লোহানী ভাইকে নিয়ে কিছু একটা লিখতে হবে। কিন্তু কি লিখবো? কোথা থেকেই বা শুরু করবো?
লোহানী ভাইএর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ’৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। আগে নাম শুনেছি অনেক। সাক্ষাতে দেখা হয়নি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া চুকিয়ে , চাকরি, বাকরি না করে, পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে রাজশাহীতে রয়েছি। না ছিল থাকার কোন জায়গা, না খাবার। কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হলে, কখনও রাজশাহী শহরে কোন আশ্রয়দাতার বাড়িতে। এই সময়ে লোহানী ভাই এলেন রাজশাহীতে। একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হয়ে। পত্রিকার নাম হবে বোধহয় ‘দৈনিক বার্তা ?’। ঐ পত্রিকার তখন বার্তা সম্পাদক আমাদের অতি প্রিয় ওয়াজেদ ভাই। আমি তখন থেকেই মোটামুটি সচ্ছল হয়ে গেলাম। যত রাতই হোক লোহানী ভাইএর বাসায় গেলেই খাওয়া থাকার কোন চিন্তা নেই। কোন কোন দিন ওয়াজেদ ভাইএর বাসা। মোটামুটি ‘দৈনিক বার্তা’র অফিসটাই জীবনের আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠলো। কোনোদিন সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে সাংগাঠনিক যোগাযোগ ছিল না, কারণ সে যোগ্যতা ছিল না। কিন্তু নীরব শ্রোতা বা দর্শক ছিলাম, সরব অংশগ্রহণ ছিল না। তবুও লোহানী ভাইএর প্রতি ছিল অমোঘ আকর্ষণ। সুপুরুষ, ভরাট গলা, সদাহাস্যময় মুখ, তাঁর নিজের জগতে কিংবদন্তী। একদিন ‘দৈনিক বার্তা’ অফিসে তাঁর ঘরে লোহানী ভাই একটি চেয়ারে আমাকে বসিয়ে রেখে কোথায় ভিতরে প্রেসের কিছূ একটা দেখতে গেছেন। ওয়াজেদ ভাই তখনও আসেননি। আমাকে ঐ চেয়ারটায় বসে থাকতে দেখে তাঁর অনেক কলিগ দেখলাম অস্বস্তি বোধ করছেন। আমি বুঝতে পারছি আমি তাঁদের কাছে প্রত্যাশিত নই, অন্ততঃ ঐ চেয়ারটায়। কি করবো বুঝতে পারছি না। লোহানী ভাই এলেন। তাঁর সেই দরাজ হাসি দিয়ে বললেন, ‘এই সুশান্ত, তোমাকে বসিয়ে রেখেছি।‘ তারপর কিছু একটা আঁচ করে আমার মত হতচ্ছাড়া চেহারার মানুষটাকে তাঁর কলিগদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, এমন বিশেষণে ভূষিত করে যে আমি নিজেই লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। এই হলো লোহানী ভাই। তারপর কতকাল, কত সময় কেটে গেছে। সেই লোহানী ভাইয়ের বাসা আমার চলে আসার পরও ছিল রাজশাহী পার্টির কর্মীদের অফিস কাম আশ্রয়স্থল। এ কথার ইতিহাস কেউ লেখেনি।
অসুস্থ হয়ে বাধ্য হয়ে রাজশাহী ছাড়লাম। পার্টির নির্দেশে এবং সিদ্ধান্তে সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে চলে এলাম খুলনায়। আশির দশকের প্রথম দিকে, খুলনায় সম্ভবতঃ রেলওয়ে মিলনায়তনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। লোহানী ভাই প্রধান অতিথি। বন্যা ( লোহানী ভাইয়ের মেয়ে) সাথে ছিল। অত্যন্ত সুন্দর অনুষ্ঠানে লোহানী ভাই তাঁর বক্তব্য রাখলেন। মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনলাম। আমি তখন অসুস্থ। আমার টি বি হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘একি হয়েছে তোমার শরীরের?’ আমি বললাম, ‘মরবো না’। লোহানী ভাই চুপ করে গেলেন। এই প্রথম দেখলাম তাঁর হাসিমাখা মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। পিঠ চাপড়ে বললেন,’হ্যাঁ, তুমি মরবে না’। সেই সময়ে আমার কাছে ঐ কথাটার অনেক মূল্য। আসলে তখন আমি জানতামই না যে জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য কি?
জীবনে চলার পথ থেমে থাকেনা, থাকেনি। পার্টির জীবনেও তখন খুব সুসময় ছিল না। অনেক সংকট। ঐক্য, অনৈক্য সব মিলিয়ে জীবন চলেছে। লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি বহুকাল। ১৯৮৭ সালে পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য হয়ে পার্টির সিদ্ধান্তে ঢাকায় চলে আসতে হল। আশ্রয়, খাবার কোন কিছুরই নিশ্চয়তা নেই। তার উপর আমার স্ত্রী প্রমীলা সদ্যজাত ছেলেকে নিয়ে রাজশাহীতে তার পড়াশুনা করার লড়াই করছে। ঢাকায় কমরেড অমল সেনসহ, কমরেড গিয়াস ভাই, কমরেড বকুল, অনিল চন্দ মরন সবাই মিলে একধরণের ভেসে চলার মত জীবন। কমরেড নাসিম আলী এবং ভাবী মিলে তাঁদের মেয়ে ‘ডরো’কে পড়ানোর দায়িত্ব দিলেন। আসলে বকলমে বেঁচে থাকার রাস্তা করে দিলেন। ( ডরো আজও আমার মেয়ে হয়েই আছে।) নাসিম ভাইয়ের গেন্ডেরিয়ার বাসায় গিয়ে পড়াতাম। একদিন নাসিম ভাই বললেন, ‘লোহানীর সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার?’ আমি বললাম, না। নাসিম ভাই বললেন, “শুভর (সাংবাদিক শুভ রহমান) ওখানে গেলে দেখা পেতে পারেন’। নাসিম ভাই সব সময় আমাকে আপনি বলতেন। ঠিকই শুভদার বাসায় একদিন লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তাঁর সদাহাস্যময় চেহারা আর কন্ঠস্বরের কোন বদল হয়নি। সৌম্যকান্তি চেহারায় শুধু চুলগুলো পেকেছে। লোহানী ভাই শুধু শুনলেন ঢাকায় চলে এসেছি এবং আগের মতই ছিন্নমূল অবস্থাতেই আছি। বাইরে এসে শুধু বললেন, ‘মারা যাওনি, সত্যিতো?’ বললাম, ‘আপনিই তো বলেছিলেন মরবো না। আপনাকে না বলে মারা যাই কি করে।‘ বললেন, ‘প্রমীলা কোথায়? বললাম,’রাজশাহীতে। পড়া শেষ করছে।‘ বললেন ,’দেখা করো’। আসলে তারপর যখনই দেখা হয়েছে, একটা খাম ধরিয়ে বলতেন, ‘দাদাকে দিও’।
তারপর ’৯১ সালের পরে চলে গেছি সিলেটে। কালেভদ্রে দেখা হয়েছে। তারমধ্যে একবার দেখা হয়েছে ’৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আশুগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে। কমরেড ঈসার উদ্যোগে। (ঈসা ছোট হয়েও আগেই চলে গেছে)। আমি তখন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক। ঐ অনুষ্ঠানে লোহানী ভাই প্রধান অতিথি, আমি ছিলাম বিশেষ অতিথি। বক্তৃতার সময় তিনি তাঁর নিজস্ব ঢংএ দর্শক শ্রোতাদের বললেন ( যারা অধিকাংশ ছিলেন শ্রমজীবি মানুষ), ‘ এই যে ব্যক্তিকে দেখছেন আজ শিক্ষক, সে কিন্তু আসলে শিক্ষক নয়, একজন রাজনৈতিক কর্মী’। তিনি আমাকে শিক্ষকের চাইতে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বেশী ভালবাসতেন। আমি ভিতরে ভিতরে অভিভূত হয়েছিলাম। অসাধারণ তাঁর মমত্ববোধ আর শালীনতাবোধ। তাঁর লেখনি ছিল যেমন ক্ষুরধার, বাগ্মীতাও ছিল তেমনি অসাধারণ। আসলে তাঁরা ক্ষণজন্মা। সময় এবং তাঁদের তৈরি করে। তাঁরা কালের সন্তান। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং ততপরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার তাঁরা সংশপ্তক।
সবশেষে লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয়া ‘মনু ভাবি’র স্মরণসভায়। ভালো চোখে দেখতে পান না। পাশে বসে বললাম। ‘লোহানী ভাই, আমি সুশান্ত’। হাতটা ধরে সহাস্যে বললেন, ‘প্রফেসর (প্রথম আমাকে প্রফেসর সম্বোধন করলেন), আর কতদিন আমাকে এ বোঝা বইতে হবে? অনুজদের স্মরণসভায় আসতে হবে?’ আমি বললাম, ‘ লোহানী ভাই , জীবন তো এমনি। জীবনের এ ঋণ তো শোধ করতেই হবে।‘
লোহানী ভাইয়ের মহাকাব্যিক জীবন। এই জীবনস্রোতে কত সহস্র মানুষই এসেছে তাঁর সাহচর্যে। আমি তার মধ্যে একজন ভেবেই শ্লাঘা বোধ করছি।
আজ অগ্রজ লোহানী ভাই চলে গেলেন করোনার কাছে পড়াজিত হয়ে, নাকি সামাজিক রাজনৈতিক অব্যবস্থার কাছে-সেটা ইতিহাস ঠিক করবে। যারা তাঁর স্মৃতি বয়ে বেড়াবো আমরা, তাঁরা দুঃখ পাব, আমদের অশ্রু ঝরবে, কিন্তু লোহানী ভাইয়ের মত এই বোঝা হবে না তা। তা হবে ভবিষ্যতের হাতে অতীতের সমর্পণ।
লোহানী ভাই দীর্ঘকাল বাংলার সংস্কৃতি, প্রগতিশীলতা আর বিপ্লবের পতাকা বয়েছেন অবিচল দৃঢ়তায়। সকল বিভেদ আর অনৈক্যকে উপেক্ষা করে। ক্লান্তিহীন, শ্রান্তিহীন সে পথ চলা। থামলেন বটে, পতাকাটা দিয়ে গেলেন সেই হাসি মুখেই পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। সার্থক তাঁর পথচলা। দুঃখ যতই হোক, অতৃপ্তি নাই।
লোহানী ভাই, আমরা যতদিন সময় পাব, আপনার আদর্শ বয়ে বেড়াবো। সময় হলে চলে যাব, কিন্তু আপনার ধরে থাকা পতাকা দিয়ে যাব অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে, যা জীবনের ধর্ম। যে জীবন আপনারা সৃষ্টি করেছেন, সে জীবন বহমান থাকবে, চিরকাল।
লাল সালাম কমরেড।