বৈশ্বিক অর্থনীতি-রাজনীতি ও সম্ভাব্য ভবিষ্যত

Sharing Helps!

২০২০ সালের বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতির হিসেব নিকেশ আবর্তিত হয়েছে কোভিড ১৯ কে ঘিরে। আজ এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, কোভিড ১৯ বিশ্ব অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে। প্রতিটি দেশের উৎপাদনব্যবস্থা, কর্মহীন বেকারত্ব, বাজার সংকোচন,  জি ডি পির অবনমন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর সীমাহীন চাপ, শিক্ষাব্যবস্থা  স্থবির হওয়া, সকল ধরণের সামাজিক –সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড কার্যতঃ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া বৈশ্বিক সার্বিক ব্যবস্থাকেই এক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন সংগতভাবেই উঠছে, সার্বিক বৈশ্বিক পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা কি আর ভবিষ্যতই বা কোনদিকে এগুচ্ছে। এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। বিষয়টিকে ভাবতে গেলে বিগত বছরগুলির  ভূ-রাজনীতি ও বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রধান প্রবনতাগুলিকে এবং বর্তমান বাস্তবতার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা আসা  প্রয়োজন।  

একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিশেষ করে ২০০৮ সালে পৃথিবীর প্রধান অর্থনীতির ধারা অর্থাৎ বৈশ্বিক পুঁজিবাদী অর্থনীতি এক মহামন্দার সঙ্কটে পড়েছিল। এই সংকট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব মহামন্দার মতই সর্বগ্রাসী রূপ নেয়। অর্থনীতির পরিভাষায় বলা যায়, নয়া-উদারনীতিবাদী অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এক ভয়াবহ সংকটে পতিত হয়। যার ফলে, তার উপর নির্ভরশীল প্রান্তিক অর্থনীতির দেশগুলোতেও তার অভিঘাত এসে পড়ে।  

বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির উপর বেশ কিছুটা নির্ভর করে, কারণ বর্তমান বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলমান এবং কিছু কিছু  স্বার্থের দ্বন্দ থাকলেও ইউরোপসহ অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশও  যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয় অথবা তাকে অনুসরণ করে। তাই বৈশ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক গৃহীত নীতিমালা  প্রথম বিবেচনায় আনতে হয়।

২০১৭ সালে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন ডোনান্ড ট্রাম্প। পৃথিবীব্যাপী চরম দক্ষিণপন্থী শক্তির ক্রমার্বিভাবের  এক পর্যায়ে এই পরিণতি, এই আগমন। পরবর্তী চার বছর যখন তাঁর গৃহীত নীতি গোটা বিশ্বকে বিপর্যয়ের দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়েছিল, তখন আমেরিকান জনগণ এমনকি গোটা বিশ্ব কতটা বুঝেছিল আজ তার সালতামামির সময় এসে গেছে বোধহয়। ট্রাম্পের শ্লোগান ছিল, ‘ Making America great again’ । এই শ্লোগানের থেকে ‘জার্মান জাতি সর্বশ্রেষ্ট জাতি’, হিটলারের সেই নাজিবাদের  খুব মৌলিক পার্থক্য ধরা পড়ে না যা পরবর্তী বহু ঘটনায় প্রমানিত হয়েছে।      

 শপথ গ্রহণের পরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর ২০ জানুয়ারি, উদ্বোধনী বক্তৃতায়  ‘আমেরিকার নিজের স্বার্থ প্রথম’ এই নীতি ঘোষণা করেন। ২৭ জানুয়ারি ৬টি মুসলিম অধ্যূষিত দেশের উপর ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ৭ এপ্রিল, ২০১৭ তে  বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অজুহাতে সিরিয়ার উপর ক্রুজ   মিসাইল আক্রমন শুরু হয়। ১৮ মে ২০১৭ সালে NAFTA চুক্তি পূনর্বিন্যাস করা হয় মার্কিন স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। ২০১৭ সালের জুন মাসেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ১৯৫ টি দেশ স্বাক্ষরিত গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ  হ্রাসের প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করে নেন। অথচ বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ২৮ শতাংশের জন্য দায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই। তাঁর নির্বাহী ক্ষমতাবলে ফেডারেল এলাকাগুলো থেকে অতিরিক্ত তেল উৎপাদন করার অনুমতি দিয়ে ‘ক্লিন পাওয়ার প্ল্যান’কে দূর্বল  করে দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প । বাণিজ্যনীতিতে US trade deficit’ কমানোর লক্ষ্যে Trans-Pacific Partnership (TPP) ’ থেকে একপাক্ষিকভাবে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেন। ৫ জুন, ২০১৭ কিউবার সঙ্গে  সম্পর্কোন্নয়নের বারাক  ওবামা গৃহীত নীতি  পরিত্যাগের ঘোষণা দেওয়া হয়। ৮ আগস্ট , ২০১৭ তে শুরু হয়, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে বাকযুদ্ধ, যার পরিণতি সবার জানা। এমনকি ২০১৭ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর, জাতিসংঘে তাঁর প্রথম বক্তৃতায় ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তিপূর্ণ বৈশ্বিক সম্পর্ক স্থাপনে জাতিসংঘের  ভূমিকার  সমালোচনা করে জাতিসংঘের সকল উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করেন। ১৩ অক্টোবর, ২০১৭ সালেই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক  চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। ডিসেম্বর ৬, ২০১৭ তে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তার অর্থ ১ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার এক আমূল রূপান্তর ঘটিয়ে দেন। পরবর্তী বছরগুলোতে শুরু হয় আধিপত্য তৈরির নতুন পদক্ষেপ। ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে শুরু হয় চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ। আমদানীকৃত চীনা পণ্যের উপর নতুন নতুন বাড়তি শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে শুধু চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয় তাই নয়, এর ফলে  ইউরোপসহ গোটা বিশ্বেই বিশ্ববাণিজ্য অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।  

যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতির আলোকেই লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, চিলি প্রায় প্রতিটি দেশের চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলিকে ক্ষমতায় আনার জন্য শুরু হয় প্রত্যক্ষ মদদ। ব্রাজিলে বালসোনেরোকে বেসামরিক ক্যুএর মাধ্যমে ক্ষমতায় আনা হয়। ভেনিজুয়েলায় তথাকথিত বিরোধী দলীয় নেতা জুয়ান গুয়াইডোকে সে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দান এবং একের পর এক অবরোধ আরোপের মধ্য দিয়ে সে দেশের অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করে প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যূত করার নগ্ন প্রয়াস চালানো হয়। এ ছাড়া মেক্সিকো সীমান্তে পাচিল তুলে অভিবাসী আগমন বন্ধ এবং নতুন অভিবাসী নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে অভিবাসীদের এক মধ্যযুগীয় অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয় ১৯ জুন, ২০১৮ তে।

ইউরোপেও বৃটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা। ব্রেক্সিট নিয়ে ব্রিটেনের গণভোট, পরবর্তিতে সাধারণ নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী বরিস জনসনের ভূমিধস জয়, সবই যুক্তরাষ্ট্রের  সিলমোহর পায়, একই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যায়।  

চীনকে ঘেরাও করার লক্ষ্যে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওবামা গৃহীত নীতিকে আরও আগ্রাসী করার নীতি গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। চীন-ভারত সীমান্ত দ্বন্দ থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনকেও ব্যবহারের উদ্যোগও খুবই স্পষ্ট হয়েই উঠেছিল বিগত বছরগুলোতে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান বিরোধীতার পুরস্কারস্বরূপ সৌদি আরবকে যুদ্ধাস্ত্র যোগানসহ সকল কূটনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হয়। প্যালেস্টাইনের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইস্রাইল-সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের রক্তাক্ত যুদ্ধের অনৈতিক অবস্থান সত্বেও এই আঁতাত অব্যাহত রাখা হয়। ইসরাইলের স্বার্থকে বহাল করার জন্যে নতুন মধ্যপ্রাচ্য নীতি ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ২০২০ সালের জানুয়ারীতে। মার্চ ১৩, ২০২০ করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের লক্ষ্যে জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে দেরী হয়ে গেছে। করোনা ভাইরাসের বিপদকে প্রথম দিকে অবহেলা করে শেষ দিকে ‘জাতীয় জরুরী অবস্থা’ ঘোষণা করা হয়। ইতিমধ্যে কোভিট ১৯ এর উৎস নিয়ে চীনকে কোনঠাসা করার লক্ষ্যে চীনের বিরুদ্ধে ‘ব্লেম গেম’ শুরু করে মূলতঃ এই বিশ্বমারীর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় ট্রাম্প প্রশাসন। যার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে নাম প্রত্যাহার, অনুদান বন্ধ ঘোষণা থেকে শুরু করে সকল কূটনৈতিক পদক্ষেপে ট্রাম্প চুড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, যার পরিণতিতে তাঁকে নির্বাচনে হেরে যেতে হয়েছে। এমনকি ট্রাম্প তাঁর ইউরোপীয় বন্ধুদের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি করেছে। তার গৃহীত আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ নীতির বিপর্যয়কর  ফলশ্রুতিতে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প হেরেছেন।

এখানে প্রাসংগিকভাবে বলা যায়, কোভিট ১৯ মোকাবিলায় চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, লাওস, কম্বোডিয়া নিজের দেশে  দৃশ্যমান সফলতা অর্জন করে এবং বৈশ্বিক পরিসরেও তাঁদের প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখে  যা স্পষ্টতঃই পুঁজিবাদী স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং সমাজতন্ত্রমুখী দেশগুলির স্বাস্থ্যব্যবস্থার মৌলিক পার্থক্য সামনে নিয়ে আসে।

যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে ‘ক্যাপিটাল হিল’ আক্রমনের মত অনেক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে যা তথাকথিত ‘আমেরিকান গণতন্ত্রের’ জন্য কোন সুখকর ঘটনা নয়। সেটা আলাদা আলোচনার বিষয়। কিন্তু জো বাইডেনকে বাধ্য হতে হবে আমেরিকার স্বার্থে অনেক বিষয় যা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাকে উলটে দিতে, যার কিছু বিষয় যেমন প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে পুনরায় যোগদান, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় ফিরে আসা এবং আর্থিক অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিতে প্রত্যাবর্তনের বিবেচনার কথা তিনি ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের ইতি ঘটানোর ব্যাপারে  তাঁর সুস্পষ্ট নীতি ঘোষিত হয়নি। তবে সে ব্যাপারেও চিন্তা হতে পারে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে জো বাইডেন এবং শী জিন পিং এর মধ্যে দু ঘন্টার বেশী ফোনে আলাপ হয়েছে। দু জনেই যথেষ্ট সতর্কভাবেই এগুবে সন্দেহ নেই। বৈদেশিক বিভিন্ন পদক্ষেপ ছাড়াও  আভ্যন্তরীণ  অনেক ক্ষেত্রে যেমন স্বাস্থ্যনীতি, অভিবাসন নীতি এবং সর্বোপরি কোভিট ১৯ মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গৃহীত নীতি থকে সুস্পষ্ট পৃথক নীতি গৃহীত হচ্ছে। তিনি ইতিমধ্যে তাঁর এক্সিকিউটিভ ক্ষমতাবলে কিছু ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এটা অনুমেয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার  নয়া উদারনীতিবাদিক নীতির বাইরে মৌলিকভাবে কিছু করা তাঁর পক্ষে যে সম্ভব নয় এবং  তা নিয়ে কেউ দ্বিমত করবে না।  তবে আমেরিকান জনগণের পাশাপাশি বিশ্বের বহু মানুষের এ ব্যাপারে প্রত্যাশা থাকতেই পারে। কিন্তু, প্রত্যাশা আর বাস্তবতা কি সেটা বিবেচনার মধ্য দিয়েই বোঝা যাবে বৈশ্বিক পরিস্থিতির সামনের গতি প্রকৃতি কি।

বর্তমান বাস্তবতায় দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা বাণিজ্য উত্তেজনা এবং তা নিরসনে নীতিনির্ধারণী অনিশ্চয়তার ফলে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যে তাৎপর্যপূর্ণভাবে  দূর্বল হয়ে গেছে তা আজ সর্বজনস্বীকৃত। বিগত দশ বছরে অর্থনীতির শ্লথ গতির ফলে ২০১৯ সালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২.৩% এর উপরে ওঠেনি। করোনার আঘাতে অর্থনীতির পর্যুদস্ত অবস্থায় ২০২০ সালে ঈপ্সিত প্রবৃদ্ধি ২.৫% অর্জিত হয়নি, ২০২১ সালের ইপ্সিত প্রবৃদ্ধি ২.৭% অর্জন অনিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো অনেকটাই নির্ভর করছে সার্বিক সুষ্ঠ  নীতি নির্ধারণ  এবং করোনা মোকাবিলার কার্যকর সফলতার উপর। পক্ষান্তরে এশিয় অর্থনীতির মধ্যে চীনের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, যদিও জাপান এখনও স্থিতিশীল নয়। ভারতীয় অর্থনীতি প্রচন্ডভাবে স্থবির হয়েছে। তবে অনেকে  আশা করেন, ২০২১ সালে তা ঘুরে দাঁড়াবে এবং প্রবৃদ্ধি ২ অংক ছুঁয়ে যেতে পারে। কিন্তু তা স্বত্বেও পুর্ববর্তী পর্যায়ে পৌঁছাতে সময় লাগবে।  কিন্তু, যে ব্যবস্থার মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতি এগুতে চাইছে, তার অন্তর্নিহিত সংকট তাকে সেখানে যেতে দেবে না, যা উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর ক্ষেত্রেও  প্রযোজ্য। আসিয়ানভূক্ত দেশগুলোর উন্নতির দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে সামনের বছরগুলোতে এশিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এটা জোর দিয়ে বলাই যায়।  

এই মুহূর্তে বৈশ্বিক সামষ্টিক অর্থনীতির সার্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অনেক অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিদই তিনটি বৈষম্যকে প্রধান সংকট হিসেবে দেখতে চাইছেন। (এক) মুদ্রা বৈষম্য (money apartheid) ( দুই) খাদ্য বৈষম্য ( Food apartheid) (তিন) ঔষধ বৈষম্য ( Medicine apartheid) .

উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলির মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ১১ ট্রিলিয়ন ডলার। এই দেশগুলিকে সুদসমেত এই ঋণ পরিশোধের জন্য বছরে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার শোধ করতে হয়, যা প্রায় ৬০ টি উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বাজেটকৃত অর্থের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া রয়েছে ফিনান্সিয়াল পুঁজির  বিনিয়োগ মুনাফার সুযোগ। আন্তর্জাতিক পুঁজির পরিচালন ও বিনিয়োগ ব্যবস্থা এই মুদ্রা বৈষম্যের জন্য দায়ী। FDI সরবরাহের উপাত্তও একই চিত্র প্রকাশ করে।  আরোও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, উদারনৈতিক পুঁজিবাদ তাঁর অস্তিত্বের প্রয়োজনে সৃষ্টি করছে এই অবশ্যম্ভাবী বৈষম্য।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল  টেড্রোস ঘেব্রেয়েসুস  (Tedros Adhanom Ghebreyesus ) তাঁর এক সাম্প্রতিক সাক্ষাতকারে বলেছেন, গোটা বিশ্ব আজ এক ভয়াবহ নৈতিক ধ্বংসের মুখোমুখি এবং তার মূলে রয়েছে কোভিড ১৯ এর ভ্যক্সিন জাতীয়করণ ও ভ্যাকসিন মজুতদারি নীতি। জাতিসংঘের COVAX প্রোজেক্ট ব্যর্থতার  মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেতে পারে। তার অর্থ উন্নত ও ধনশালী দেশগুলি ভ্যাকসিন পেলেও অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলি বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এমনকি যে সকল দেশের  ভ্যাক্সিন তৈরি পরিকাঠামো নেই বা করতে পারবে না তাদের অর্থ থাকলেও প্রয়োজনীয় সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হবে। কোভিট ১৯ অসুধ বৈষম্য বা চিকিৎসা বৈষম্যের এই দিকটাকে আরও গভীর করে দিয়েছে।  

তৃতীয়তঃ খাদ্য বৈষম্য। বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে কিছুটা কমেছিল । কিন্তু তারপরের বছরগুলোতে বৈশ্বিক নানা টালমাটাল পরিস্থিতি, ২০২০ সালের প্রারম্ভেই কোভিট ১৯র আঘাত, বিশ্বব্যাপি ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে দৃশ্যমানভাবে। FAO এর ২০২০ সালের হিসেব মোতাবেক ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৮৪০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। যদিও চীন ২০২০ সালেই তাঁদের দেশের দারিদ্রপীড়িত জনসংখ্যা শূন্যের কোঠায় নিতে পেরেছে, তবুও  আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার বহু দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। করোনা পরবর্তী অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যলেঞ্জ।

বাস্তব পরিস্থিতির এই পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে এটা বলা যায় অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনটি প্রবণতা প্রাধান্যে আসবে। এগুলি হলোঃ

(১) পুঁজিবাদের নয়া-উদারনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত কাঠামোগত সংকট বৃদ্ধি পাবে। অতি কেন্দ্রীভবন সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলবে যা বৈশ্বিক পুঁজিবাদের  কেন্দ্র ( kernel) কে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। পুঁজিবাদের বৈশ্বিক নেতৃত্ব মরিয়া হয়ে এই সংকট থেকে পরিত্রানের রাস্তা খুঁজবে। পাবে কি না তা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে।

(২) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ৫ জি প্রযুক্তিসহ আরও বিকাশমান প্রযুক্তি ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন উৎপাদন বাবস্থায় সন্নিবেশিত হবে,  যা উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধিতে উল্লফন ঘটাবে। উৎপাদন শক্তির এই বিকাশ বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে অতি-উৎপাদনের বাস্তবতা তৈরি করবে, যদি তার সঙ্গে সাযুয্যপূর্ণ সামাজিক বন্টন অনুপস্থিত থাকে, তাহলে অটোমেশনের ফলে বেকারত্ব তৈরি হবে, যার আলামত উন্নত দেশসহ বিশ্বব্যাপি দৃশ্যমান হচ্ছে এখনই। যা দীর্ঘস্থায়ী  অর্থনৈতিক স্থবিরতা তৈরি করবে, যা সাধারণ সংকটে রূপান্তরিত হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে। ‘প্রলেতারিয়েতের’ পাশাপাশি ‘প্রিকারিয়েটে’র মত শ্রেণীর জন্মও নতুন বাস্তবতা তৈরি করবে।   

(৩) বৈশ্বিক অর্থনীতির ‘ভরকেন্দ্র’ এশিয়ার দিকে স্থানান্তরিত হবার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।  জনসংখ্যার দিক দিয়ে এশিয়া বিশ্বের তিন পঞ্চমাংশের আবাসস্থল। চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ  কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলির মোট সম্পদ ও প্রবৃদ্ধির হারের বিবেচনায় তা বিশ্বের বর্তমান প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলির সঙ্গে তুলনীয় হয়ে উঠছে এবং তা ক্রমবর্ধনশীল। এর সঙ্গে রাশিয়ান ফেডারেশনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এশিয়ার সঙ্গে বিশেষ করে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ট হবার ফলে-পশ্চিমের প্রাধান্যে একমুখী বিশ্বের পরিবর্তে দ্বিমুখী বা বহুমুখী বিশ্বে  রূপান্তরিত হবার প্রবণতাও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গত ১৫ নভেম্বর, ২০২০  আসিয়ানভূক্ত  ১০টি দেশসহ চীন, জাপান, দক্ষিণ  কোরিয়ার মত এশিয়ার  ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তির  ১৫ টি দেশের  মধ্যে  পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক চুক্তি ( The Regional Comprehensive Economic Partnership, or RCEP) সম্পাদিত হয়েছে। এটা প্রায় ৮ বছরের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফল ।  পৃথিবীর প্রায় ২.২ বিলিয়ন মানূষের বাস এই বাণিজ্যিক চুক্তির আওতায়। এই চুক্তি এশিয় অর্থনীতির বৈশ্বিক প্রধান্য বৃদ্ধির  প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে সন্দেহ নেই।    

তাই বলা যায়, পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রাধান্যে চলা অর্থনৈতিক অবস্থার আভ্যন্তরীণ সংকটও যেমন ক্রমবর্ধমান, এর পূনর্বিন্যাসও তেমনি সম্ভাবনাময়। কোভিড ১৯ এর আঘাত এটাকে আরও দৃশ্যমান করে তুলেছে।  কিন্তু এটা বলতেই হবে, পুঁজিবাদের সংকট অর্থই তাঁর নিঃশেষ হওয়া নয়। সোভিয়েত ব্যবস্থার বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী বিশ্বে যে শোরগোল উঠেছিল, ‘সমাজতন্ত্র’ শুধুমাত্র ইতিহাসের একটি ‘দূর্ঘটনা’, পুঁজিবাদই শেষ কথা’, এই দাবীর জোর প্রায় নিঃশেষ। অন্যদিকে  আপ্তবাক্যের মত বলা, ‘পুঁজিবাদের সংকট গভীর হচ্ছে, সমাজতন্ত্র আসন্ন’ এমনি সহজ সরলরৈখিক সিদ্ধান্তও অবৈজ্ঞানিক। পুঁজিবাদের বিকল্প সমাজব্যবস্থার সচেতন সংগ্রাম ও কাঠামো তাকে প্রতিস্থাপন না করলে মানব সভ্যতার শেষ পরিণতি সম্পর্কে অনেকেই হতাশা পোষণ করেছেন। পুঁজিবাদের হাতে বিশ্বসভ্যতা আর নিরাপদ নয়। তাই একে প্রতিস্থাপন করার সমাজবিপ্লবের সচেতন প্রক্রিয়া  যত দ্রুত তৈরি হবে, ততই মংগল। কোনো  ধরণের ‘সবুজ বা মানবিক পুঁজিবাদ’  নয়, সমাজতন্ত্রই এই সংকটের সমাধান। বিশ্বের প্রতিটি দেশের আভ্যন্তরীণ পুঁজি ও বৈশ্বিক পুঁজির  শোষণের বিরুদ্ধে কার্যকর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংগ্রাম যত দ্রুত ও কার্যকরভাবে গড়ে উঠবে, বৈশ্বিক সংকটের হাত থেকে তত  দ্রুত নিস্তার সম্ভব হবে।


Sharing Helps!