কেউ যদি বলে এবারের বাজেটের চমক কি? সবাই বুঝুক না বুঝুক বলবেন, ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট এবং ৮.১% প্রবৃদ্ধির হার। তার অর্থ কি? দেশের অর্থনীতির পন্ডিতরা এর অর্থ জানেন আম জনতা জানেন না। জনগণ পত্রিকার পাতা খুঁজতে থাকেন কোন কোন জিনিষের দাম বাড়লো, কার দাম কমলো। নিজের প্রয়োজনের জিনিষের দাম বাড়লে রাগ হবে, কমলে ভালো লাগবে। গরীব মানুষ ভাববে, চাল, তেল, নুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের দাম বাড়বে কিনা। তারপর দেখবে কোন খাতে কত বরাদ্দ? স্বাস্থ্য খাত এবারের জন্য স্পর্শকাতর বিষয় কারণ ‘করোনা’ ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। শিক্ষাখাতে কত খরচ, কৃষিখাতে কি প্রণোদনা? কর্মসংস্থানের জন্য পরিকল্পনা কি? নতুন চাকরি বাড়বে কিনা। এবার তো সংকট চাকরি পাওয়া তো দূরের কথা, চাকরি হারাবে কিনা মানুষ। ইতিমধ্যে ৩ কোটি কর্মক্ষম মানুষ চাকরি হারিয়েছে। এই বাজেটে তাঁদের ব্যাপারে কোন সুরাহা আছে কিনা? রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জুট, টেক্সটাইল, চিনি শিল্প ধুঁকছে, সেই শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি, পেনশন, গ্র্যাচুইটির টাকার সংস্থান বাজেটে আছে কিনা বা এ শিল্প কারখানা আধুনিকায়নের বরাদ্দ আছে কিনা। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে কত মানুষকে এই করোনা দূর্যোগে সময়ে সহায়তা করা যাবে? ৫ কোটি মানুষের রেশনের আওতায় না আনলে মানুষ দূর্ভিক্ষের পদধ্বনি দেখবে। তার সুরাহা বাজেটে আছে কিনা । আমজনতা মোটা দাগে এ বিষয়গুলো খুঁজবে।
তারপর হিসেব করতে বসবে ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটের টাকা আসবে কোথা থেকে? কার পকেট কাটা হচ্ছে? গরীব মধ্যবিত্তের না, যাদের টাকা আছে, মুনাফা আছে তাঁদের কাছ থেকে টাকার সংস্থান হচ্ছে? নাকি প্রনোদনার নামে যারা বছর ধরে মুনাফা করে তাঁদের মুনাফার ক্ষেত্রটাই তৈরি করা হচ্ছে। দেশের মধ্য থেকে রাজস্ব আদায় করে কত টাকার সংস্থান হচ্ছে, আর ব্যাংকের কাছ থেকে বা সঞ্চয় প্ত্রের থেকে কত টাকা ঋণ আসছে? বিদেশী ঋণ নেওয়া হচ্ছে কিনা? নিলে কত নেওয়া হচ্ছে? বিদেশের অনুদান পাওয়া গেল কিনা গেলে কি শর্তে? কারণ ব্যাংক বা বিদেশী যে কোন ঋণেরই সুদ দিতে হবে। আবার অনুদানের শর্তও অনেক সময় সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যায়। সেটাও দেখতে হবে।
এখন আসা যাক, আম জনতার বোধের বাইরে যে হিসেব সেই জি ডি পির হিসেবে আর তার প্রবৃদ্ধির হিসেবে। জিডিপি হিসেব করতে হলে চারটি উপাদান লাগবে (১) দেশে বছরে মানুষের ব্যক্তিগত খরচ কত হবে? (যা হিসেবের একটা পদ্ধতি পরিসংখ্যানবিদ আর অর্থনীতিবিদরা বের করেন যার মধ্যে খুচরা বিক্রয় বা retail sales থাকবে)। (২) ব্যবসায়ে বিনিয়োগ ( যার মধ্যে construction, inventory level ইত্যাদি থাকবে) কত হবে? (৩) সরকারের ব্যয় ( যার মধ্যে social security benefit, defense cost, medical care cost ইত্যাদি থাকবে ) (৪) নিট বাণিজ্য ( রফতানি-আমদানি)।
অংকের সমীকরণে লিখলে দাঁড়ায়
GDP = C+I+G+ (X-M) = Private consumption + gross consumption + government (investment +spending) + (Export-Import).
অংকটা খুব কঠিন নয় কিন্তু আমজনতার কাছে তা কঠিন করে রাখা হয়।
এখন জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের হিসেবটা কি?
হিসেবটা সহজ করে বললে পূর্ববর্তি কোয়ার্টারের জিডিপি থেকে বর্তমান কোয়ার্টারের জিডিপি কতটা বৃদ্ধি হবে সেই হিসেবটাই হলো এই প্রবৃদ্ধির হিসেব।
সোজা বাংলায় সাধারণভাবে বললে বলা যায়, আমাদের অংকের হিসেবে গতবারের তুলনায় জিডিপি ৮.১% বাড়াতে হবে। প্রশ্নটা এখানেই এই লক্ষ্যমাত্রা ধরলে এবারকার এই জরুরি পরিস্থিতিতে যে খাতগুলো অবশ্যই বাড়াতে হবে তা বাড়ছে কি না। আমার মনে হয়, দেশের তরুণ অর্থনীতির ছাত্ররা অংকটি করতে পারবে।
খুব সাধারণ ভাবে বললে বাজেটের সংজ্ঞা বলা চলে, বাজেট হলো একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য কোন প্রতিষ্ঠানের আনুমানিক আয়ের ভিত্তিতে ( তা রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যন্ত হতে পারে) পরিকল্পিত খাতওয়ারী ব্যয়ের বিধিবদ্ধ সারসংক্ষেপ।
‘The definition of a budget is an itemized summary of planned expenses for a given period along with the estimated income for that period.’
কিন্তু এই সংজ্ঞায় অনেক কিছুই আপাতঃ অনুপস্থিত আছে। এই পরিকল্পনার মধ্যে নীতি থাকে, লক্ষ্য থাকে, থাকে বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা। অর্থাৎ বাজেটের দর্শন ব্যাপক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সেই সার্বিকতা নিয়েই বিষয়টি ভাবতে হবে।
সরাসরি দেশের প্রস্তাবিত বাজেটের প্রসংগে আসা যাক। প্রস্তাবিত বাজেটের জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮.১%। এই সূচক নিঃসন্দেহে অর্থনীতির দ্রুত প্রবৃদ্ধির নির্দেশক। কিন্তু মাননীয় অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটের খাতওয়ারি বরাদ্দগুলোর উপাত্তগুলো কি তাই একটু দেখা যাক। কথায় বলে ‘পরিসংখ্যান বা উপাত্ত হলো নির্বোধ সংখ্যা’। কিন্তু এগুলো বিশ্লেষণ করতে পারলে সহজে অনেক সহজ সত্যটা সামনে আসে। সেজন্যে সকল বিজ্ঞানেই এর এত কদর।
স্থানাভাবে সব খাতের উপাত্ত দেওয়া সম্ভব নয়, তবে যেগুলো প্রাসংগিক তা উল্লেখ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্রথমে বলা যাক, ‘সরকারি চাকরি’ ভালো ভাষায় ‘জনসেবা’ ( civil service ) খাতের বিষয়ে। ২০১৯-২০ সালে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৯৬,৪৬৯ কোটি টাকা তা সংশোধিত হয়ে হয়েছে ৮০,৪০৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে প্রস্তাব করা হয়েছে ১,১৩,১৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রাক বাজেট আলোচনায় প্রায় সবাই এবার প্রস্তাব করেছিল, সরকারি ব্যয় যথাসাধ্য কমানোর চেষ্টা করতে হবে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী তাতে বোধহয় কর্ণপাত করেননি।
স্থানীয় সরকার এবং গ্রামীন উন্নয়ন খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩৬,১০২ কোটি টাকা , পূর্ববর্তী বছরে তা ছিল ৩৭,০৪৯ কোটি। এবার এ খাতে বরাদ্দ কমেছে। কেন? এটি কি গ্রামীন উন্নয়নের পরিকল্পনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? এ প্রশ্ন করা যেতেই পারে।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ৮৫,৭৬২ কোটি টাকা, গতবছরে বরাদ্দ ছিল ৭৭,০৩৮ কোটি টাকা । এই খাতে উপখাত রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, ( এদেশে উচ্চশিক্ষা এখনও আলাদা বিভাগ নয়। এই নীতিগত প্রশ্নটি ওঠা সংগত), আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ। সবসময় জোরেসোরে বলা হয়, শিক্ষাখাতে সবচাইতে বেশী বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেজন্যে শিক্ষাখাতের অন্তর্ভূক্ত কি কি বিভাগ আছে তা উল্লেখ করা হলো, যাতে প্রকৃত চিত্রটি বোঝা যায়। এই বরাদ্দ আমাদের ২০২০ সালের জিডিপির ৩.২ শতাংশ। যেখানে ইউনিসেফের প্রস্তাব হলো শিক্ষাখাতে ন্যূনতম ৫% বরাদ্দ আবশ্যিক।
করোনাভাইরাসের আক্রমন বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতির দৃষ্টিভংগী পালটে দিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। স্বাস্থ্যখাত এখন সবচাইতে বেশী আলোচিত পৃথিবীব্যাপী। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের ব্যাপারে বিশেষ বরাদ্দ বা পরিকল্পনা থাকবে এটাই ছিল প্রত্যাশিত। এবারের প্রস্তাবিত বরাদ্দ হলো ২৯,২৪৭ কোটি টাকা, পূর্ববর্তী বছরে তা ছিল ২৩,৬৯২ কোটি। জিডিপির হিসেবে এটা ১.০৯%। পৃথিবীর সবচাইতে ভালো স্বাস্থ্যব্যবস্থাগুলোতে তাদের জিডিপির ১১% এর উপরে বরাদ্দ থাকে। অতটা আশা করা ঠিক নয়। কিন্তু অন্ততঃ জিডিপির ৫% শতাংশ বরাদ্দ এবং সেই মোতাবেক পরিকল্পনা আশু পদক্ষেপ হওয়াটা অযৌক্তিক নয়। তুলনা যদি করা হয়, তাহলে বলা যায় সিভিল সার্ভিসে ব্যয় বরাদ্দ জিডিপির প্রায় ৪.২৩%। বিষয়টি নিশ্চয়ই মাননীয় অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টির বাইরে নয়।
সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যান অধিদপ্তরে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ৩১,৫৯৯ কোটি টাকা, পূর্ববর্তী বরাদ্দ ছিল ৩০,৪৪৪ কোটি টাকা। যেখানে বলা হচ্ছে করোনা আক্রমনের ফলে দেশের প্রায় ৫ কোটি লোক তাদের অর্থনৈতিক স্তরের নীচে নেমে আসবে। ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে নামার পর্যায়ে রয়েছে সেখানে সামাজিক নিরাপত্তাখাতে বাজেট বৃদ্ধি হলো মাত্র ৩.৭%। ৫ কোটি মানুষকে রেশনের আওতায় আনার কোন প্রস্তাবনা নেই।
কৃষি এ সংকটে আমাদের অর্থনীতির রক্ষাকর্তা। কৃষিতে কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে সকল ধরণের প্রণোদনা দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে পারে। এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ২৯,৯৮১ কোটি টাকা। পূর্বতন বরাদ্দ ছিল ২৭,০১৮ কোটি টাকা। আগামী ৬ মাস করোনা আক্রমন অব্যাহত থাকলে কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানকেই প্রধান্য দিতে হবে। সেক্ষেত্রে এই প্রস্তাবনা নীতিগতভাবে সেই নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা অবশ্যি বিবেচনা করা যেতে পারে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে এবার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা, বিগত বছরে তা ছিল ৩৬৭ কোটি টাকা। পরিসংখ্যানে এই উপাত্তটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হবে কোথায়ও ভুল আছে। তার অর্থ দেশের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বাজেট কমিয়ে দেওয়া হলো। দেশে শ্রম ও কর্মসংস্থানের প্রয়োজন নেই (!!!)। তাহলে মন্ত্রণালয়টি আছে কেন? দেশে এই ক’মাসে ৩ কোটি মানুষ বেকার হয়ে গেল। অথচ কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কোন দায় নাই বা দিশা নাই। হয় বিষয়টা আমরা বুঝতে পারছি না, নতুবা গুরুতর গলদ আছে কোথায়ও।
এখন দেখা যাক, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারটি। সেখানে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ১,৬১৫ কোটি, বিগত বছরে তা ছিল ১,৭৫৬ কোটি। এখানেও বাজেট কমিয়ে দেওয়া হলো। এই মন্ত্রণালয়ে কি কোন মন্ত্রী মহোদয় আছেন? নাকি তাঁর দফতরে রাষ্ট্রের কোন দায় আর নাই, সবই চলে গেছে বেসরকারি খাতে। কেউ কি বুঝিয়ে বলবেন?
এখন আসুন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে। এই দুই মন্ত্রণালয়ে হাজার হাজার শ্রমিকের মজুরির বকেয়া রয়েছে, তাঁদের গ্রাচ্যুইটি, পেনশনের টাকা দেওয়া হয় না। জীবিতকালে এই টাকা তাঁরা পান না। বহুবার প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে তাঁদের কিছু কিছু বকেয়া দেওয়া হয়েছে। শ্রমিক ভাইএরা আশা করেছেন এবার বাজেটে এই দুর্দিনে তাঁদের বরাদ্দ হবে। কিন্তু আসল চিত্রটি কি? এবারের বাজেট বরাদ্দ হয়েছে সর্বমোট ৭১৪ কোটি টাকা, গতবার ছিল ৮৫১ কোটি টাকা। যতদূর জানা আছে শ্রমিকদের পেনশন গ্র্যাচ্যুইটির টাকাই বাকী আছে ৮০০ কোটি টাকার উপর। মাননীয় অর্থমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা এর ব্যাখ্যা দেবেন কি?
তাহলে উপাত্ত বলছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, কৃষি, শিল্প এবং সামাজিক নিরাপত্তা কোন খাতেই মাননীয় অর্থমন্ত্রী যথাযথ বা পরিকল্পিত সংস্থান রাখেননি যাতে এ বাজেটকে কেউ বিশেষ বাজেট বলতে পারেন। দেশের বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদরাও নিশ্চয় বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।
সবশেষে আসা যাক প্রবৃদ্ধির ৮.১% বৃদ্ধির বিষয়ে যা প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধির সূচকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সর্বোচ্চ হার ছিল দক্ষিণ সুদানের (১১.৩%), দ্বিতীয় রুয়ান্ডা (১০.১%)। বাংলাদেশ ষষ্ঠ অবস্থানে ছিল (৭.৯%)। প্রথম দশটির মধ্যে যারা ছিল তারা কেউই শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ নয়। চীন ছিল উনিশতম (৬.১%), ভারত ৫৬তম (৪.২%)। আমেরিকা (২.৩%) ১০১তম, সিংগাপুর (০.৭) ১৫৭তম, জাপান (০.৭) ১৫৯ তম, জার্মানী (০.৬) ১৬০ তম। ( উৎসঃ IMF World Economic Outlook Database). ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তব প্রবৃদ্ধির হার ছিল -২.৫% অর্থাৎ ঋণাত্মক। সবাই জানে তখন সেখানে অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে তা অর্জন করতে হলে যে উপাদানগুলো জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে তা পূর্বের লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম উপাদানটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত, কর্মসংস্থানের সঙ্গে জড়িত। যদি সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা না থাকে তাঁর ব্যয় ক্ষমতাও থাকে না। তাহলে যদি শুধুমাত্র সম্পদশালী মানুষের ব্যয় ক্ষমতাকে গণনা করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নির্ণয় করা হয় তাহলে সেই সূচক কি দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র বলবে? নোবেল বিজয়ী বাংগালী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি সম্প্রতি বলেছেন, (উৎস আনন্দবাজার পত্রিকা।) প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা দিতে হবে, টাকা ছাপিয়েও তা করতে হতে পারে । কারণ হিসেবে বলেছেন,মানুষের ক্রয়ক্ষমতা রাখতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব তাঁর কর্মসংস্থান তৈরি করে অর্থনীতিতে তাঁর স্থান করে দিতে হবে। জিডিপির উপাদানের দ্বিতীয় বিষয় হলো বেসরকারি ও সরকারি বিনিয়োগ। এই সংকটকালে বিনিয়োগের পরিকল্পনা বাজেটে দৃশ্যমান নাই। সরকারি বিনিয়োগ যা জিডিপির শরীর বড় করবে অথচ উৎপাদনশীল খাতে না হয়ে তা অনুতপাদনশীল খাতে হবে তাতে অর্থনীতি স্বাস্থ্যবান হবে না। বিনিয়োগ সেখানেই হতে হবে যেখানে উতপাদনমুখী কর্মসংস্থান হবে। বৈশ্বিক বাজারের দিকে কম তাকিয়ে আভ্যন্তরীণ বাজারকে চাংগা করলে ‘নিট বাণিজ্য’ ধনাত্মক ভূমিকা রাখতে পারে। বাজেটে তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে কিন্তু কার্যতঃ তা অনুপস্থিত। চীনসহ অনেক দেশই প্রথাগত ভাবে এবার প্রবৃদ্ধির উপর জোর না দিয়ে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করেনি। কারণ প্রবৃদ্ধির চেয়ে জীবন ও তার সঙ্গে সঙ্গে জীবিকা বড়। প্রবৃদ্ধির হারের শুভংকরের ফাঁকিতে প্রকৃত অর্থনীতি চলবে না। ফলে বাজেট হতে হবে বাস্তবতা নির্দেশিত পথে অধিকাংশ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাকে টিকিয়ে রাখার বাজেট।
শেষের কথা অবশ্যই বলতে হবে বাজেটের অর্থ সংস্থানে কর ধার্যের যে বিষয়গুলো নির্দিষ্ট হয়েছে তাতে এটা পরিষ্কার নয় এই করের বোঝা কার ঘাড়ে যাচ্ছে। পরোক্ষ করের বোঝা সাধারণ মানুষকেই বহণ করতে হচ্ছে। কর্পোরেট কর কমানো হয়েছে। করধার্যের উর্ধ্বসীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে, কিন্তু ব্যাংকে স্বল্প সঞ্চয়ের উপরও কর বৃদ্ধির বিষয়টি রয়েছে। পেনশনভোগী, গ্রামীন নারীদের ডাকঘর সঞ্চয়ের বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি। এ নিয়ে আগেও বিভ্রান্তি হয়েছে। সর্বোপরি আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংক ঋণের যে প্রস্তাবনা আছে তা শেষ বিশ্লেষণে স্বাস্থ্যকর নয়।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তার নীতিগত অবস্থানে দাঁড়িয়ে বাজেট অধিকাংশ মানুষের কল্যান করবে পরিসংখ্যান তা বলছে না।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, কাদের জন্য বাজেট করলেন? প্রশ্নটা কি অযৌক্তিক?