১। শুরুর কথাঃ
৩০ মার্চ, ২০২০ এই লেখা পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ৭, ২৩, ০৭৭ জন, মৃত ৩৩,৯৮৪ জন, সুস্থ হয়েছেন ১, ৫১, ৭৯৩ জন। চীনের সংগে সীমান্ত আছে অথবা প্রাত্যহিক জনযোগাযোগ আছে এর মধ্যে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, উত্তর কোরিয়ায় ও মঙ্গলিয়ায় কোন মৃতের নিশ্চিত খবর নেই। দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৯,৬৬১ জন, মৃত ১৫৮, সুস্থ হয়েছেন ৫,২২৮ জন। করোনা প্রতিরোধে যে দেশগুলো ‘আক্রমনাত্মক’ বা ‘Aggressive’ পদক্ষেপ নিয়ে আলোচিত হয়েছে, তারমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া একটি। পৃথিবীর যে কয়টি দেশ বা অঞ্চল করোনা আক্রান্ত হয়েছে অথচ একজনও মৃত্যুবরণ করেননি, তার সংখ্যা ৭৬। এর মধ্যে সবচাইতে জনবহুল দেশ ভিয়েতনাম । অথচ এখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৯৪, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন ২৫ জন, একজনও মারা যাননি। ভিয়েতনামে মোট জনসংখ্যা ৯৫,৫৪৫,৯৬২। এত বিপুল জনসংখ্যার একটি দেশে এত কম সংখ্যক ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়া, একজনও না মারা যাওয়া, বিশেষ পর্যবেক্ষণের দাবী রাখে। দক্ষিণ কোরিয়ার বিষয়ে অনেকই আলোচনা হয়েছে, চীনের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে, তবুও WHO সহ ইউরোপের অনেকেই চীনের করোনা প্রতিরোধের প্রশংসা করেছে। কিন্তু ভিয়েতনামের করোনা যুদ্ধের বিষয়টি কিছুটা নীরবে এবং অনালোচিত রয়েছে, অথচ তারা দৃশ্যতঃ সবচাইতে সফল। ফলে, এ বিষয়ে পর্যালোচনা হওয়া উচিত। অর্থনৈতিক শক্তির বিচারে অনেকের পিছনে থাকা সত্ত্বেও করোনা মহামারি প্রতিরোধে এদেশের গৃহীত ব্যবস্থার কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা ও চীনের তুলনায় কম খরচভিত্তিক হওয়ায় WHO সহ বিশেষজ্ঞ মহলের কাছেও প্রসংশিত হলেও, সাধারণের সামনে আসেনি। পক্ষান্তরে, দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বা মৃতের সংখ্যা বেশী হওয়া সত্ত্বেও, রোগী সনাক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত aggressive বা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ বিশ্বের বিভিন্ন মহলে প্রসংশিত হয়েছে। সেই তুলনায় ভিয়েতনাম আড়ালেই থেকে গেছে।
২। যেভাবে প্রাথমিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়ঃ
ভিয়েতনাম সরকার চীনের প্রথম রোগী আক্রান্ত হবার সংবাদ পেয়েই দ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ভিয়েতনামের উপ-প্রধানমন্ত্রী Vu Duc Dam বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে যৌথ বৈঠক করে মহামারি প্রতিরোধে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ভিয়েতনামের হ্যানয়ে প্রথম আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়। চীনের উ হান শহর থেকে আসা এক ব্যক্তি হ্যানয়ে বসবাসরত তার ছেলেকে দেখতে আসেন। তিনি এবং তাঁর ছেলে দুজনেই আক্রান্ত বলে চিহ্নিত হন। তারা অসুস্থ হয়ে ২২ জানুয়ারি হো চি মিন শহরে চো বে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানেই পরীক্ষায় তারা ‘পজিটিভ’ ধরা পড়েন। ২৪ জানুয়ারি, দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভু ডাক ড্যাম Emergency Epidemic Prevention Centre কে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও কার্যকর পদক্ষেপের আদেশ (নির্দশনা নয়) দেন। ২৯ জানুয়ারি আক্রান্ত ছেলেটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন, ১২ ফেব্রুয়ারি তাঁর পিতা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। তাদেরকে সর্বোচ্চ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
১ সপ্তাহ পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও ৩ জন নতুন পজিটিভ রোগী সনাক্ত করে, যারা উ হানে গিয়েছিলেন। ২৫ বছর বয়স্কা নারীকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয় এবং তিনি সুস্থ হন। এটা ঘটে Thanh Hoa প্রদেশে। বাকী দু’জনের একজন ২৯ বছর বয়স্ক পুরুষ আর একজন ২৩ বছর বয়স্কা নারী হ্যানয় হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ৩ রা ফেব্রুয়ারি তাঁরা সুস্থ হয়ে ফেরেন। বিশেষ দ্রষ্টব্য একজন ব্যতিত তাঁদের সবার বয়স ৩০ এর নীচে।
এরপর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৬ জন আক্রান্ত রোগীর অধিকাংশ চীন থেকে আসা আক্রান্ত রোগীদের সংগে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি। তাঁদের সবাইকে quarantine এ রাখা হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত কোন রোগী শনাক্ত হয়নি, তবে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা হয়। ৬ মার্চ, ২৬ বয়স্কা এক নারী যিনি সম্প্রতি ইউরোপ ভ্রমন করে হ্যানয়ে এসেছেন, তিনি শনাক্ত হন। ৭ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে বর্তমান অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।
৩। প্রতিরোধ ব্যবস্থা কি নেয়া হয়েছিল?
প্রথম রোগী শনাক্ত হবার পরই ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী নগুয়েন হুয়ান ফুক ( Nguyen Xuan Phuc) সকল ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে আদেশ দেন এবং সংগে সংগে সকল ভিয়েতনাম নাগরিককে আক্রান্ত এলাকা ভ্রমনের উপর সতর্কতা জারি করেন। উপমন্ত্রী Do Xuan Tuyen প্রয়োজনীয় অবস্থায় ভিয়েতনাম-চীন সীমান্ত বন্ধের বিষয় বিবেচনার কথা ঘোষণা করেন। সায়গন পর্যটন বিভাগ উ হান এর সকল পর্যটক ভ্রমন বন্ধ করে দেয়। ২৪ জানুয়ারি ভিয়েতনামের বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় উ হানের সংগে সকল বিমান যাতায়াত নিষিদ্ধ করে। করোনা প্রতিরোধের জন্য সকল aggressive পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ১৪ দিনের জন্য বাইরের সকল কাজ বন্ধ করে কোয়ারিন্টাইন জারি করা হয়। কোন কোন স্থানে তা ২০ থেকে ৪০ দিন বর্ধিত করা হয়। ভিয়েতনাম পিপলস আর্মি টহল ও নিয়ন্ত্রন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আগত সকল নাগরিকের উপর শনাক্ত পরীক্ষা ও স্ক্রিনিং এর আওতায় আনা হয়। প্রথম দিকে স্থানীয় দোকানে সার্জিক্যাল মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দ্রুত বাজার থেকে শেষ হয়ে যায়। ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সকল নাগরিককে শান্ত থাকতে বলেন এবং বাজার থেকে অতিরিক্ত জিনিষ কেনার উপর কঠোর বিধি জারি করেন। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যাতে কেউ মুনাফার নিতে না পারে তারজন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
বিশেষ জরুরি বিষয় সকল অর্থনীতিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সকল ধরণের খেলার লীগ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সকল ধর্মীয় সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মালয়েশিয়া থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের বাৎসরিক উৎসব Tabilghi Jamat ধর্মীয় নেতাদেরকে সংগে নিয়ে বন্ধ করা হয়। এদের মধ্যে ২ থেকে তিন জন আক্রান্ত রোগী ছিল তাদেরকে আলাদা করে কোয়ারিন্টাইনে নিয়ে যাওয়া হয়।
৪। পর্যবেক্ষণঃ
ভিয়েতনাম সরকারের গৃহীত সকল ব্যবস্থায় সরকারি উদ্যোগ, শৃঙ্খলা , সামাজিক সচেতনতা, সতর্কতা, আক্রান্ত রোগীদের উপর চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের নিষ্ঠার ফলে, খুব উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থেকেও সর্বোচ্চ সতর্কতার সংগে ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁরা এখনও এই মহামারি প্রতিরোধে পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে এগিয়ে থাকা দেশগুলির মধ্যে একটি। এমনকি তাঁরা প্রথমদিকে কোনও ওসুধও ব্যবহার করেনি। ফেব্রুয়ারীর প্রথম দিকে ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী Dr. Nguyen Thang Long বলেন, “ There is no medication for the virus yet. We rely on fundamental principle.” “ এই ভাইরাসের এখনও কোন ওষুধ নাই। আমরা মৌলিক নীতির উপর বিশ্বাস করছি।“ হো চি মিন শহরের শিশু হাসপাতালের প্রধান বলেন, “ If an infected person is in the area, he will report it” “ কোন এলাকায় কেউ আক্রান্ত হলে, সে রিপোর্ট করবে।“ ক্যানবেরার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস প্রফেসর Carl Thayer বলেছেন, “ Vietnam is a mobilization society. It is a one party state, it has large public security forces, the military and the party itself; and it’s top-down government that’s good at responding to natural disaster.” এই পদ্ধতির সমাজ কারুর পছন্দ না হতে পারে, দুর্যোগের সময় এই বাস্তবতায় তার কার্যকারিতা নিয়ে, কারুর প্রশ্ন তোলা কঠিন।