টায় প্রায় ৪০০০ ঘনমিটার। এই পানি সংগৃহীত হবে পশুর নদী থেকে এবং বর্জিত হবে সেখানেই। সাধারণ হিসেবে পশুর নদীর সর্বনিম্ন পানি প্রবাহের পরিমাণের এটি ০.০৪ শতাংশের কম। নিঃসরিত পানি বা উড়ন্ত গ্যাসের (Fly gas components- SiO2, Al2O3, Fe2O3, CaO, LOI (Loss of Ignition)) তাপমাত্রা চারপাশের পরিবেশের তাপমাত্রা থেকে বেশী হবে না বলে এই মডেলে দাবী করা হয়েছে। তাছাড়া নিঃসরিত নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং সালফার অক্সাইডের মাত্রা আন্তর্জাতিক সহনীয় মাত্রার কম বলে দাবী করা হয়েছে। তবে অবশ্যই উন্নত ধরণের কয়লা ব্যবহারের শর্ত রয়েছে যে কয়লায় সালফারের মাত্রা হবে ০.৬ শতাংশের নীচে। এই কয়লার উৎস হিসেবে অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়ার উল্লেখ আছে। উপরে উল্লিখিত প্যারামিটারগুলির নিরিখে প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা কতটুকু, তা বিবেচনা করা যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী আজ এক খোলা বিতর্কের অবতারণা হয়েছে যে, শক্তি উৎপাদনে জৈব জ্বালানী বা পারমাণবিক জ্বালানী কোনটাই মানবজাতির সম্ভাব্য বিপর্যয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতির নিরিখে বিনাবাক্য ব্যয়ে গ্রহণযোগ্য নয়। এই শক্তি উৎসের বিপরীতে renewable পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎসের পক্ষে বৈজ্ঞানিক এবং সামাজিক দাবী জোরদার হচ্ছে। বিশেষ করে চিরায়ত এই শক্তি উৎস ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা ও পারমাণবিক চুল্লির বিভিন্ন ভয়াবহ দূর্ঘটনা (চেরনোবিল, জাপান ইত্যাদি) মানুষকে শংকিত করে তুলেছে। অন্যদিকে, এটাও সত্য যে বিকল্প নিরাপদ শক্তি উৎসের প্রযুক্তি এখনও বিশ্বের শক্তি চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এখনও উন্নত বা দ্রুত উন্নয়নশীল সকল দেশেরই প্রধান শক্তি উৎস হলো, হয় জৈব জ্বালানী (কয়লা) নতুবা পারমাণবিক জ্বালানী। (কয়লাভিত্তিক প্রকল্প-আমেরিকায় ৪৯%, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯৩%, চীনে ৭৮%, ভা্রতে ৬৮%, বাংলাদেশে ০.৩%)। অবশ্য এ সকল ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণ বা দূর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি উন্নততর করার চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। উভয়দিক বিবেচনা করে-সামাজিক উন্নয়নসূচক অব্যাহত রাখতে হলে অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত, ভারসাম্যমূলক, উন্নত প্রযুক্তি সমন্বিত টেকসই পরিকল্পনার কোন বিকল্প নাই। আগেই বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের উৎপাদন প্রযুক্তি ‘সুপার-ক্রিটিক্যাল পাল্ভারাইজড কোল জেনারেটর’। এটাও আগে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রধান প্রধান কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে অবশ্যই সালফার অক্সাইড, কার্বন অক্সাইড এবং উড়ন্ত গ্যাসের পরিমাণ ন্যূনতম মাত্রায় রাখার সর্বাধুনিক আবিষ্কৃত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। যেমন, FGD ( Flue Gas Desulfurization) র জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কয়লা ভস্ম (Coal Fly Ash) ব্যবস্থাপনার এবং পুনব্যবহারের সুনির্দিস্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। এ ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ বা সম্ভাব্য যে কোন প্রাকৃতিক বা যান্ত্রিক দূর্ঘটনা মোকাবিলা করার জন্য যথাযথ EMP ( Environmental Management Plan) থাকতে হবে। মূল প্রস্তাবনায় এ ধরণের ব্যবস্থাপনার অত্যন্ত ভাসাভাসা উল্লেখ আছে। উপরোক্ত দু’টি বৈজ্ঞানিক বিবেচনার আলোকে নিমোক্ত সিদ্ধান্তে আসা যুক্তিযুক্ত (১) প্রস্তাবিত প্রকল্পটিকে সুন্দরবনের নিকটতম প্রান্তসীমা থেকে ন্যূনতম ১৪ কিলোমিটারের পরিবর্তে ২৫ কিলোমিটার দূরে স্থানান্তর করা উচিত এবং সেটা সম্ভব। (২) প্রস্তাবিত প্রযুক্তির সাধারণ বৈজ্ঞানিক বিবেচনায় গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও কার্বন-অক্সাইড, সালফার-অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন-অক্সাইড গ্যাস নিয়ন্ত্রনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করতে হবে এবং ‘পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা’ (Environmental Management Plan, EMP) য় উৎপাদিত ছাই বা ভস্ম (Ash) ব্যবস্থাপনা, পানি আহরণ, পানি বর্জন প্রযুক্তি আধুনিকতম করতে হবে। বর্জিত পানি বা উড়ন্ত গ্যাসের তাপমাত্রা যেন পরিবেশ তাপমাত্রার চেয়ে কোনক্রমে বেশী না হয় তার ব্যবস্থাপনা সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প সফল করতে হলে, নীতিগতভাবে এ দু’টি বিষয়কে সকল ধরণের কূটতর্কের উর্ধে নিয়ে এগুতে হবে। সর্বোপরি, যে কোন বড় প্রাকৃতিক বা যান্ত্রিক দূর্ঘটনাজাত দুর্যোগে সম্ভাব্য যে কোন ক্ষতিকে বিবেচনায় রেখে এ সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রকল্পের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। মূল পরিকল্পনায় এ বিষয়টিকে সুনির্দিষ্টভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের ভৌগলিক আয়তন (Geographical Area) জনসংখ্যার তুলনায় অত্যন্ত ছোট। যে কোন ধরণের স্থাপনা আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জনজীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই নেতিবাচক প্রভাবকে ন্যূনতম মাত্রায় (Minimum Level) আনা অপরিহার্য। (৩) কয়লা পরিবহণ সংক্রান্ত বিষয়টিও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রকল্প বিবেচনায় প্রকল্পটিকে ১০০ শতাংশে উৎপাদনক্ষম রাখতে হলে, সমুদ্রপথে এবং নৌপথে বছরে প্রায় ৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। সমুদ্রপথে এ কয়লা পরিবহণ করলে তা অবশ্যই সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে মোংলা বন্দরের চ্যানেল ব্যবহার করতে হবে। প্রশ্ন উঠেছে, এই বিপুল কয়লা পরিবহণের ফলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। বিষয়টি বিবেচনার আগে কয়েকটি উপাত্ত জানা জরুরি। বর্তমানে মোংলা বন্দরের কার্গো পরিবহণের পরিমাণ বছরে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন। মংলা বন্দরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় আগামী বিশ বছরে এই কার্গো পরিবহণ পরিমাণ নির্ধারন করা হয়েছে বার্ষিক প্রায় ২০ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং তা সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে চলা নদীপথকে ব্যবহার করে। তাহলে বছরে ৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা পরিবহণ এই লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই পড়ে। নতুন পায়রা বন্দর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও মংলা বন্দর রক্ষার বিষয়টিও এর সঙ্গে জড়িত। কয়লাভিত্তিক যে কোন বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে চাইলে বাংলাদেশকে এ ঝুঁকির মোকাবিলা করতে হবে। সুন্দরবন ও তার জীববৈচিত্র সুরক্ষার সঙ্গে শুধু এই প্রকল্প নয় আরো অনেক কিছুই বিবেচনায় আনতে হবে। তাই কয়লা পরিবহণের বিষয়টি একটি খোলা বিতর্ক। মংলা বন্দর উন্নয়ন আর সুন্দরবন রক্ষা একমুখী নয়- বিপরীতমুখী। সেটা বিবেচনায় রেখেই সামনে এগুতে হবে।
৫। সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষা ও তার আর্থ-সামাজিক গুরুত্বঃ
সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ‘ম্যানগ্রোভ’ বনাঞ্চল। এই প্রাকৃতিক বন গাছপালা ও জীববৈচিত্রে ভরপুর। জীববিজ্ঞানীদের মতে (কিছু মতান্তর থাকতে পারে) এই বনে প্রায় ৩৩০ প্রকারের গাছ, ২ শতাধিক প্রজাতির মাছ, ৪২ ধরণের স্তন্যপায়ী জীব, ২৭০ ধরণের পাখী, ৫১ ধরণের সরীসৃপ, ৪ ধরণের উভচর প্রানী এবং অসংখ্য অমেরুদন্ডী জীব রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-পৃথিবীখ্যাত ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ ও চিত্রা হরিণ যা আমাদের জাতীয় পরিচিতি বহন করে। এই জাতীয় সম্পদ বা জাতীয় গর্ব সুন্দরবনের পরিবেশ তথা সুন্দরবন রক্ষার প্রশ্নে কারুরই দ্বিমত থাকার কথা নয়, অন্ততঃ প্রকাশ্যে তা নেইও। তবে সুন্দরবন রক্ষার পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাব রয়েছে, এ সত্য স্বীকার করতে হবে। বিগত শতাধিক বছর ধরেই নানাবিধ কার্যকলাপ সুন্দরবনকে সংকুচিত করে ফেলেছে। কি কি কার্যকলাপ এর জন্য দায়ী সেগুলোকে অনুপুঙ্খভাবে সুনির্দিষ্ট করে তাকে প্রতিরোধ না করলে সুন্দরবনকে রক্ষা করা যাবে না। বন দপ্তর, পরিবেশ দপ্তর, নৌপরিবহন দপ্তর সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের সমন্বিত বা পরিকল্পিত উদ্যোগ কখনও পরিলক্ষিত হয়নি। আজ কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের ইস্যুতে সুন্দরবন রক্ষার বিষয়টি জোরেশোরে সামনে চলে এসেছে। কিন্তু, দীর্ঘকাল ধরে নীরবে সুন্দরবন ধ্বংসের যে কার্যকলাপ চলেছে, তার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত কিছু লেখা, কিছু পোস্টার সর্বস্ব সাংবাদিক সম্মেলন ব্যতিরেকে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে পারে এমন কোন আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। এ বিষয়টাকে আত্মসমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেই আজ সামনে এগুতে হবে। এটা আজ সবাইকে জানতে হবে-বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদ কতটা পিছিয়ে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু কৃষি আর মাছ ধরার উপর এখানকার জনগনের জীবিকা চলেছে শত শত বছর ধরে। জীবনধারণের এই প্রক্রিয়ায় সুন্দরবন তাদের জীবিকার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।এ এলাকার ৫ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে প্রায় ২৭ শতাংশ কাঠ, গোলপাতা ইত্যাদি সংগ্রহ, প্রায় ৬৯ শতাংশ নির্ভরশীল জলজ সম্পদের উপর, প্রায় ৪ শতাংশ মানুষ অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের কাজের উপর নির্ভরশীল। এই বিপুল জনগোষ্ঠী বিকল্প কাজের অভাবে সুন্দরবনের মধ্যে মাছ ধরা, অবৈধভাবে কাঠ, গোলপাতা, হোগলা, মধু প্রভৃতি আহরণ থেকে শুরু করে বাঘ-হরিণসহ বনের পশু-পাখী শিকারের এই কাজ করে চলেছে অব্যাহতভাবে। এখনও আইনের ফাঁক দিয়ে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে এ প্রক্রিয়া চলছে, থামেনি। ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত মংলা বন্দর এ অঞ্চলের জন্য এক আশির্বাদ হিসেবে মনে করা হয়। তার সত্যতাও আছে। কারণ, এই পোর্টকে (বন্দর) ঘিরেই শুরু হয়েছে নগরায়ন, বিকল্প কর্মসংস্থান। কিন্তু, তা পরিকল্পিতভাবে হয়নি-তা হয়েছে নির্বিচারে এবং নীরব জবর-দখলের মাধ্যমে। মংলা বন্দরের বর্তমান অবস্থানও সুন্দরবনের ECA (Environmental Critical Area) র মধ্যে। আশির দশকে যে খুলনা-মংলা মহাসড়ক হয়েছে, তা এই জনপদকে দেশের অন্যান্য এলাকার সংগে যুক্ত করেছে। নতুন প্রস্তাবিত রেল লাইন, বিমানবন্দর সবকিছুই এ অঞ্চলকে বহিঃর্বিশ্বের সংগে যুক্ত করবে। নেপাল-ভুটানের সংগে সরাসরি সড়ক ও রেলপথ সংযোগ মংলা বন্দরের বৈদেশিক যোগাযোগ ও গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলবে। এর ফলে তা সুন্দরবনের পরিবেশের উপরও চাপ ফেলবে। এ ছাড়াও মংলা পোর্টের মধ্যে এবং তার আশেপাশে গড়ে উঠেছে সিমেন্ট কারখানা, এল, পি গ্যাস কারখানা, ই পি জেড, সাইলোসহ অসংখ্য স্থাপনা। মংলা নদী পাড় হয়ে বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হয়েছে পিচঢালা পাকারাস্তা। এ সকল রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন যানবাহন চলাচল সুন্দরবনের জিরো-পয়েন্ট পর্যন্ত চলে গেছে। গড়ে উঠেছে বসতি। এই বসতি এলাকা আর সুন্দরবনের সীমার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। আগেই বলা হয়েছে, বিকল্প টেকসই কোন কর্মসংস্থান না থাকায় এই জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আজও বনের উপর এবং বনজ সম্পদের উপর অবৈধভাবে নির্ভরশীল। সুন্দরবনকে ঘিরে তৈরী হয়েছে এক নীরব অবৈধ অর্থনীতি। এটা আজ সর্বজনবিদিত যে, যারা বনকে রক্ষা করার জন্য বৈধভাবে নিয়োজিত, তাদের দুর্নীতিও বনকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে। তাছাড়া প্রাকৃতিক পানি সঞ্চালনকে বাধাগ্রস্ত করে চিংড়ি চাষ করায় সুন্দরবনের চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং এর জীববৈচিত্রের সমূহ ক্ষতি হয়েছে। জোর করে শুধু মুনাফার লোভে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এই চিংড়ি ঘেরের প্রক্রিয়া এ অঞ্চলের জনপদের স্বাভাবিক অর্থনীতি, গৃহপালিত পশু, বনজ পরিবেশ ধ্বংস করেছে।জোর করে জমি দখল করে অনেক বহিরাগতরা যেভাবে চিংড়ি ঘের করেছে, তাতে অনেকক্ষেত্রে এলাকার প্রকৃত অধিবাসীরা উৎখাত হয়ে গেছে। ধানচাষসহ কৃষি অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ক্ষতি প্রায় অফেরৎযোগ্য (irreversible)। সর্বোপরি, আধুনিকায়ন ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে সুন্দরবনের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে নানা ব্যবসায়, শিল্প কারখানা তৈরির উদ্যোগ- যা নিঃসন্দেহে সুন্দরবনের পরিবেশকে সংকটাপন্ন করে তুলবে। সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষার সংগে এ এলাকার মানুষের পরিকল্পিত কর্মসংস্থান আজ সময়ের দাবী। পদ্মাসেতু খুলে যাবার সংগে সংগে নগরায়ন আর উন্নয়নের বিপুল অভিঘাত এ এলাকায় চলে আসবে। তাকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে না পারলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা আর এলাকার জনপদের উন্নয়ন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে। বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত চিন্তা দিয়ে এই অভিঘাতকে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। প্রয়োজন একটি সমন্বিত পরিকল্পনার। পরিবেশকে সুরক্ষা করে এলাকার উন্নয়ন অব্যাহত রাখার ভারসাম্যপূর্ণ পরিকল্পনার বিকল্প নাই। যে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর চাপ প্রয়োগ করবেই। তাকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য পরিকল্পিতভাবে পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগও থাকতে হবে। উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে শুধুমাত্র পরিবেশ রক্ষার দাবীতে জনপদও রক্ষা পাবে না, পরিবেশও রক্ষা পাবে না। এ এলাকার জনপদের পরিকল্পিত উন্নয়ন উদ্যোগ না থাকলে মানুষ জীবিকার প্রয়োজনেই বিপথে সুন্দরবনকে ধ্বংস করে ফেলবে। সুন্দরবন ধ্বংস হলে গোটা ব-দ্বীপের জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে অসহায় হয়ে পড়বে- এটা বোঝার জন্য খুব গভীর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োজন নাই। তাই সুন্দরবন ও তার পরিবেশের ক্ষতিরোধকে প্রাধান্য দিয়েই বিকল্প উন্নয়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
৬। প্রস্তাবিত প্রকল্পের ‘পরিবেশের উপর প্রভাব সম্পর্কিত মূল্যায়ন’ (Environmental Impact Assessment, EIA) সম্পর্কে কিছু বক্তব্যঃ
প্রস্তাবিত প্রকল্পের EIA রিপোর্টের উপর কিছু আলোকপাত করা উচিত। Environmental Impact Assessment, EIA এর রিপোর্টটি তৈরী করেছে-Center for Environmental and Geographic Information Services ( CEGIS)। এটি পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের অধীনস্ত একটি পাবলিক ট্রাস্ট। এই রিপোর্ট প্রকাশের সংগে সংগেই কিছু সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। তার মধ্যে প্রধান হলো রিপোর্টটি নিরপেক্ষ নয়। এখানে স্বার্থের সংঘর্ষ এসে গেছে- কারণ রিপোর্টটি তৈরি করেছে-পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের অধীনস্ত একটি ট্রাস্ট (CEGIS) । অধিকন্তু এটি একটি দেশী প্রতিষ্ঠান। প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, একটি রিপোর্ট বিবেচিত হতে হয়- তার বিচার্য বিষয়ের বৈজ্ঞানিক উপাত্তগত বিশ্লেষণের মানের উপর-কে করেছে তার উপর নয়। দেশী না হয়ে আন্তর্জাতিক কোন প্রতিষ্ঠান হলেই নিরপেক্ষ হবে- এই যুক্তি সব সময় খাটে না। বিশ্বব্যাংক বা আই এম এফ এর বহু রিপোর্ট বিশ্বের বহু দেশের সর্বনাশ করে দিয়েছে। প্রস্তাবিত রামপাল প্রকল্পের উপর কিছু বেসরকারি EIA রিপোর্ট উত্থাপিত হয়েছে। কিছু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বা প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। গুণগত মানের বিচারে সেগুলোও কতটা বিজ্ঞানসম্মত মানের আর কতটা পূর্বনির্ধারিত ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস সেটা বিবেচ্য হতে পারে। প্রথমেই বলা ভালো-রিপোর্টটি ৬৭৬ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রিপোর্ট। রিপোর্টটির methodology তে যে যে বিবেচ্য বিষয়গুলো আসা উচিত, সেগুলো প্রায় সবই আলোচ্যবিষয়ে আছে। কিন্তু, সংগৃহীত উপাত্তগুলির সংগে বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্তের সংগে তা কতটা সাযুজ্যপূর্ণ সেটাই দেখার বিষয়। রিপোর্টটির প্রধান বিবেচ্যগুলি প্রাধান্যের বিবেচনায় নিলে এভাবে বলা যায়। (এক) প্রস্তাবিত প্রকল্পটি যে স্থানে স্থাপিত হতে যাচ্ছে- তা আইনগত ও বিধিগতভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সংগে কতটা সংগতিপূর্ণ? রিপোর্টে বলা হয়েছে-এটা বিধিসম্মত। (দুই) এই প্রকল্পে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে-তা সুন্দরবনসহ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, জনগোষ্ঠী ও ইকোসিস্টেমের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে-তা কতটা সহনীয় মাত্রার, নাকি তা আশু ও দীর্ঘমেয়াদী বিপর্যয় ডেকে আনবে? যে কোন শিল্পায়ন ও নগরায়ন পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে অথবা পরিবর্তন করে। এক্ষেত্রে তার প্রভাব কতটুকু? রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রযুক্তি যথেষ্ট আধুনিক এবং স্থাপনা সুন্দরবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। (তিন) কয়লা পরিবহণ প্রক্রিয়া সুন্দরবনকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করবে সে সম্পর্কে অভিমত। কয়লা পরিবহণ ব্যবস্থা সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না-এটা রিপোর্টের মত। (চার) এই প্রকল্পের একটি শর্ত হলো-উন্নতমানের কয়লা ব্যবহার করতে হবে (বিশেষ করে যার মধ্যে সালফারের পরিমাণ ০.৬ শতাংশের কম)। EIA তে এটা উল্লেখ আছে, কিন্তু প্রশ্ন আছে, এই প্রকল্পের বিদেশী মালিকানার চাপে ভবিষ্যতে নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করতে প্রকল্প বাধ্য হবে কিনা। তাহলে, এর বিরুদ্ধে নিশ্চয়তার বিধানটি কি হবে? এ সম্পর্কে রিপোর্টে সুনির্দিষ্ট কোন অভিমত নাই। (পাঁচ) EIA তে Environmental Management Plan (EMP) এর উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু, তার গুরুত্ব বিশেষ করে ভস্ম ব্যবস্থাপনা ও তার নিয়মিত পর্যবেক্ষণের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। (ছয়) EIA এর সবচাইতে দূর্বল দিক হলো, এখানে শুধুমাত্র দু’টি অবস্থানের বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে, একটি লবনচোরা, যেটি খুলনা শহরের খুব কাছে, অন্যটি সাপমারি কাটাখালি, যা সুন্দরবন ECA সীমা থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে। বিকল্প কোন স্থানের আলোচনা বা সম্ভাব্যতা বিচার করা হয়নি। এই রিপোর্টের পরিশিষ্টে সচরাচর উত্থাপিত ১৬টি প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে। তার প্রধান কয়েকটি দিক বিবেচনা করলে এই রিপোর্টের সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি দূর্বলতা ও সবলতার দিকগুলো বোঝা যায়।
৬। উপসংহারঃ বিকল্প ভাবনা
বিরামহীন বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়, এমনকি স্বাভাবিক জীবিনযাত্রা অব্যাহত রাখাও অসম্ভব। বিশ্বব্যাপী এই মুহূর্তে বিদ্যুতের যে উৎসগুলির কথা ভাবা হচ্ছে, তাহলো-গ্যাস, তেল, কয়লা, পারমাণবিক জ্বালানী, সৌরশক্তি, জীবাস্ম এবং বায়ুপ্রবাহ। আমাদের দেশের সামনের দু’তিন দশকের বিদ্যুৎ ভাবনাতেও এই উৎসগুলির কথাই আসবে। অর্থনৈতিক সামর্থ্য, জ্বালানী উৎস ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব, আশু চাহিদার চাপ সবকিছুকে বিবেচনা করেই-ভারসাম্যমূলক পরিকল্পনার বিকল্প নাই। প্রস্তাবিত প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য সার্বিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে সবচাইতে বাস্তবানুগ যে সিদ্ধান্তে আসা যায় তাহলো- বিদ্যুৎ চাই –উন্নয়ন চাই, তবে সুন্দরবন ও পরিবেশের সুরক্ষা চাই। এই দৃষ্টিভংগীর উপর দাঁড়িয়ে বিকল্প ভাবনার প্রস্তাবনা হলোঃ
(১) সুন্দরবন ও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ থেকে প্রকল্পের দূরত্ব পরিবেশবিজ্ঞানের বিবেচনায় যথেষ্ট নয়- যদিও বর্তমান ECR-1997 এর আইনগত দিক দিয়ে এটি অসিদ্ধ নয়। তবুও প্রস্তাবিত প্রকল্পটি সুন্দরবনের নিকটতম সীমা থেকে অন্ততঃ ২৫ কিলোমিটার দূরে স্থাপন করতে হবে। এ ধরণের বিকল্প স্থান নির্ণয় করা সম্ভব।
(২) এই প্রকল্পের সঙ্গে মিলিয়ে এই জনপদের কর্মসংস্থানের জন্য একটি সুপরিকল্পতি উন্নয়ন পরিকল্পনা (যেমন, আই টি ভিলেজ, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি) দিতে হবে যা সুন্দরবন, মংলাবন্দরসহ পারিপার্শ্বিক এলাকার পরিবেশ এবং ইকো-সিস্টেমকে যতটা সম্ভব রক্ষা করে বাস্তবায়িত হবে। মুনাফার লোভে কোন ধরণের অপরিকল্পিত উদ্যোগকে আইনগতভাবে রোধ করতে হবে।
(৩) প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশ বা জনপদকে সম্ভাব্য সকল ধরণের ক্ষতি ন্যূনতম রাখার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ তদারকি ব্যবস্থার পরিকল্পনা সন্নিবেশিত হতে হবে। অপরিহার্য ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলি আগেই বলা হয়েছে।
(৪) এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে-তাদেরকে সর্বশেষ বাজার দরে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কোন ধরণের আইনের প্যাঁচে তাদের ফাঁকি দেওয়া বা হয়রানি করা যাবে না। যারা সম্ভাব্য কর্মহীন হবে, তাদের এই প্রকল্প কার্যকরী করার সময় এবং প্রকল্প শেষে কাজের আইনগত নিশ্চয়তা দিতে হবে। সম্ভাব্য সকল উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় লোকদের কর্মসংস্থানের অগ্রাধিকারের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৫) প্রকল্পের চুক্তি, প্রকল্পের অর্থনৈতিক বিবেচনা, পরিবেশের উপর সম্ভাব্য প্রভাব ও জাতীয় স্বার্থের বিষয়গুলো জনসমক্ষে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে। জনগণের কাছে এগুলি স্বচ্ছভাবে না থাকলে, দেশী-বিদেশি যে কোন শক্তির পক্ষে জনগনকে বিভ্রান্ত করা যাবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে যাতে কোনধরণের দূর্নীতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
(৬) আগামী দু’দশকের বিদ্যুৎ উন্নয়ন পরিকল্পনায় নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুৎ ও তার প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভাবতে হবে।
সমাপ্ত