(১) ভূমিকাঃ
২০০৮ সালের মহামন্দার পর বিশ্বপুঁজিবাদ পুনরায় স্থিতিশীল হবে এমন ভবিষ্যদবানী করা হয়েছিল। কিন্তু, বিশ্ব-পুঁজিবাদের প্রাতিষ্ঠানিক সংকট কাটেনি, বরং তা অব্যাহত রয়েছে। এমনকি, পুঁজিবাদি উন্নত দেশেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপর নেমে এসেছে শোষণের বোঝা। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে অথবা সংকুচিত করা হচ্ছে জনগণের কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক অধিকার। অর্থনৈতিক শোষণের মাত্রা তীব্রতর হচ্ছে শ্রমজীবি মানুষের উপর। তার ফলে, সে সকল দেশের শ্রমজীবি ও গণতান্ত্রিক মানুষ প্রতিরোধে নেমে আসছে রাস্তায়। পুঁজিবাদের নয়া-উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক নীতির ফলে বিশ্বব্যাপী বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটা বৈশ্বিকভাবে একদেশ থেকে অন্যদেশের মধ্যে, আবার সকল দেশের নাগরিকদের মধ্যে আভ্যন্তরীন ভাবেও। বিশ্বব্যাপী আধিপত্য দৃঢ় ও অব্যাহত রাখার জন্য এবং নিজের অর্থনৈতিক সংকটের হাত থেকে রেহাই পাবার লক্ষ্যেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্ররা বিশ্বব্যাপী সর্বাত্মক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অনুপ্রবেশ ও আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। লাতিন আমেরিকায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতিক আগ্রাসন ও সামরিক হস্তক্ষেপ বাড়িয়ে তুলেছে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, কলোম্বিয়াসহ ’লিমা গ্রুপের’র অধিকাংশ দেশের মধ্যে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সরাসরি মদদ দিচ্ছে এবং ক্ষমতায় বসিয়েছে। সম্প্রতি ভেনিজুয়েলায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য হুয়ান গুয়াইদোকে তৈরী করা হয়েছে অনুপ্রবেশের পুতুল হিসেবে। সার্বিকভাবে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ গোটা লাতিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিকে নি:শেষ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সময়কালে, ইউরোপ-লাতিন আমেরিকার প্রায় সব দেশেই দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থান হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ও আসলে মার্কিন পুঁজির সবচাইতে দক্ষিণপন্থী অংশের বিজয়। তবে, বিশ্ব-পুঁজিবাদের নিজস্ব সংকটের বহি:প্রকাশ হিসেবে বৈশ্বিকভাবে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে অন্ত:বিরোধেরও জন্ম হয়েছে। ব্রেক্সিট, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে, ইরানের সংগে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রন চুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে মতবিরোধ স্পষ্টত:ই এর প্রমান। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, যে একমেরু বিশ্বের জন্ম হয়েছিল, তারপর বিগত এক দশকে ’বহুমেরু’ বিশ্বের প্রবনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু, সা¤্রাজ্যবাদ জল,স্থল, আকাশ ও মহাকাশে তার একাধিপত্য অব্যাহত রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক অসহযোগিতা ও চুক্তিভংগের মধ্য দিয়ে হুমকির সম্মুখীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রত্যাহারের ফলে ডব্লিউ ও টি ও (WTO) এর বহুবিষয় আজ অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার নিজস্ব স্বার্থে বহুপাক্ষিক সমঝোতার বদলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা সমঝোতা তৈরী করছে। বিশ্বসংকটের এই চিত্রের পাশপাশি, বিশ্ব-পুঁজিবাদের সকল বৈরিতা সত্বেও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে এ সময়কালে চীনের অর্থনৈতিক শক্তি ও বৈশ্বিক প্রভাব বেড়েছে, ভিয়েতনাম ও কিউবা তাদের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান অগ্রগতি লাভ করেছে। পারমাণবিক চুল্লি ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাকে কেন্দ্র করে উত্তর কোরিয়াকে কোনঠাসা করার মার্কিন প্রয়াস উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতৃত্বের দৃঢ়তায় ও কুশলতায় কিছুটা হলেও স্তিমিত। অক্টোবর বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদযাপনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টিগুলির মধ্যে যোগাযোগ ও আন্তর্জাতিক সংহতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলির গভীর বিশ্লেষণ জরুরী, কারণ বিশ্বের সার্বিক এই পরিস্থিতি প্রভাবিত করছে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর দেশে দেশে রাজনীতি ও অর্থনীতি।
(২) নয়াউদারনীতিবাদ ও বিশ্ব-পুঁজিবাদের সংকট:
এটা অনস্বীকার্য -পুঁজিবাদ ও তার নয়াউদারিকরণ নীতি আজ সংকটের মুখোমুখি। ২০০৮ সালে শুরু হওয়া বিশ্ব-পুঁজিবাদের মহাসংকটের এক দশক পর উন্নত দেশগুলোর ব্যাপক জনগণের মধ্যে এই সচেতনতা দৃশ্যমান হয়েছে যে, নয়া-উদারিবাদের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিগানের ও বৃটেনে মার্গারেট থ্যাচারের হাত ধরে, কয়েক দশক পর তার ফলশ্রুতিতে লাভবান হয়েছে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী, ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এই নীতির প্রভাবে এক দুরূহ অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়েছে। অনেকের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই বা আড়াই দশক-বিশ্বপুঁজিবাদ তার স্বর্ণযুগ অতিক্রম করে এবং যুক্তরাষ্ট্র এই বিশ্ব পুঁজিবাদের নেতৃত্বের অবস্থানে চলে আসে। বিভিন্ন ওঠা নামা সত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। কিন্তু, ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সে দেশের নিচুতলার ১০ শতাংশ মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে দৃশ্যমান পর্যায়ে এবং উচু তলার ১০ শতাংশ মানুষের জীবনযাত্রা মান ও আয় বেড়েছে লাগামহীনভাবে। এই বৈষম্য আজ সে দেশের মানুষকে ১ শতাংশ ও ৯৯ শতাংশে বিভক্ত করে দিয়েছে। বর্তমানে সেখানে একজন পূর্ণকালিন শ্রমিকের প্রকৃত আয় তার চার দশক আগের আয়ের চেয়ে কম। নীচুতলার ৯০ শতাংশ মানুষের প্রকৃত আয় গত তিন দশক ধরে স্থবির অথবা প্রকৃত আয় পিছিয়ে পড়েছে। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ২৫ টি উন্নত অর্থনীতির দেশের গড়ে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ পরিবারের আয় হয় স্থবির অথবা প্রকৃত আয়ে পিছিয়ে পড়েছে। ২০০০ সালের ’গ্যালাপ পোল’ এর হিসেব অনুযায়ী ৩৩ শতাংশ আমেরিকান নিজেদেরকে শ্রমজীবি মানুষ বলেছে, ২০১৫ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪৮ শতাংশে। বৈশ্বিক জনসংখ্যার বিশাল অংশ আজ এই বৈষমের শিকার। এর ফলে, বিশ্বব্যাপী তৈরী হয়েছে ব্যাপক ক্ষোভের। এই বাস্তবতা নি:সন্দেহে এক নতুন রাজনৈতিক অবস্থার বহি:প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। আগেই বলা হয়েছে,নয়া উদারনীতিবাদের এই সংকট সা¤্রাজ্যবাদী দেশসমূহের নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ ও বৈরিতা তৈরী করেছে।
অবস্থা এতটাই নাজুক যে, ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার পর বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতি, বিংশ শতাব্দি শেষের দিকে তার যে অবস্থা ছিল, সে পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। সা¤্রাজ্যবাদ বৈশ্বিকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজি ’বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে পুঁজির ঘনীভবন’এর পথ গ্রহণ করেছে। যার ফলে, বিশ্বব্যাপী তৈরী হচ্ছে নজীরবিহীন অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠির ব্যাপক দুর্দশা আর কষ্টের।
২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে আই এম এফ ও বিশ্বব্যাংক বিশ্ব জি ডি পি বৃদ্ধির এক উচ্চাশা পোষণ করে। বলা হয়, ২০১৬ সালের জিডিপি ৩.২ শতাংশ থেকে ২০১৭ সালে ৩.৬ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৩.৭ শতাংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে তা ৩.৮ শতাংশে উন্নীত হবে। কার্যত: তা হয়নি। আর যদি তা অর্জিত হয়ও, তাও তা ২০০০ সালের ৪ শতাংশ জিডিপির চেয়ে কম।
(৩) বৈশ্বিক বেকারত্ব:
আই এম এফ দাবী করে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ২০১০ সালে বেকারত্বের হার ছিল ৮.৩ শতাংশ তা কমে ২০১৭ সালে হয়েছে ৫.৭ শতাংশ। কিন্তু, প্রকৃত চেহারাটি তা নয়। বেকারত্বের হারের তথাকথিত হ্রাস শ্রমজীবি মানুষের জীবনযাত্রার মানের কোন সঠিক প্রতিফলন নয়। শ্রমজীবি মানুষের ২০১৬ সালের মজুরি বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি ছিল ১.৮ শতাংশ, ২০১৭ সালে তা ২.৩ শতাংশ দাবী করা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে সে বৃদ্ধি ঘটেনি, কারণ প্রকৃত মজুরি হ্রাস পেয়েছে। এমনকি মহামন্দা পূর্ববর্তী (১৯৯৯-২০০৮) দশকে গড় আয় বৃদ্ধি ছিল ৩.৪ শতাংশ, তার থেকেও গড় আয় এখন কম। অধিকন্তু, সংখ্যার বিচারে এই বৃদ্ধি মনে হলেও, প্রকৃতঅর্থে, গুণগত বিচারে এই বৃদ্ধি আসল সত্য নয়। ’শ্রমবাজারের’ নমনীয়তার’ (“labour market flexibility”) নামে ’মজুরি দৃঢ়তা’ বা wage rigidity র মধ্য দিয়ে আসলে বৃদ্ধি পেয়েছে স্বল্প আয়, অস্থায়ী, নৈমিত্তিক আর স্বনিয়োজিত কাজ। আসলে এর মধ্য দিয়ে শ্রমজীবি মানুষের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে, অনিশ্চয়তা বেড়েছে। মুনাফা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থনৈতিক শোষণের তীব্রতা যা পুঁজিবাদের চিরায়ত চরিত্র। এর ফলে, প্রকৃত বিনিয়োগের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে, কর্মসংস্থান হয়েছে বাধাগ্রস্ত।
’কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ ( Artificial Intelligence, AI) এবং রোবোটিক্স স্থান করে নিচ্ছে শ্রমের অনেক ক্ষেত্র। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের সংগে সংগে শ্রমজীবি মানুষের আন্দোলনে নতুন দিশা, শ্লোগান, কাজের ধরণ এবং সাংগঠনিক উদ্যোগ জরুরী হয়ে পড়েছে।
নয়া উদারনীতিবাদের কর্মনীতির নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক পুঁজি ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি বিপুল ’তারল্য’ অর্জন করেছে, কিন্তু দেশীয় বাজারে চাহিদার সংকটে এই পুঁজির বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। Financial Times এর রিপোর্ট মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ, ইউরোপীয়ান কেন্দ্রিয় ব্যাংক, ব্যাংক অব জাপান, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এবং সুইস ও সুইডিশ ব্যাংকে প্রায় ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ রয়েছে। এর ফলে, সম্পদ মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়েছে, সাধারণ মুদ্রাস্ফীতির হার কমেছে। এই অবস্থায় পুনরায় যদি কোন ’বুদবুদ বিষ্ফোরণ’ হবার ঘটনা ঘটে, পুনরায় তাহলে অর্থনৈতিক মন্দা অনিবার্য। সার্বিকভাবে, আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজি আজ এমন এক বিচিত্র অবস্থায় মুখোমুখি, যা পুনরায় আর এক দফা অর্থনৈতিক সংকট তৈরী করতে পারে।
(৪) বৈষম্যের বিস্তৃতি:
বিগত কয়েক বছরে নয়া উদারনীতিবাদের প্রভাবে বৈশ্বিকভাবে এবং বিভিন্ন দেশভিত্তিতে এ বৈষম্য বেড়েছে লাগামহীনভাবে। ধনী ধনী হয়েছে, গরীব হয়েছে আরও গরীব। এর মাত্রা বাড়ছে। ২০১৭ সালের ÕCredit Suisse’ মোতাবেক পৃথিবীর জনসংখ্যার ২.৭ শতাংশ, বৈশ্বিক উপার্জনের ৭০.১ শতাংশের মালিক। অন্যদিকে, পৃথিবীর ৮৫.৬ শতাংশ মানুষ বৈশ্বিক উপার্জনের মাত্র ৮.৬ শতাংশের অংশীদার। World Inequality Lab (WIL) এর ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুসারে, ১৯৮০ সাল থেকে বিশ্বের ১ শতাংশ উপার্জনকারী জনগোষ্ঠী, নীচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের উপার্জনের দ্বিগুন উপার্জনের মালিক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জরীপের ফলাফলে দেখা যায় – বৈষম্য বৃদ্ধির হার উপরতলার ১০ শতাংশ লোকের মধ্যে সর্বাধিক। সর্বশেষ জরীপ অনুসারে, বাংলাদেশের বৈষম্য বৃদ্ধির হার পৃথিবীর বহু দেশের চাইতে অনেক দ্রুত।
(৫) বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ:
এটা সর্বজনবিদিত যে, বৈশ্বিক সংকটের এই প্রেক্ষিতে, পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দুর্দশা বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমজীবি মানুষের উপর নিপীড়নের খড়গ নেমে এসেছে বেশী মাত্রায়। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অধিকার, কৃষকের ন্যায্য পাওনার অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার সবক্ষেত্রেই নির্যাতন বৃদ্ধি ও অধিকার সংকুচিত হওয়ায় উন্নত দেশসহ উন্নয়নশীল বহু দেশেই অবহেলিত ভুক্তভুগী জনগণ বিক্ষোভ, প্রতিবাদে রাস্তায় নামছে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি, গ্রীসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সমস্যার ভিত্তিতে, পুঁজিবাদের সার্বিক সংকটের বিরুদ্ধে সম্প্রতি রাস্তায় তীব্র বিক্ষোভ, সমাবেশ হয়েছে। তবে, এ সকল আন্দোলন সংগ্রাম ছিল প্রধানত: রক্ষণাত্মক, সেগুলো সীমিত ছিল নির্দিষ্ট দাবীদাওয়া, সংকটকে ঘিরে। রাজনৈতিক চেতনার অভাব তাতে ছিল বা আছে। কিন্তু, এটাও সত্য, এসব আন্দোলনই আসলে পুঁজিবাদের সার্বিক সংকটের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তি এবং তাকে তাই এই লক্ষ্যে এই সংগ্রাম আরও দৃঢ়তর করাই ভবিষ্যতের কর্মপন্থা হতে হবে।
(৬) বিশ্বব্যাপী দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিপদ:
পৃথিবীব্যাপী দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থানের বিপদ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে বিগত কয়েক দশক ধরে। পৃথিবীর দেশে দেশে এই উত্থানের বিপদ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে । বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ নয়া উদারনৈতিক নীতির আগ্রাসনের সংগে মিলিয়ে বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে, স্থানীয় ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে নানা ধরণের বিভেদ আর বৈরীতা সৃষ্টির এক লাগামহীন প্রয়াস চালিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত সব দেশেই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে, প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে বর্ণবাদ, বিদেশাতংক (Xenophobia), অতি দক্ষিণপন্থী নিও ফ্যাসিস্ট প্রবণতার। ভারতে মোদির নেতৃত্বে বিজেপির মত চরম দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানের শংকা ও বিপদের কথা আগেই বলা হয়েছিল। বাস্তবে তা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়, বৃটেনে ব্রেক্সিট ভোটের দিকে দক্ষিণপন্থী শক্তির সমাবেশ, ফ্রান্সের নির্বাচনে অতি দক্ষিণপন্থী মেরিন লে পেন (Marine Le Pen) এর শক্তিবৃদ্ধি, জার্মানীর বিকল্প ডয়েৎসল্যান্ড (Alternative to Deutschland) এর ঊদ্ভব, অষ্ট্রিয়ায় নতুন দক্ষিণপন্থী সরকারের ক্ষমতায় আসা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে এক তৃতীয়াংশ দক্ষিণপন্থী সদস্যের অন্তর্ভূক্তি এই দক্ষিণপন্থ’ার দিকে ঝুঁকে পড়ার দৃষ্টান্ত। এ ছাড়াও এশিয়া ও আফ্রিকার দেশে দেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির উদ্ভব, জংগীবাদের বিস্তার-দক্ষিণ পন্থার বিকাশের সাক্ষী বহণ করে।
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকট বিস্তৃত হবার সংগে সংগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের জন্ম হচ্ছে, প্রশ্ন হচ্ছে, কারা জনগণের এই ক্ষোভকে কাজে লাগাতে পারবে। এটা দৃশ্যমান যে, দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি একে কাজে লাগিয়ে, সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। বাম প্রগতিশীল শক্তি অনেকক্ষেত্রেই প্রধান রাজনৈতিক বিকল্প শক্তি হিসেবে এগিয়ে আসতে পারেনি। দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি এই সংকটের বিপরীতে আরও দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রস্তাবকে সামনে নিয়ে আসছে যা শেষ বিশ্লেষণে জনগণের সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। তাই আজ বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী সংকটের বিপরীতে বাম প্রগতিশীল শক্তি কার্যকর বিকল্প হবে, নাকি দক্ষিণপন্থী শক্তি সে শূন্যতা পূরণ করে সভ্যতাকে আরও পিছনের দিকে ঠেলে দেবে, সে লড়াই চলছে এবং চলবে। ঐতিহাসিকভাবে এটা সর্বজনবিদিত যে, ১৯২৯-১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় বিশ্বএকচেটিয়া পুঁজিবাদের সমর্থনেই গড়ে উঠেছিল ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদী শক্তি জনগণের সংকটকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমান বিশ্বেও পুঁজিবাদের এই সংকট ও জনগণের ধূমায়িত ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি ও নয়া ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হওয়ার লক্ষণ ফুটে উঠছে। এ বিপদকে ছোট করে দেখা যায় না।
(৭) বিশ্বব্যাপী বামপন্থী শক্তির বিকাশ:
দক্ষিণপন্থার এই বিপদের মধ্যেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাম প্রগতিশীল শক্তি ও শ্রমজীবি সর্বহারা মানুষের লড়াই অব্যাহত রয়েছে। এ সময়কালে, ইউরোপে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক শক্তির ধারা ক্ষীণ ও দুর্বলতর হয়েছে। গ্রীসের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (Panhellenic Socialist Movement (PASOK) , ফ্রান্সের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পাটি, ইতালির সোশ্যালিষ্ট পার্টি, জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ স্ক্যানডানেভিয়ান বিভিন্ন দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলো নির্বাচনে খারাপ করেছে এবং দুর্বলতর হচ্ছে। কারণ তারা নয়া উদারনীতিবাদকে সমর্থন করে শ্রমজীবি জনগণের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়েছিল। ক্ষমতার বাইরে থাকাকালীন সময়ে তারা জনগণকে নিজেদের দিকে টানতে পারলেও ক্ষমতায় গিয়ে নয়াউদারীবাদী নীতির মুখাপেক্ষী হয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এর বিপরীতে, পর্তুগাল কমিউনিস্ট পার্টি (PCP, Partido Comunista Português,) ও গ্রীস কমিউনিস্ট পার্টি ( KKE, Kommounistikó Kómma Elládas ) বিকাশমান শক্তি হিসেবে সামনে এগিয়ে এসেছে এবং নির্বাচনেও ভালো ফল করেছে। সাইপ্রাসে কমিউনিস্ট পার্টি (AKEL) স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভালো ফল করেছে। এ ছাড়াও গ্রীসে সাইরিজা ( SYRIZA, Coalition of the Radical Left) (AKKEL, Agricultural Party of Greece) , স্পেনে প্রগতিশীল ( PODEMOS, “We can”) নয়া বামপন্থী দল হিসেবে এগিয়ে এসেছে যা বামধারার রাজনীতিতে শক্তি যুগিয়েছে। বৃটেনে জেরেমি করবিনের (Jeremy Corbyn) এর নেতৃত্বে লেবার পার্টি নির্বাচনে মধ্যপন্থার শক্তি বৃদ্ধি করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে বার্নি স্যান্ডার্স শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে সমর্থন ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ্এ সকল অগ্রগতি প্রমান করে বাম ও বামঘেঁষা শক্তি দৃঢ়তার সংগে নয়া উদারনৈতিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে দাঁড়ালে এই শক্তি কার্যকরভাবে জনগণের মধ্যে স্থায়ী অবস্থান ও সংগঠন তৈরী করতে সক্ষম। যাতে জনগণের ক্ষোভ সঠিকভাবে পুঁজিবাদী সংকটের বিপক্ষে পরিচালিত হতে পারে, যা দক্ষিণপন্থার বিপদকেও রুখে দাঁড়াতে পারে।
(৮) বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন:
বৈশ্বিক পুঁজিবাদের এই সংকটের পটভূমিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বেড়ে উঠেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যক্ষভাবে অথবা ন্যাটোর আড়ালে মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর দেশে দেশে তার সামরিক অনুপ্রবেশ ও আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে । মার্কিন-ইসরাইল যৌথ অশুভ ঐক্য মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র সংকটের জন্য দায়ী। ন্যাটো প্রথমবারের মত বাল্টিক দেশসমূহ ও পোল্যান্ডে তার সৈন্য সমাবেশ করেছে। এর মূল লক্ষ্য রাশিয়াকে ঘেরাও ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির উপর তার আধিপত্য অব্যাহত রাখা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় তার রণনৈতিক লক্ষ্য নিয়েই ’চীন ঘেরাও’ নীতি অবলম্বন করেছে। মার্কিন আধিপত্যের ’একমেরু বিশ্ব’ যাতে কোনমতেই ’দ্বিমেরু বা বহুমেরু’ বিশ্বে পরিণত হতে না পারে, তারজন্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ মরিয়া।
আগেই বলা হয়েছে, নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়, আসলে মার্কিন পুঁজির সবচাইতে রক্ষণশীল, দক্ষিণপন্থী অংশের প্রতিনিধিত্বের বিজয়। জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে দক্ষিণপন্থী শক্তি ক্ষমতায় আসে-এটা তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নির্বাচনের পূর্ব থেকেই ট্রাম্প একের পর এক জাত্যাভিমান, বৃহৎ পুঁজির নির্লজ্জ স্বার্থরক্ষা, বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার বিষয়গুলোকে রাখ ঢাক না রেখেই প্রচার করেছে। লাতিন ও এশিয় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য রেখেছে। আর জয়ী হবার পর, সে তার সকল রণনৈতিক ও কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছে নয়াউদারবাদী সা¤্রাজ্যবাদের স¦ার্থ সর্বাংশে রক্ষা করার ঘোষণা দিয়ে । ইরান, প্যালেস্টাইন, কিউবা, আফগানিস্তানসহ বহু বিষয়ে পূর্বে গৃহীত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে ট্রাম্প সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাব গ্রহণ করে গোটা কোরিয় পেনিনসুলায় যুদ্ধাবস্থা তৈরীর পদক্ষেপ নিয়েছে। উত্তর কোরিয়াকে ধ্বংস করে দেবার ঘোষণা দিয়েছিল।ভেনিজুয়েলার আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলার নাটক করছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ও সৌদি আরব তার সকল অপকৌশলের আর উত্তেজনা-সংঘাত সৃষ্টির অশুভ মিত্র।
(৯) সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি ও যুদ্ধাবস্থার বিপদ:
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলার কৌশল হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি করছে তাদের সামরিক ব্যয়। বিশ্বব্যাপী সমরাস্ত্র বিক্রির প্রতিযোগিতাকে বিস্তৃত করা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার জিডিপির ৩.৫৮ শতাংশ ব্যয় করছে সামরিক খাতে, যেখানে বিশ্বের গড় সামরিক ব্যয় ২.৩ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে তার বাজেটে ৭০০ বিলিয়ান ডলার বরাদ্দ করেছে সামরিকখাতে। ন্যাটোর সমগ্র ব্যয়ের ৭০ শতাংশ বহন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একা। ২০১৪ সালে ন্যাটোর ব্যয় বৃদ্ধি পায় ১.৪ শতাংশ, ২০১৫ সালে ১.৮ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪.৩ শতাংশে। বিশাল এই সামরিক ব্যয়ের মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার বিশ্ব আধিপত্যকে অব্যাহত রাখছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ লাতিন আমেরিকা, ইরানসহ পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় তার সামরিক আধিপত্য অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার রণনৈতিক লক্ষ্য কেন্দ্রিভূত করেছে। তার প্রশান্ত সাগরীয় অঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ নৌশক্তি এখন দক্ষিণ চীন সাগরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বিরোধের সুযোগে আঞ্চলিক অনুপ্রবেশের পাঁয়তারা খুঁজছে। তার এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ‘চীন ঘেরাও’ নীতি, যা শেষ বিশ্লেষণে বৈশ্বিক আধিপত্য রক্ষার অংশবিশেষ। ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধংদেহী নীতিকে কার্যকর করতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের যে কোন অংশে যুদ্ধাবস্থা তৈরীতে তৎপর যা গোটা বিশ্বকে যুদ্ধাবস্থার বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
(১০) লাতিন আমেরিকা:
লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার নয়া উদারনৈতিক নীতি অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর। বিষয়টির কিছুটা সবিশেষ বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। লাতিন আমেরিকার জনগণ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ক্রমবর্ধমান সংঘাতের প্রেক্ষিতে সে এলাকায় মার্কিনের রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপের পথ তৈরি করা হচ্ছে। বহু দশক ধরে কিউবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু। ট্রাম্প এটাকে বাড়িয়ে তুলছে। বারাক ওবামার গৃহীত সাময়িক শান্তি ও সমঝোতার পদক্ষেপকে উল্টে দিয়ে ট্রাম্প কিউবার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমনে নেমেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, চিলি সর্বত্রই দক্ষিণপন্থী শক্তিকে প্রকাশ্যে মদদ দিয়ে ক্ষমতায় আনছে অথবা আনতে চেষ্টা করছে। গোটা লাতিন আমেরিকা জুড়ে সাম্রাজ্যবাদ ও তার নয়া-উদারনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে যে বাম-প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ হয়েছে তাকে নস্যাৎ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে উঠেছে, যাতে এই মহাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তারা তার আধিপত্য ফিরে পায় এবং অব্যাহত রাখতে পারে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্ররা তাদের বহুজাতিক কোম্পানিগুলির স্বার্থরক্ষার জন্য নির্লজ্জ ও নগ্নভাবে রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে। আর্জেন্টিনায় দক্ষিণপন্থী নিও লিবারেলপন্থী মরিস ম্যাকরি ( Maurice Macri) কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে তারা সফল হয়েছে। তেমনিভাবে, সাংবিধানিক ক্যু এর মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট দিলমা রৌসফ (Dilma Rousseff) কে সরিয়ে চরম ডানপন্থী জায়ার বোলসোনারো ( Jair Bolsonaro) কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়েছে। ব্রাজিলের সাবেক জনপ্রিয় নেতা ও প্রেসিডেন্ট লুলাকে সাজানো দুর্নীতি মামলায় সাজা ও কারাদন্ড দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে ডানপন্থীদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। ভেনিজুয়েলায় মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সে দেশের জনগণ, সেনাবাহিনী ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীন, রাশিয়া, কিউবা, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, ইরান, তুরস্ক ভেনিজুয়েলার জনগণ ও প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে দৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। ফলে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। কিন্তু, এ ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। অথচ হন্ডুরাসে ২০১৭ সালে, ২৬ নভেম্বর সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রকাশ্য কারচুপির মধ্য দিয়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হার্নান্দেজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন ও সকল সহযোগিতা করে যাচ্ছে। নির্বাচনে কারচুপির বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষেভের মুখেও হার্নান্দেজ মার্কিন সহায়তায় ক্ষমতায় টিকে আছে। সেখানে ২০০৯ সালে, সে দেশের বৃহৎ খনি মালিক ও মিষ্টির দোকানের বহুজাতিক কোম্পানিগুলির স্বার্থে ক্যুদেতার প্ররোচনা দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হন্ডুরাস ও মধ্য আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মার্কিন হস্তক্ষেপের ইতিহাস দীর্ঘ। নিকারাগুয়ায় ড্যানিয়েল ওর্তেগা পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিকারাগুয়াসহ বলিভয়া, ইকুয়েডর, চিলি সর্বত্র তাদের নগ্ন অনুপ্রবেশ, হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে।
(১১) পশ্চিম এশিয়া:
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার ও ইসরাইলের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্যে পশ্চিম এশিয়ায় ইরানকে কোনঠাসা করার লক্ষ্যে মার্কিন-ইসরাইল-সৌদি অশুভ আঁতাত সর্বক্ষণ তৎপর।
ট্রাম্প কর্তৃক জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দান ও সেখানে দূতাবাস স্থানান্তরের পিছনে রয়েছে প্যালেস্টাইন ভূ-খন্ডে ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরাইলের বেআইনী দখলদারিত্বকে সমর্থন ও জাতিসংঘের প্রস্তাব ও আন্তর্জাতিক মহলের প্যালেস্টাইনের প্রতি ন্যায্য সমর্থনকে অগ্রাহ্য করা। স্বাধীন প্যালেষ্টাইন রাষ্ট্র ও পূর্ব-জেরুজালেম তার রাজধানী-এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত্ কিন্তু মার্কিন-ইসরাইল অশুভ অক্ষ একে উপেক্ষা করে তাদের আধিপত্য অব্যাহত রাখছে। ইসরাইল ও প্যালেষ্টাইনের মধ্যকার সকল শান্তি আলোচনা ভেংগে দেবার পিছনে এই হাত কাজ করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই এলাকায় নতুন করে সংঘাত, যুদ্ধ ও অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও মার্কিন হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এটা আজ সর্বজনবিদিত যে, মার্কিন মদদেই সিরিয়ার আসাদ সরকারকে অপসারণের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল যা দীর্ঘ ৬ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর ব্যর্থ হয়েছে। সিরিয়ার সরকারি বাহিনী জয়ী হয়েছে। কিন্তু, সে অঞ্চলের নতুন ক্ষমতাবিন্যাসের তৎপরতা ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে । সকল ধরণের হস্তক্ষেপ সত্বেও এ অঞ্চলে ইরান তার অবস্থান সংহত করেছে। ইরানের অভ্যন্তরে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে যে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়, তাতে বাইরে থেকে মার্কিন মদদে সৌদি আরবের হাত আছে। তা সত্বেও এটা ঠিক আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে, দেশের অর্থনীতির সংকট, দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। এ এলাকার সকল প্রগতিশীল মানুষ মনে করে, শান্তি, প্রগতি ও সামাজিক ন্যায়বিচার হতে পারে ইরানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং বহি:শক্তির বিরুদ্ধে সত্যিকারের নিশ্চয়তা। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম দোসর সৌদি আরবকে দিয়ে ইরানকে দূর্বল করার অব্যাহত প্রয়াস, সৌদি আরবকে ইয়েমেনের আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপে উৎসাহিত করেছে। এর ফলে, ইয়েমেন এক দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। সেখানে শিশু, নারীসহ অসংখ্য সাধারণ আজ মৃত্যু আর দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। মানবাধিকার লংঘন সেখানে আজ এক নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । মানবাধিকার লংঘনের এই সুস্পষ্ট ঘটনা ঘটছে, অথচ সে ব্যাপারে তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার কোন মাথাব্যথা নেই।
ইতিমধ্যে সৌদি আরবের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সৌদি যুবরাজ প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় আসার সংগে সংগে কাতার, সিরিয়া, ইয়েমেনে সৌদি হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি হতে থাকে। এর সংগে সংগে লেবাননের উপর চলে নতুন করে চাপ প্রয়োগ। হিজবুল্লাহকে দূর্বল করাও এই প্রক্রিয়ার অন্যতম লক্ষ্য।
সম্প্রতি তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে সৌদি সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী জামাল খাসোগী হত্যা পৃথিবীব্যাপী চাঞ্চল্য তৈরী করে। এই ঘটনায় সৌদি যুবরাজের সম্পৃক্ততার প্রমান সৌদি সরকার, এমনকি, খোদ মার্কিন সরকারকে আন্তর্জাতিক চাপ ও সমালোচনার মুখে ফেলে দেয়। এ সকল উদ্যোগই আসলে এ অঞ্চলে মার্কিন-ইসরাইল-সৌদির অশুভ রণনৈতিক পদক্ষেপের অংশ বিশেষ। এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক বিরোধের অন্তরালে রয়েছে শিয়া-সুন্নি বিরোধেরও চক্রান্ত।
কাতার আমিরাতকে অবরোধের আওতায় রেখে আঞ্চলিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার সৌদি প্রয়াস প্রাথমিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পায়। এটা সবারই জানা কাতার ও ইরান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র ’সাউথ পারস’ ( South Pars) এর যৌথ মালিকানা বহন করে। উভয়েরই হাইড্রোকার্বন সেক্টরে সহযোগিতা প্রয়োজন। সৌদি আরব ও ইউনাইটেড আরব আমিরাত চায় কাতারের সরকার পরিবর্তন। এ সকল আঞ্চলিক বিরোধের অন্তর্নিহিত কারণ হলো এ অঞ্চলে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের উপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্রদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা।
(১২) আফ্রিকা:
ধর্মীয় উগ্রবাদ উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রন করছে সন্দেহ নেই। লিবিয়ার উপর সাম্রাজ্যবাদী আক্রমন ও গাদ্দাফীর পতনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে এক ভয়াবহ অরাজকতা আর অস্থিতিশীলতা তৈরী হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ আর জংগীবাদকে মোকাবিলা করার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র AFRICOM এর মাধ্যমে তার সামরিক উপস্থিতি শক্তিশালী করেছে। মর্কিন সৈন্যরা সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রক্রিয়ায় নাইজিরিয়া, মালি, সাহেল প্রভৃতি দেশে ব্যাপক হত্যাকান্ড চালাচ্ছে, যা এ অঞ্চলে উগ্র সন্ত্রাসবাদকেই সে এলাকার জনগণের মধ্যে দৃঢ় অবস্থান তৈরীতে সহায়তা করছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এ সকল দেশের আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের উপর, গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক পথ এবং বাজারের উপর নিয়ন্ত্রন করতে চায়। এ অঞ্চলে চীনের যে কোন প্রভাবকে মোকাবিলা করতে চায়।
(১৩) আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দসমূহ:
সমাজতান্ত্রিক বলয় এখন অপেক্ষাকৃত দূর্বল, তাই সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদের দ্বন্দ অপ্রধান, ফলে পুঁজিবাদের দীর্ঘমেয়াদী সংকট এবং সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নতুন আগ্রাসী নীতি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ঐক্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির নেতৃত্বে বিশ্বায়নের মধ্যে দিয়ে বিগত দশকগুলোতে আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ প্রকাশ পায়নি বা সুপ্ত ছিল, তা এখন স্পষ্টত:ই প্রকাশিত হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে, ব্রেক্সিট (BREXIT) ভোট এর একটা উদাহরণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প গৃহীত বিভিন্ন নীতির সংগে অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশ যেমন জাপান, ফ্রান্স, জার্মানীসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংগে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ আজ প্রকাশ্যেই চলে এসেছে। আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজি নিয়ন্ত্রিত Trans-Pacific Partnership Agreement (TPPA) এ জাপানের স্বার্থ বিঘিœত হয়েছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ন্যাটোতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বন্ধু মিত্রদের আরও বেশী আর্থিক সংস্থানের দাবী করলে স্বাভাবিকভাবেই তা মতবিরোধের ঘটনা ঘটিয়েছে। সম্প্রতি ইরানের সংগে অনুষ্ঠিত ৬ দেশীয় পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রন চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এককভাবে বেড়িয়ে আসাটা যুক্তরাষ্ট্রের সংগে অন্যান্য স্বাক্ষরকারী দেশ জার্মানী, ফ্রান্স, রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মতবিরোধ বৃদ্ধি করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ তার ইউরোপীয় মিত্ররা সমর্থন করেনি। বিশ্ব ফিনান্স পুঁজির আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যে সর্বোচ্চ মুনাফা লাভের আশায় জনগণকে শোষণের ক্ষেত্রে ঐক্য থাকতে পারে, কিন্তু, নিজেদের আন্ত:দেশীয় পুঁজির স্বার্থে দ্বন্দ বেড়িয়ে আসছে।
(১৪) জলবায়ু পরিবর্তন:
বিশ্ব পুঁজিবাদের মুনাফার লোভে নিয়ন্ত্রনহীন শিল্পায়ন বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও ভূ-পরিবেশের জন্য চরম হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে, এটা আজ বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। গোটা পৃথিবী ও সভ্যতাই আজ বিপন্ন। বিজ্ঞান আর বিবেক বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ করছে এক দাবীতে তাহলো, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে রোধ করতে হবে। এই লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর, প্যারিসে ’গ্রীন হাউস গ্যাস’ নি:সরণ সীমিত করার যুগান্তকারী মতৈক্যে পৌঁছায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। প্যারিস চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ রোধে এই শতাব্দিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা, এবং এটাকে আরও কমিয়ে ১.৫ ডিগ্রিতে নিয়ে আসার প্রয়াস অব্যাহত রাখা। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তিকে তাদের নিজেদের ইচ্ছামাফিক ব্যবহার করতে চায়। কার্বন নি:সরণে উন্নত দেশগুলিই যে সবচেয়ে বেশী দায়ী এবং এক্ষেত্রে তাদেরকেই যে বেশী দায়িত্ব নিতে হবে, এ দায় তারা নিতে চায় না। অপেক্ষাকৃত কম কার্বন নি:সরণের প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ও প্রযুক্তি সহায়তার দায়ও তারা নিতে চায় না। ঐতিহাসিকভাবে বিশ্ব উষ্ণায়নে ও ভূ-পরিবেশ ধ্বংসে তাদের যে দায় রয়েছে, সে ব্যাপারে তারা উদাসীন। এর পূর্ববর্তী কিয়োটো প্রটোকলের ব্যাপারেও মার্কিন যুক্তরাস্ট্র একই মনোভাব পোষণ করেছিল। বিশ্ব-পুঁজিবাদের মুনাফার স্বার্থে প্রকৃতি ও পরিবেশকে ধ্বংস করার বিরুদ্ধে সংগ্রাম গোটা বিশ্ববাসীর । উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির বিশ্ব উষ্ণায়ন ও ভূ-পরিবেশ ধ্বংসের যে কোন প্রয়াসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সংগ্রামের আমরা অংশীদার।
(১৫) বহুমেরু বিশ্ব:
পুঁজিবাদের বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে, একমেরু বিশ্ব ক্রমাগত বহুমেরু বিশ্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু এই প্রবণতার নানামুখী সংকটও ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় ANC-COSATU-SACP (the African National Congress (ANC), the Congress of South African Trade Unions (COSATU) and the South African Communist Party (SACP) ) ঐক্যের জনপ্রিয়তা হ্রাস এবং ব্রাজিলে দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতায় আসায় BRICS এর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তবুও BRICS সাংহাইতে ’নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেছে। BRICS এর সদস্য দেশগুলির এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এর প্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে কতটা সফলতার সংগে প্রতিযোগিতা করতে পারবে, সেটা একটা চ্যালেঞ্জ।
’সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’ (SCO) তার আঞ্চলিক ফোরাম সংহত করতে পেরেছে। ভারত ও পাকিস্তান এর সদস্যপদ পেয়েছে। বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক হিসেবে আবেদন করেছে। চীন ৬০ সদস্যের একটি ’এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার এন্ড ইনভেষ্টমেন্ট ব্যাংক’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ’একমেরু বিশ্বে’র বৈশ্বিক আধিপত্যের বিপরীতে এ সকল গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামগুলি নি:সন্দেহে একমেরু আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংহতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এ সকল আঞ্চলিক ফোরামগুলিতে ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভারতের বর্তমানের মার্কিন ঘেঁষা বৈদেশিক নীতির প্রবণতা নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরী করবে সন্দেহ নেই। চীনের ’এক বেল্ট, এক রাস্তা’ (One Belt, One Road) প্রকল্পের উদ্যোগ ভারত সমর্থন করেনি। যদিও বাংলাদেশের মনোভাব ইতিবাচক। এই প্রকল্প প্রাচীনকালের ’সিল্ক রোড’ ও ’সামুদ্রিক বাণিজ্যের’ ঐতিহ্যকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
(১৬) বিশ্ব বানিজ্য সংস্থা ( World Trade Organization, WTO)
বিশ্ব-বানিজ্য সংস্থার সদস্য সংখ্যা ১৬২ (৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫)। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ যাতে বৈশ্বিক বাণিজ্যে কিছু সমতা পেতে পারে এবং উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর অর্থনৈতিক চাপে বাণিজ্য বৈষম্য না তৈরী হয়, তার জন্য কিছু বিধান বিশ্ব-বাণিজ্য সংস্থা (WTO ) এর নীতিমালায় বিধিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু, (WTO ) আর এখন বিশ্ব-বাণিজ্য রীতি পালনের মৌলিক ফোরাম নয়। নিজেদের অর্থনৈতিক ও মুনাফাভিত্তিক স্বার্থে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি বিভিন্ন দেশের বা আঞ্চলিক সহযোগিতা তৈরী করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নত মিত্রদেশগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলি কর্তৃক বিশ্ব ফোরামে উত্থাপিত সকল প্রতিরোধকে উপেক্ষা করতে পারে তাদের দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক চুক্তির বদৌলতে।
২০১৭ সালের শেষে বিশ্ব-বাণিজ্য সংস্থার (WTO ) বুয়েনস আয়ার্স বৈঠকে উন্নত দেশগুলি ই-কমার্স নামে বাণিজ্য উদারিকরণের প্রস্তাব উত্থাপন করে। তারা দাবী করে ই-কমার্স যে কোন দেশীয় ট্যাক্স মওকুফ পাবে। ডঞঙ র গৃহীত এই নীতিমালার ফলে উন্নয়নশীল দেশ ও অনুন্নত দেশগুলোকে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। (WTO ) একটি বিশ্ব-ফোরাম হলেও, উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো তাকে প্রতিনিয়ত তাদের নিয়ন্ত্রনে ব্যবহার করছে।
(১৭) সমাজতন্ত্র লক্ষ্যাভিমুখী দেশসমূহ:
চীনঃ
বিগত প্রায় এক দশক ধরে চীন তার গড় প্রবৃদ্ধির হার ৭.২ শতাংশ অব্যাহত রেখেছে এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর অর্থনীতিক প্রবৃদ্ধির প্রায় ৩০ শতাংশে চীন অবদান রাখে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক সংকটের অভিঘাত চীনকেও প্রভাবিত করে এবং তাকে মোকাবিলা করার জন্যে চীন তার আভ্যন্তরীন চাহিদা এবং ভোগ তৈরীর উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগ অনেকটা সফল হয়। চীন শ্রমজীবি মানুষের ন্যূনতম মজুরি অব্যাহত ও পরিকল্পিতভাবে বৃদ্ধি করেছে। প্রায় ৬০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র সীমার উপরে তুলে এনেছে। প্রতিনিয়ত কর্মসংস্থান বৃদ্ধির নীতিমালা প্রহণের মধ্য দিয়ে গড়ে প্রতি বছর ১৩ মিলিয়ন শহুরে কাজের ধারাবাহিক সুযোগ তৈরী করেছে।
চীনের ১৯ তম পার্টি কংগ্রেসে চীনা পাার্টি তাদের দেশে ’চীনা বৈশিষ্ট্যের সমাজতন্ত্র ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। চীনা পার্টির নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শি জিন পিং ( Xi Jinping) চীনের সমাজতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন এবং এ নতুন যুগকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা যুগ হিসেবে অভিহিত করেছেন। চীনা পার্টি কংগ্রেস সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৈষম্যপূর্ণ ও সীমিত উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা দূর করার কৌশল গ্রহণ করেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দুর্নীতির নেতিবাচক দিকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রামের আহ্বান দেওয়া হয়েছে।
ভিয়েতনামঃ
ভিয়েতনাম দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ হিসেবে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এ সময়কালে তাদের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৩ শতাংশ। তবুও পার্টির গৃহীত লক্ষ্যমাত্রা তারা পূরণ করতে পারেনি। বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকট ও মন্দার ফলে ২০২০ সালের মধ্যে একটি আধুনিক শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি ( CPV ) এর ১২তম কংগ্রেসে ’নবায়ন নীতি’ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও হো চি মিনের চিন্তাধারাকে সমন্বিত করে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়াই ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
কিউবাঃ
কিউবা দশকের পর দশক ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অন্যায্য ও অমানবিক সকল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যকে সমুন্নত রেখেছে। কিউবা অব্যাহতভাবে লাতিন আমেরিকার দেশগুলির সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া-উদারনীতিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত সকল বামপন্থী, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির সার্বিক বিকাশে সর্বতোভাবে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য থেকে কিউবার পার্টি বিচ্যুত হয়নি। কিউবার পার্টি ও রাষ্ট্র অত্যন্ত সফলভাবে নতুন প্রজন্মের হাতে নেতৃত্ব হস্তান্তর করেছে। প্রথমে ফিদেল কাস্ত্রো থেকে রাউল কাস্ত্রো, তারপর মিগুয়্যাল দিয়েজ স্যানেল । কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির ৭ম কংগ্রেসে দৃঢ়তার সংগে সামাজিক ন্যায্যতা, সমাজতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিউবার সমাজতান্ত্রিক ভাবনার ভিত্তিতে জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার অর্জন ধরে রাখার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
উত্তর কোরিয়া ( ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া)ঃ
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সকল ভীতিপ্রদর্শনকে উপেক্ষা করে ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া তার মিসাইল উন্নয়ন প্রকল্প সফল করার মধ্য দিয়ে পারমাণবিক ওয়ারহেড সজ্জিত দেশে পরিণত হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টি মনে করে, পরমাণু শক্তিধর দেশ হয়েই কেবল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সকল ধরণের অনুপ্রবেশ ও অর্থনৈতিক – সামরিক আক্রমন মোকাবিলা করা সম্ভব। দশকের পর দশক ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দক্ষিণ কোরিয়াকে ব্যবহার করে, এ অঞ্চলে তার সামরিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ ও প্রভাব বজায় রাখতে ছিল বদ্ধপরিকর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় স্কাড পারমাণবিক মিসাইল স্থাপনা তৈরী করেছে। যার মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া এবং চীন উভয়ের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি উভয় কোরিয়ার শীর্ষ নেতৃত্ব দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছে, যা দু’দেশের জনগণের আশা আকাংখার প্রতিফলন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সংগে উত্তর কোরিয়ার শীর্ষনেতা কিম জন উনের দু’দফা বৈঠক হয়েছে। প্রথম বৈঠকে কিছু আশাবাদ তৈরী হলেও, ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত শেষ বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে, এ এলাকার উত্তেজনা অব্যাহত থাকতে পারে।
(১৮) এশিয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলঃ
ওবামা প্রশাসন তার ক্ষমতার শেষের দিকেই ভূ-রাজনৈতিক সামরিক নীতিতে এশিয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় তাদের নয়া নীতি ঘোষণা করে। সুস্পষ্টভাবে ওবামা ও তাদের পররাষ্ট্র দফতর ঘোষণা করে যে- আগামী দশকগুলোতে ভূ-রাজনীতির কেন্দ্র হবে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপস্থিতি ও আধিপত্য বজায় রাখায় অব্যাহত প্রচেষ্টা ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের চরম পরাজয়ের পরও এ এলাকায় মার্কিন উপস্থিতি অব্যাহত রাখার জন্য একদিকে ইন্দোচীন, কোরীয় উপকূল, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে গোটা এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের যাতে কোন হানি না হয় তার প্রচেষ্টা অব্যাহত থেকেছে, অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই নয়াকৌশলের কেন্দ্রবিন্দু যে দক্ষিণ চীন সাগরের বিপুল সম্পদের উপর আধিপত্য ও বর্তমানে গড়ে ওঠা চীনের অর্থনেতিক উত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া তা আজ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চীন ও ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে এ এলাকায় তাদের আধিপত্য হাত ছাড়া হবার আশংকায় ফেলেছে। সাম্প্রতিককালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের কয়েকটি পদক্ষেপ এই এলাকায় যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। তাইওয়ানকে নতুন করে গুরুত্ব দিয়ে, চীনের সংগে বাণিজ্য লড়াই শুরু করে গোটা অঞ্চলকেই উত্তপ্ত করে তোলা হয়েছে। উত্তর কোরিয়াকে কেন্দ্র করে যুদ্ধংদেহী মার্কিন প্রয়াস মূলতঃ উত্তর কোরিয়ার গতিশীল নেতৃত্বের ফলেই এ এলাকাকে চুড়ান্ত যুদ্ধাবস্থায় ঠেলে দিতে পারেনি। চীনের নেতৃত্বও এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। তবে, চীন সমুদ্রে চীনের কৃত্রিম দ্বীপ তৈরীর বিরুদ্ধে অজুহাত তুলে এই এলাকায় ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এমনকি ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ তৈরীর ইন্ধন তৈরী করা হয়েছে। চীন যাতে কোনভাবেই দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব ফেলতে না পারে সেজন্য ভারতীয় শাসক অর্থাৎ মোদী প্রশাসনকে দিয়ে অব্যাহতভাবে চীনের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দিতা তৈরীর উসকানী দিচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়া:
দক্ষিণ এশিয়া এশিয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণনৈতিক অঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত। তাই দক্ষিণ এশিয়া বিশ্ব-পুঁজিবাদের বৈশ্বিক রণনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এ অঞ্চলে অবস্থিত সব দেশগুলির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। এ অঞ্চলে সাম্প্রতিককালে সাম্প্রদায়িক উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান এ এলাকায় প্রগতিশীল রাজনীতির জন্যে অন্যতম প্রধান বাধা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিও এই অভিঘাতের বাইরে নয়। এটাকে খেয়ালে রেখে রাজনৈতিক পর্যালোচনা করতে হবে।
আফগানিস্তান
গত শতাব্দির সত্তরের দশকের শেষ থেকে গত প্রায় চার দশক ধরে আফগানিস্তান বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে খালক নেতা নূর মোহাম্মদ তারাক্বী দাউদ খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশকে ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অব আফগানিস্তান ঘোষণা করেন। ১৯৭৯ সালের, ২৭ ডিসেম্বর, সোভিয়েত সমর্থনে পারচাম নেতা বাবরাক কারমাল ক্ষমতায় আসেন। তিনি খালকদেরও সমর্থন পান। তাঁর সমর্থনে সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য প্রেরণ করলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের আই এস আই এর মাধ্যমে মুজাহিদিনদের অর্থ ও অস্ত্রের যোগান দিতে থাকে। যার ফলশ্রæতিতে এই সংঘর্ষ দীর্ঘ দশকব্যাপী রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। আসলে এ যুদ্ধ বৈশ্বিক দ্বন্দের ভিত্তিতে একটি প্রক্সি যুদ্ধ। হামিদ কারজাইকে অন্তরবর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট করে শুরু হয় আফগানিস্তান গৃহযুদ্ধের আর এক পর্যায়। অদ্যাবধি তা অব্যাহত রয়েছে। আফগানিস্তানের এই গৃহযুদ্ধের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাত দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার উপর পড়েছে। মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে পারছে না আবার তালেবানদেরকে সম্পূর্ণ পড়াজিত করতে পারছে না। আফগানিস্তানের এই অস্থিতিশীলতা দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে পাকিস্তানের রাজনীতিকেও অস্থিতিশীল তুলেছে।
পাকিস্তান
দীর্ঘকাল পাকিস্তানকে রাজনীতির ঘুঁটিতে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের জনগণের কাছেও ধিকৃত। কিন্তু পাকিস্তানে চরম দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের উত্থান আজ পাকিস্তানকেই অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ওবামা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার পর থেকে সেখানকার মৌলবাদী শক্তিকে নিয়ন্ত্রন করা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প সেখানে শক্তিবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। তার ফলে পাকিস্তানে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। পাকিস্তান জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক শক্তির পর্যবেক্ষণে আলোচনার মাধ্যমে আফগান সমস্যার সমাধান চেয়েছে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে নেওয়াজ শরীফ ক্ষমতা থেকে পদত্যাগের পর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট হয়ে ইমরান খানের ক্ষমতায় আসা সে দেশের দক্ষিণপন্থার বিপদ বাড়িয়ে তুলেছে। তার অভিঘাত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও পড়বে। সে দেশের শাসকগোষ্ঠী ভারত বিরোধীতার ট্রাম্প দিয়ে দশকের পর দশক ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। সম্প্রতি কাশ্মীর সীমান্তে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ, ভারতের সেনাদলের উপর আত্মঘাতি হামলায় প্রায় ৪০ জন সৈন্যের মৃত্যুর পর ভারতের বিমান হামলা, একজন বৈমানিকের পাকিস্তানের হাতে ধরা পড়া, তাকে ফেরৎ পাঠানো প্রভৃতি নাটকীয় ঘটনা ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে সন্দেহ নেই।
ভারত
ভারতে আজ সর্বব্যাপী দক্ষিণপন্থী, চরম সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটেছে। এর ফলে, সে দেশের গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শক্তি আজ চরম বিপর্যয়ের মুখে। এই সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গের মতো দীর্ঘকাল স্থায়ী বামপন্থী প্রভাবকে কোনঠাসা করে ফেলেছে। ভারতে ১১ এপ্রিল, ২০১৯ থেকে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, সম্প্রতি কাশ্মীর সীমান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনা, এই লোকসভা নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। বি জে পি-আর এস এস হিন্দুত্ববাদের শ্লোগান তুেলছে। গত ৪ বছরে মোদি সরকারের গৃহীত নীতিমালা শ্রমিক, কৃষক মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল ঠিকই, কিন্তু তা বি জে পি বিরোধী ভোটে রূপান্তরিত হতে পারেনি, বরং বিগত লোকসভা নির্বাচনে (২০১৯) বি জে পির নেতৃত্বে গোটা ভারতে চরম সাম্প্রদায়িক শক্তি ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করেছে। পশ্চিম বাংলা ও আসামসহ গোটা ভারতেই ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক শক্তির এই বিপর্যয় শুধু ভারতের নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য অশনিসংকেত। ভারতের এই নির্বাচনী ফলাফল দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে তথা বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের সংগে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত সংবেদনশীল। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ বাংলাদেশের জনগণকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও ’৭১ মুক্তিবাহিনীর সংগে একসংগে লড়াই করেছে, রক্ত দিয়েছে।ফলে, উভয়দেশের জনগণের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাতিক বন্ধন। কিন্তু, আন্ত:রাষ্ট্রীয় অনেক ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থের মতপার্থক্যও আছে। ফলে, উভয় দেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতিও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। তিস্তার পানি বন্টনসহ আন্ত:দেশীয় নদী সমস্যা, মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিংগা স্মরণার্থী বিষয়ে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের পক্ষে যায় না। এ ছাড়া রয়েছে বাণিজ্য ঘাটতির মত অর্থনৈতিক ইস্যু, সীমান্তে বেআইনী অনুপ্রবেশের ঘটনায় বেসামরিক মানুষ হত্যা প্রভৃতি। ফলে, উভয় দেশের রাজনীতিতেই তাই রয়েছে স্পর্শকাতরতা।
নেপাল
বামপন্থীদের নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নানা রাজনৈতিক অস্থিরতার ও অনিশ্চয়তার পর নেপালে সংবিধান গৃহীত হয়, যার ভিত্তিতে, ২০১৭ সালের নভেম্বরে নির্বাচনে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় যাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে প্রগতিশীল ও বামপন্থীদের জন্য এক ইতিবাচক মাত্রা তৈরি করেছে। উপরন্তু, নেপালের দু’টি প্রধান কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্যের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত শুধু সে দেশের জনগণ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন উদাহরণ স্থাপন তরেছে। তবে, এখানেও ভারতীয় শাসকরা তাদের প্রভাব হারিয়ে নতুন করে তাদের প্রভাব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট রয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা নেপালে তাদের তৎপরতা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে, এমনকি নেপালের আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করছে। নেপালের সংগে চীনের সৌহার্দ্য ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।ফলে, এখানকার কমিউনিষ্টদের সামনে রয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জ।
শ্রীলংকা
২৬ অক্টোবর, ২০১৮ প্রেসিডেন্টের টচঋঅ র সাংসদরা রনিলে বিক্রমসিংহের জাতীয় সরকার ত্যাগ করলে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী রনিলে বিক্রমসিংহকে বরখাস্ত করে পূর্বতন প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। রনিল বিক্রমসিংহে এ নিয়োগ উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে অস্বীকার করেন। কয়েকদিনের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে দেশের সুপ্রীম কোর্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। সুপ্রীম কোর্ট প্রেসিডেন্টের ঘোষণাকে অসাংবিধানিক রায় দেয়। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রাজাপাকসের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট দেয়। ১৬ ডিসেম্বর, বিক্রমসিংহে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন। আপাতত: সংকট নিরসন হয়।
শ্রীলংকার সাম্প্রতিক অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন দীর্ঘ কয়েক দশকের আভ্যন্তরীন রাজনীতির নানা অভিঘাতের ফলশ্রæতি, তেমনি আন্তর্জাতিক শক্তিবলয়েরও স্বার্থের টানাপোড়েনের প্রভাব। এবং তা কখনই এই এলাকার ভূ-রাজনীতির বাইরে নয়।
মালদ্বীপ
মালদ্বীপের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সে দেশের আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক দ্বন্দের যেমন বহি:প্রকাশ তেমনি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন-ভারত সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বন্দেরও বহি:প্রকাশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এই মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হলো মালদ্বীপের ভূ-রণনৈতিক গুরুত্ব এবং সেখানে চীন না ভারত কার প্রভাব বেশী হচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট মুহামেদ সলিহ, পূর্বতন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন চীনের সংগে যে অর্থনৈতিক লেনদেন করেছে, তার পর্যালোচনা করার ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি, ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যকার প্রতিরক্ষা সমঝোতা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সংগে মতবিনিময় করেছে। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, আবদুল্লাহ ইয়ামিনের সময়ে মালদ্বীপের তৎকালীন সরকারের সংগে চীনের যে ঘনিষ্টতা তৈরী হয়েছিল, বর্তমান প্রেসিডেন্ট মোহামেদ সলিহের সময়ে ততটা থাকছে না। ফলে, স্পষ্টত:ই ভারত মহাসাগরীয় এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি ঘিরে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলির প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকবে। ভারতের সংগে ভারতের এই আঞ্চলিক প্রতিযোগিতাকে হাতিয়ার করে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ একে তার এশিয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণনৈতিক কৌশলের সংগে যুক্ত করবে সন্দেহ নেই।
মায়ানমার
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশেষ করে মায়ানমারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা তাদের অবস্থান দৃঢ় করতে সচেষ্ট রয়েছে-কিছুটা সফলও হয়েছে। সূ কি সরকার পশ্চিম ঘেঁষা এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, চীন ও ভারতেরও মায়ানমার অর্থনীতিতে প্রচুর বিনিয়োগ থাকায় মায়ানমারের সংগে তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ট। আভ্যন্তরীন রাজনীতির ক্ষেত্রে, দীর্ঘকাল সামরিক জান্তা বিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এসেও সামরিক সরকারের সংগে আঁতাত করে ক্ষমতায় গিয়ে সু কী সরকার যে কতকগুলো জটিল সমস্যার সম্মুখীন, তাতে বিশ্বব্যাপী তাঁর ভাবমূর্তিকে প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তারমধ্যে মুসলিম রোহিংগা সমস্যা প্রধান। মুসলিম রোহিঙ্গাদের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সংগে সংশ্লিষ্টতা আছে এই দাবীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর মৌলবাদী বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, সংগে সামরিক বাহিনীর অভিযান এর ফলে প্রায় ১০ লক্ষ রোহিংগা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই রোহিঙ্গা অভিবাসী সমস্যা বাংলাদেশের এক স্থায়ী রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম, বিশেষ করে কক্সবাজার অঞ্চলে তাদের অবস্থান স্থায়ী সংকটের সৃষ্টি করেছে। এদের মধ্যে জামাতসহ মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের প্রভাব সর্বজনবিদিত। রোহিঙ্গা সমস্যা মায়ানমারের সংগে দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক সমস্যা। এর ফলে মায়ানমারের সংগে আন্তঃদেশীয় উন্নয়ন ও সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর একটি বিষয় উল্লেখ্য, রোহিংগা প্রশ্ন সমাধানে রাশিয়া, চীন ও ভারতের ভূমিকা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রত্যাশিত নয়।
(১৯) দক্ষিণ এশিয়ায় উগ্র-সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী শক্তির বিপদ:
দীর্ঘদিন থেকে দক্ষিণ-এশিয়ায় উগ্র-সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী শক্তির বিপদ সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। । আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে কয়েক দশক ধরেই উগ্র দক্ষিণপন্থী ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি সে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক মূল্যবোধকেই ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ভারতে পর পর দু’টি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী শক্তির ভূমিধ্বস বিজয়, সে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে। সাম্প্রতিককালে, শ্রীলংকায় গির্জায় প্রাণঘাতি বোমা হামলা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা সে দেশেও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপদকেই নির্দেশ করে। এমনকি, নেপালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বামপন্থীরা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গেলেও দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তি সেখানেও তৎপর। বাংলাদেশে এই বিপদ সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো, যে কোন সুযোগে তা বেড়িয়ে আসবে। ১০ম কংগ্রেস দক্ষিণ-এশিয়ায় উগ্র-সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী শক্তির বিপদ কে এ অঞ্চলের রাজনীতির বিশেষ নির্ধারক হিসেবে চিহ্নিত করছে।
(২০) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্র। তাই, দক্ষিণ এশিয়ার পারিপার্শ্বিক দেশগুলির রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা এশিয়-প্রশান্ত অঞ্চলে তথা দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তৃত করার জন্য বাংলাদেশে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিশেষ করে এখানে চীনের যেকোন অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রভাব তাদের স্বার্থের পরিপন্থী। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সংগে রাশিয়া ও চীনের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে বেপরোয়া করে তুলেছে। ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী তাদের জুনিয়ার পার্টনার সন্দেহ নেই, কিন্তু, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তাদের দ্বন্দ ও ঐক্যের সম্পর্ক। বাংলাদেশের সংগে ভারতের সুসম্পর্ক ভারতের আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত স্বার্থেই প্রয়োজন। চীনের সংগে বাংলাদেশের কোন ঘনিষ্টতা তারা চাইবে না। সেক্ষেত্রে, যুক্তরাষ্ট্রের সংগে তার ঐক্য আছে। কিন্তু, বাংলাদেশের মধ্যে কোন শক্তি পাকিস্তানের সংগে ঘনিষ্ট হবে,তা ভারত চাইবে না। কিন্তু, যেহেতু, ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সংগে ঘনিষ্ট, সেহেতু, এক্ষেত্রে, যুক্তরাষ্ট্রের সংগে ভারতের অনৈক্য। পাকিস্তানও বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিরন্তর ভূমিকা রাখার চেষ্টা রেখে চলে। বাংলাদেশ কার্যতঃ বড় অর্থনৈতিক বাজার, সস্তাশ্রমের উৎস এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকেন্দ্র এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার। বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক সম্পদও অন্যতম আকর্ষণের বিষয়। বাংলাদেশ তাই বহুমাত্রিক আন্তর্জাতিক শক্তির আগ্রহের ক্ষেত্র।
(২১) করোনা প্রাদুর্ভাবের পর বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির নয়াবিন্যাস ও করণীয়
বিশ্বব্যাপী করোনার বিরুদ্ধে মানবজাতির লড়াই যত কঠিন হয়ে উঠছে, বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির বাস্তবতা তার সংগে মিলিয়ে জটিলতর হচ্ছে। করোনা সংক্রমনের শুরু থেকেই করোনাকে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করার প্রয়াস ছিল- এখন নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে তা আরও প্রকট হয়ে উঠছে। এটা শুধু বাকযুদ্ধে সীমাবদ্ধ নেই ‘ঠান্ডা যুদ্ধে’ রূপান্তরিত হচ্ছে।
পৃথিবীর সকল বিজ্ঞানীরা তাঁদের মেধা আর শ্রম সন্নিবিষ্ট করে নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন করোনার ভ্যাকসিন আর অসুধ আবিষ্কারের জন্য। শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষ এগিয়ে আসছেন বিশ্বব্যাপী। কিন্তু, তার বিপরীতে ঘনীভূত হচ্ছে মুনাফালোভী, ক্ষমতালোভী বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের ষড়যন্ত্রমুখী প্রয়াস।
করোনা প্রাদুর্ভাবের পর পৃথিবীর কাছে পুঁজিবাদের অসহায়ত্ব, অমানবিকতা, মুনাফা আর লোভের কাছে মানুষের জীবনের মূল্যহীনতার দৃষ্টিভংগী স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাস্যকর অবিমৃশযকারিতা, অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টভংগী, এই বৈশ্বিক সংকটকে মোকাবিলা করা বা নেতৃত্ব দেবার অপারগতা তাঁর নিজের সমর্থকদের মধ্যেই হতাশার সৃষ্টি করছে। তিনি চীনকে করোনা প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী করার মধ্য দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে শুধু দায়ী নয় অকার্যকর করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। অর্থ সাহায্য বদ্ধ ঘোষণা, বিশ্ব স্বাস্থ্য থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি, বিশ্ব স্বাস্থ্য এসেম্বলীতে চীনের বিরুদ্ধে সকল দেশকে এক করে করোনা সঙ্গকটকে মোকাবিলা বাদ দিয়ে, নতুন রাজনৈতিক ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ শুরু করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই করোনাকালে ভিয়েতনাম, কিউবা, লাওস, উত্তর কোরিয়া, চীন সহ সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশসহ কিছু কিছু ছোট দেশ যারা সমাজতান্ত্রিক নয় কিন্তু কল্যান রাষ্ট্রের মৌলিক দৃষ্টিভংগীকে সামনে রেখে এগিয়েছে তাঁরা সফল হয়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, কোন দৃষ্টিভিংগীতে তা পরিচালিত হবে তাও যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তাও চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কতটা প্রয়োজন তা পৃথিবীর কাছে আবার নতুন করে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিগত ঠান্ডাযুদ্ধের তথাকথিত সমাপ্তি এবং তার মধ্য দিয়ে সোভিয়েতের পরাজয়ের প্রচারকে সামনে এনে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শকে পৃথিবী থেকে বিদায় করার আগ্রাসী তৎপরতা, নয়া উদারনীতিবাদের সর্বগ্রাসী আক্রমণ তরুণ প্রজন্মের কাছে সমাজতন্ত্র এই কথাটা মুছে দেবার বা তাকে এক দানবীয় ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। পাশাপাশি চীন, ভিয়েতনাম, কিউবার গৃহীত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক নয়, পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তন এই প্রচারটাও উঠে আসে। আর তা আসে দুদিক থেকে। এক, পুঁজিবাদী বুদ্ধিজীবীরা তাত্বিকভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে, এই গৃহীত নীতি যতই কার্যকর হোক তা সমাজতান্ত্রিক নয়। বরং পুজিবাদী ব্যবস্থা বলেই তা সফল হচ্ছে। দুই, সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করেন এমন অনেকে আছেন, তাঁদের দিক থেকেও চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়, এই বক্তব্য আছে।
বিশ্ববিখ্যাত পন্ডিত সামির আমিন তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে চীন সম্পর্কে তাঁর এক দীর্ঘ বিশ্লেষণ দিয়েছিলেন যা Samir Amin on China শিরোনামে African Agenda পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তার উপসংহারে তিনি বলেছিলেন,
“There is no need to hurry and join the financial globalised system, which is the only guarantee for Washington to maintain the dollar’s exclusive privilege. Moreover, that whole pattern of globalisation is already in deep crisis, which offers an opportunity for outsiders. Remaining out opens room for a possible construction of alternative independent regional systems with the perspective of creating better conditions for the advancement of an alternative non-hegemonic globalisation. Simultaneously world capitalism is incompatible in the long run with the existence of non-capitalist entities, and even just relatively independent entities. Remaining out of financial globalisation is an important weapon in your hands; do not offer the weapon to your enemy!”
তিনি চীনের গৃহীত নীতির অনুপুংখ ব্যাখ্যা করেছেন। বৈশ্বিক ক্ষেত্রে নেওয়া চীনের বিভিন্ন বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, চীনের গৃহীত নীতির কার্যকারিতা কতটা তা বলেছেন, কিন্তু চীনকে পুঁজিবাদী দেশ বলেননি। বরং বিশ্ব পুঁজিবাদী সংকটে চীনকে non-hegemonic globalization এ ভূমিকা রাখার কথা বলেছেন।
চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা নিয়ে এ বিতর্ক চলবে। কিন্তু এ সকল দেশের গৃহীত ব্যবস্থা পুঁজিবাদী বিশ্বকে আতংকে রাখছে, এটা স্পষ্ট।
তাই এই সময়কালে পুঁজিবাদের গভীর সংকটে প্রশ্ন উঠতেই পারে, আদি পুঁজিবাদ কেন সংকটে? চীন ভিয়েতনাম, কিউবা যদি পুঁজিবাদী দেশ হয়ে সফল হয় তাঁরা ব্যর্থ কেন? একি তাঁদের নেতৃত্বের দূর্বলতা, নাকি পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই মৌলিক দূর্বলতা। নাকি তাঁদের দাবীতে যাদেরকে পুঁজিবাদী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে তাঁরাই সভ্যতার বিকল্প। তাঁদের লক্ষ্যাভিমুখী পথই সভ্যতার টিকে থাকার, এগিয়ে যাবার পথ। লক্ষ্য নির্দিষ্ট থাকলে ভুল ত্রুটি শুধরে নেওয়া যায়। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবার বিরুদ্ধে যে সমালোচনা বা অভিযোগই থাক না কেন, তাঁরা নিজেরা বলছেন তাঁরা সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই করছেন। তাঁরা সমাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বলছেন। তাঁরা যদি পুঁজিবাদীই হন তাহলে তো তাঁরা সরাসরিই তা করতে পারেন। তাহলে গোটা বিশ্বকে সহজে ভাগ বাটোয়ারা করা যায়। কেউ বলবেন এটা দুই পুঁজিবাদী শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ। যুক্তিটাকি মেলে? মেলে না। তাত্বিকভাবেও না বা সাধারণ যুক্তিতেও না। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের সকল পুঁজিবাদী (সাম্রাজ্যবাদি) শক্তিগুলির নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ তাঁরা দৃশ্যমানভাবে সরিয়ে রেখে, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সংগে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শগত লড়াইএ কার্যকরভাবে নামে। তাঁদের অর্থাৎ পুঁজিবাদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ তাঁরা সামলে নেবার ক্ষেত্রে কিছুটা সফল হয়। এ ক্ষেত্রে তাঁদের বড় সহায় হয় চীন-সোভিয়েত মতাদর্শগত দ্বন্দের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া প্রক্রিয়ায় বিশ্ব কমিউনিস্ট শক্তির বিভক্তি এবং তাঁর পরিণতিতে পরবর্তিকালে, কমিউনিস্ট শক্তিগুলির মধ্যে তা শত্রুতায় পরিণত হওয়া। এ প্রক্রিয়া শুধু কমিউনিস্ট শক্তিগুলির ক্ষতি করেনি দেশে দেশে সকল প্রগতিশীল অন্যান্য শক্তিগুলিকে হীনবল করেছে, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে একের বিরুদ্ধে অন্যকে ব্যবহার করতে পেরেছে বিশ্ব পুঁজিবাদ। তার পরিণতি কি তা এখন ইতিহাস। এর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর গৃহীত আভ্যন্তরীণ ভুল ত্রুটিও রয়েছে। এই বিভক্তি বিশ্ব পুঁজিবাদকে কতটা অনুকূল পরিস্থিতি দিয়েছে সেটাই উল্লেখ করা হল। এই প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবায় গৃহীত পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারার কমিউনিস্ট ও বাম শক্তিগুলির যে মূল সমালোচনা তার জবাব রয়েছে। কিউবা তার নিজস্ব ধারায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাজার বিরোধীতা সত্বেও তার সমাজতান্ত্রিক বিনির্মান এগিয়ে নিচ্ছে। লাটিন আমেরিকার দেশে দেশে কিউবা বিপ্লবী প্রগতিশীল জনগণের প্রেরণার উৎস। এবং তা সাম্রাজ্যবাদের নয়া-উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের হাতিয়ার। ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির গৃহীত নীতির ব্যাপারে অনেক বাম শক্তির যেমন সমালোচনা আছে, তেমনি তাঁদের নিজেদের মধ্যেও বিতর্ক আছে । তারা তা অস্বীকার করেন না। সমাজতান্ত্রিক বিনির্মানের সময় একটি বিষয় খুব মৌলিকভাবে দেখা দেয় তাহলো সম্পদের মালিকানা, রাষ্ট্রের অবস্থান, উৎপাদন শক্তির অবস্থা ও তার ভিত্তিতে উৎপাদন সম্পর্ক নির্ধারণ। বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক স্তর বিভিন্ন হওয়ার ফলে, গৃহীত নীতিও বিভিন্ন হতে পারে। ভিয়েতনাম বিপ্লবের পর দশ বছর পার্টি উৎপাদন ব্যবস্থার সব মালিকানাই রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসে। ব্যক্তিমালিকানাকে প্রায় নিষিদ্ধ করার পর্যায়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তাতে দেশের তাঁদের উৎপাদন শক্তির বিকাশ এই উৎপাদন সম্পর্কের সংগে সংগতিপূর্ণ হয়নি। গৃহীত উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদন শক্তির বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ বিতর্কের মধ্য দিয়ে একপা পিছে ভিয়েতনাম পার্টি এক পা পিছিয়ে নীতি নির্ধারণ করে। ব্যক্তি মালিকানার বিষয়টাও বিবেচনায় নেওয়া হয়। ধীরে ধীরে বাইরের পুঁজি আমন্ত্রন ইত্যাদি প্রক্রিয়া শুরু হয়। তার ফলে কিছু উপসর্গ দেখা দেয় যেমন দূর্নীতি, ব্যক্তিমালিকানার প্রতি মোহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় দেখা দেয়। পার্টি কঠোরভাবে এটাকে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত লড়াই হিসেবে গ্রহণ করে, কিন্তু কখনই এটাকে শুধুমাত্র পার্টি বা রাষ্ট্রকাঠামো দিয়ে মোকাবিলা করতে পার্টি চায়নি। তাঁরা এটাকে জনগণের সম্পৃক্তি এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত করণীয় হিসেবে নিয়েছেন এবং এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেন। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেনিন তাঁর প্রস্তাবিত নেপ এবং বাম পন্থার বিপদ বোঝাতে বহুবার এই কথা তুলেছেন।
বাস্তবতার নিরিখে এটা বলা যায়, করোনাকালে এটা আজ স্পষ্ট পুঁজিবাদ বিশেষ করে তার গৃহীত নয়া উদারতাবাদী নীতি আজ চরম সংকটের মুখে। পুঁজিবাদের সমর্থক বিশ্ব বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরাও আজ প্রকাশ্যে এ কথা বলছেন। এটা আজ স্পষ্ট সামনের দশক পরিবর্তনের দশক এবং তা সমাজতন্ত্র অভিমুখে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে এই সমাজতন্ত্র অভিমুখী শক্তি বিকশিত হবে। আজ প্রয়োজন বৈশ্বিকভাবে এবং দেশে দেশে সকল বামশক্তিগুলির সকল পার্থক্য সত্বেও ন্যূনতম ঐক্যের ক্ষেত্র বের করা।
করোনা আক্রমনের মধ্য দিয়ে এবং তার পরে বিশ্ব পুঁজিবাদ নিজেকে রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে, এমনকি সামরিক সংঘর্ষকেও উড়িয়ে দেওয়া যায়না। ভূ-রাজনীতি নতুন মেরুকরণের দোরগোড়ায়। এটাকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। এ সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং শ্রমজীবি মানুষ, কৃষক, নিম্ন মধ্যবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত মানুষও দারিদ্র সীমার নীচে নেমে যাবে। পুঁজি আর সম্পদ আরও ঘনীভূত হবে, ধনী আরও ধনী হবে। বিভিন্ন ধরণের পুঁজি ( আমাদের মতো দেশের ক্রোনি পুঁজি সহ) রাষ্ট্রকে তাঁদের স্বার্থে ব্যবহার করবে। তার আলামত স্পষ্ট। কর্পোরেট পুঁজি কে বাঁচাতে মূলতঃ প্রণোদনা ঘোষিত হচ্ছে। তাতে সাধারণ মানুষের হিস্যা সামান্য লোক দেখানো। এই বাস্তবতায় আক্রান্ত মানুষের পাশে ঐক্যবদ্ধভাবে এবং দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে। বামপন্থী ও প্রগতিশীলদের নিজেদের পার্থক্যকে মেনে নিয়েই ঐক্যের পথ তৈরি করতে হবে। গত শতাব্দি অনেক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এটাই শিখিয়েছে। সংকীর্ণতার স্থান নেই।
আজ বৈশ্বিকভাবেও এই উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন। দেশীয় ক্ষেত্রেও প্রয়োজন।
একজন বিশ্ববিখ্যাত মার্কসীয় তাত্বিক Giovanni Arrighi তাঁর বই “The Long Twentieth Century” বইএর উপসংহারে লিখেছেন
“Finally, to paraphrase Schumpeter, before humanity chokes ( or basks) in the dungeon (or paradise) of a post-capitalist world empire or world market society, it may well burn up in the horrors (or glories) of the escalating violence that has accompanied the liquidation of the Cold War world order. In this case, capitalist history would also come to an end but by reverting permanently to the systemic chaos from which it began six hundred years ago and which has been reproduced on an ever-increasing scale with each transition. Whether this would mean the end just of capitalist history or of all human history, it is impossible to tell.”
তিনি এটা লিখেছেন করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে। করোনার মধ্য দিয়ে এই প্রশ্ন আজ আরও শাণিত হয়ে উঠেছে। যারা পৃথিবীটাকে পাল্টাতে চান, তাঁদের কে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, করণীয় কি?
সবাইকে সব বিষয়ে একমত হতে হবে তা নয়, মূল শত্রু চিহ্নিত করলে ঐক্য সহজ হয়। যত ন্যূনতমই হোক ঐক্যের বিষয়গুলো খুঁজে দেখা এখনই জরুরি।