“I can’t breathe”, “We can’t breathe”, “Let us breathe” । তিনটি বাক্য। প্রথমটি আমেরিকার মিনেসোটা স্টেটের ৪৬ বছরের এক কৃষ্ণাংগ মানুষের । নাম জর্জ ফ্লয়েড। যখন একজন শ্বেতাংগ পুলিশ তাকে হাঁটু দিয়ে শ্বাসনালী চেপে ধরেছিল। এটা ছিল তাঁর শেষ কথা। দ্বিতীয় দু’টি বাক্য হাজার প্রতিবাদী মানুষের। আমেরিকার সকল বড় বড় শহরের রাস্তায়। করোনার ভয় অগ্রাহ্য করে বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে। একা ফ্লয়েড, এখন লক্ষ লক্ষ ফ্লয়েডে রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁরা শ্বাস নিতে চায়। নিঃশ্বাস নিতে চায়। তাঁদের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অথবা গেছে। বিরাট প্রশ্ন, কেন এই বিক্ষোভ ? একি শুধু এক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু নাকি এর পিছনে লুকিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ ফ্লয়েডের নীরব হাহাকার। হিসেবটা জরুরি। কার কাছে হিসেব চাইতে হবে? কে সেই মালিক যার কাছে পাওনা বুঝে নিতে হবে? এখন মনে হচ্ছে গোটা বিশ্ব চিৎকার করে বলছে, ‘Let us breathe’ ।
করোনা আক্রান্ত পৃথিবী। ৬২ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত। সাড়ে তিন লক্ষেরো বেশী মানুষ মৃত। ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, কেউ বাদ নেই। সাড়ে সাতশ কোটি মানুষ মনে করছে, ‘ We can’t breathe, Let us breathe’।
বাংলাদেশে করোনা শুরুর পর থেকেই চলছে যেন ‘তুঘলক বাদশা’র খেলা। কখনও লক ডাউন হচ্ছে, কখনও তা শিথিল হচ্ছে। কখনো গার্মেন্টস শ্রমিকদের ডেকে আনা হচ্ছে কারখানা খুলে দিয়ে বিদেশী অর্ডার পূরণের জন্যে। আবার তা বন্ধ করে তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বেতন কড়ি, টাকা পয়সা না দিয়েই।
ঈদে কেউ বাড়ি যেতে পারবে না। গণপরিবহণ বন্ধ, সরকারি নির্দেশ। হঠাত করে কার অঙ্গুলি হেলনে খুলে খেল ব্যক্তিগত গাড়ি চলা। ছুটলো জনস্রোত-গ্রামের দিকে। শহরের সকল রোগব্যধি বহণ করে। ফেরি , লঞ্চ, ট্রাক, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, সাথে পায়ে হেঁটে হাজার হাজার মানুষ একাকার। কোথায় ‘সামাজিক দূরত্ব, কোথায় করোনার ভয়, কোথায় মুখে মাস্ক। সব একাকার।
প্রণোদনা ঘোষিত হলো। তাঁর কত অংশ প্রকৃত দুঃস্থদের হাতে গেল, আদৌ গেল কিনা হিসেব নেবার কেউ নেই, জবাবদিহিতা নেই। সাড়ে ৫ কোটি মানুষ দুঃস্থতার নীচে নেমে গেছে অথবা যাচ্ছে, তারজন্যে কি অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা তার কোন দৃশ্যমান পরিকল্পনা নেই। সামনে বাজেট অধিবেশন, বাজেট আসবে। বাজেটে কি আসবে তার কোন আলোচনা নেই। যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা রুগ্ন তার জন্যে স্পেশাল বরাদ্দ আছে কিনা তার কোনো আলামত নেই। সামনের দু’বছর প্রায় ৫ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার আওতায় আনতে গেলে তাদের রেশনের আওতাভুক্ত করতে হবে, তার কোনো ব্যবস্থা বাজেটে থাকবে কি না, কেউ জানে না। ৮৭.৩% শ্রমজীবি মানুষ কর্মহীন, তাদের ন্যূনতম কাজের ব্যবস্থা করা হবে কিনা কেউ জানে না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে লেখাপড়া চলবে, বেসরকারি বা জন (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম কিভাবে চলবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোন হিসেব আছে কি না কেউ জানে না।
লকডাউন উঠে যাচ্ছে, কি পরিকল্পনায়, কেউ জানে না। অথচ বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে। বাড়ছে মৃত্যুও সমানতালে। কখন তা শীর্ষে উঠবে তাঁর বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা নাই। থাকলেও কে জানে, তাও কেউ জানে না।
মানুষের কাজ নেই। কি করে চলবে তা দেখার যেন রাষ্ট্রের কোন দায় নাই। ডাক্তাররা, স্বাস্থ্য কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছে, নতুন লোকবল কি ভাবে বাড়বে, কে জানে? স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধুঁকছে। রাজধানীর বিখ্যাত হাসপাতালে সবার প্রায় চোখের সামনে আগুন লেগে ৫ জন করোনা আক্রান্ত মানুষ মারা গেলেন, জবাবদিহিতা নেই। তারমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, চার্টার্ড বিমানে আর এয়ার এম্বুলেন্সে করে বিশেষ বিশেষ কেউ কেউ বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছেন। কে তাঁদের যেতে দিল কেউ জানে না। মানুষ মানসিকভাবে এবং শারিরীকভাবে গৃহবন্ধী। হাসপাতালে আক্রান্তের অক্সিজেন নাই। সবাই বলছে, ‘We can’t breathe, Let us breathe’ ।
পাশের দেশ ভারতে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক শত শত মাইল হেঁটে পাড়ি জমাচ্ছে, কোথায় তাঁদের আদি নিবাস আর ঠিকানা সেদিকে। শিশু, নারী, কিশোর, যুবক একাকার সীমাহীন, সীমানাহীন, সীমান্তহীন রাস্তায়। কোটি কোটি মানুষ অভুক্ত। অথচ সেদেশের শীর্ষধনী সপ্তাহের ব্যবধানে তাঁর সম্পদ বাড়িয়ে নিলেন ১০ হাজার কোটি ডলার।
পাকিস্তানের মত দেশে শত শত প্রতিবাদী নারী লাল পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ করছে, করোনার মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে।
মধ্য প্রাচ্যে ধনী ডলারের মালিকেরা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে তাঁদের সকল মুনাফার উৎস।
করোনার এই মৃত্যুর মিছিলে আফ্রিকার লিবিয়ায় মানবপাচারকারিদের গুলিতে নিথর পড়ে আছে ২৬ জন বাংগালি ভাগ্যান্বেষী যুবকের দেহ।
ব্রাজিলে মৃত্যুর মিছিল। অথচ সে দেশের নির্বিকার প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসেনেরো মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে তুলে দিচ্ছে লক ডাউন আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা উপেক্ষা করে হাইড্রোক্সক্লোরোকুইন অসুধ খেয়ে যেতে বলছে।
খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজ আগুন জ্বলছে। নিউইয়ররক, ডেট্রয়েট, মিনেসোটা কোথায় নাই মৃত্যুর মিছিল। হিসেব বলছে মৃত্যুর মিছিলে কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামী আর হিস্পানীরা সংখ্যাগুরু। কারণ তাঁরা গরিব। আমেরিকায় তাঁদের হিসেবে তিন কোটি মানুষ বেকার ভাতার আবেদন করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার। সামনে আছে আরও। অর্থনীতি বেসামাল। অথচ, বিল গেটস, বেজোস আর মার্ক জাকারবার্গের সম্পদ বৃদ্ধি থামছে না। বিলিয়ন থেকে ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আন্তর্জাতিক রীতিনীতি বৃদ্ধাংগলি দেখিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংগে সম্পর্ক ছিন্ন করছে। জি৭ এর বৈঠক করবে তাঁর দেশে।( যদিও জার্মানীর চ্যান্সেলর মার্কেলো জানিয়ে দিয়েছেন তিনি যেতে পারবেন না) ।
ইউরোপ বহু আগেই টালমাটাল। যুক্তরাজ্য, ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, রাশিয়া, স্ক্যান্ডেনেভিয়া, এমনকি অতি শৃংখলাবদ্ধ জাতি জার্মানী কেউ বাদ নাই।
বিংশ শতাব্দির শেষ পঞ্চাশ বছর আর একবিংশ শতাব্দী দুই দশক ধরে রাজত্ব করছে পুঁজিবাদ। রাষ্ট্র জনগণের থাকলো না, হলো পুঁজি আর তার মালিক কর্পোরেটদের। পুঁজি বিশ্বায়নের রথে চড়ে দখল করে নিল গোটা বিশ্ব। ব্যক্তিমালিকানা, বাজার আর মুনাফা গ্রাস করলো বিশ্বকে। সগৌরবে তাঁরা ঘোষণা করলো ‘আমরা মালিক’। কখনো পুঁজির চাপে, কখনো অস্ত্রের চাপে পদদলিত হলো বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ। প্রকৃতি নিষ্পেষিত হলো পুঁজির মুনাফার যাঁতাকলে। কার্বন নিঃসরণ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন, হিমবাহের গলন আর সমুদ্রতলের স্ফীতি গোটা বিশ্বকে শ্বাসরুদ্ধ করে তুলেছে। কে দায়ী, হিসেবের পাওনা চুকাতে হবে। পৃথিবীর কোটি কোটি শ্রমজীবি (শারিরীক ও মানসিক) মানুষ তাঁদের শ্রম দিয়েছে। তাঁরা আর বকশিশ চায় না। তাঁরা হিসেবের পাওনা চায়। তাই পৃথিবীর সর্ববৃহত অর্থনীতির দেশের সবচাইতে ধনী দেশের রাজপথ আজ কাঁপছে। শ্লোগান উঠেছে, ‘ We can’t breathe, let us breathe’ ।
তাই জনপ্রিয় গানের ভাষায় বলতে হয়,
‘বকশিশ চাই না মালিক, হিসেবের পাওনা চাই’।