বিশ্ব অর্থনীতির হাল হকিকত

Sharing Helps!

১। ভূমিকাঃ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের নানা টালমাটাল, সঙ্গে কোভিড ১৯ এবং বিভিন্ন দেশের  ভ্যাকসিন প্রস্তুতের খবরের এই মহাস্রোতের মধ্যে যে খবরটি এখন সবচাইতে দৃষ্টি  আকর্ষণ করছে তাহলো গত ১৫ নভেম্বর,  আসিয়ান ১০টি দেশসহ চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মত এশিয়ার  অর্থনৈতিক মহারথীসহ ১৫ টি দেশের  মধ্যে  পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক চুক্তি ( The Regional Comprehensive Economic Partnership, or RCEP)। প্রায় ৮ বছরের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফল ।  পৃথিবীর প্রায় ২.২ বিলিয়ন মানূষের বাস এই বাণিজ্যিক চুক্তির আওতায়। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ। আরও আলোচনার বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্ররা এই চুক্তিতে রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র নেই। আর ভারত এই এলাকার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হয়েও, শেষ মুহূর্তে এই চুক্তি থেকে সরে গেছে। যদিও তার জন্যে দ্বার এখনো অবারিত। চুক্তির সার্বিক চেহারা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার না হলেও বিশ্ব অর্থনীতিকে হিসেব করতে গেলে এই ঘটনা সামনে রেখেই হিসেবটা করতে হবে। দেখা যাক, অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার বিচারে কে কোথায় দাঁড়িয়ে, আর অদূর ভবিষ্যতে তার গতিপথটাই বা কি? 

বিশ্বের শীর্ষ ২০ টি অর্থনীতির দেশগুলো হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, জার্মানী, ভারত, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, ব্রাজিল, কানাডা, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ডস, সৌদি আরব, তুরস্ক ও সুইজারল্যান্ড। পৃথিবীর এই শীর্ষ ২০ টি দেশের অর্থনীতি, বিশ্ব অর্থনীতির ৭৯% শতাংশের মালিক, বাকী ১৭৩ টি দেশ ২১% শতাংশের। যারা শীর্ষ অর্থনীতির দেশ তাঁদের অবস্থানের সাধারণতঃ হের ফের বা স্থানচ্যুতি হয় খুবই কম। কিন্তু চিত্তাকর্ষক বিষয় হলো ১৯৮০ সালের দিকে বিশ্বের প্রধান ২০ টি অর্থনীতির শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে ১৭ টি দেশ তাঁদের অবস্থান ধরে রেখেছে-৩ টি দেশের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ নতুন  ৩ টি দেশ এই শীর্ষস্থান দখলের দৌড়ে এগিয়েছে। দেশগুলো হলো চীন, ভারত ও সৌদি আরব। বিশ্ব অর্থনীতির যারা নির্ধারক, অর্থাৎ যারা উৎপাদন ও পণ্য সরবরাহ বা বিপননের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আছে – তাদের  খুব একটা অদল বদল না  হলেও সাম্প্রতিক  যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে তা বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয় হতে পারে।  আগেই বলা হয়েছে, শীর্ষ ২০ টি অর্থনীতিক দেশে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৮০% এর এবং বাকী দেশগুলো সম্মিলিতভাবে ২০% এর মালিক ও নিয়ন্ত্রক। পরিসংখ্যানটি খোদ আই এম এফর Economic Outlook Database 2019 এর ভিত্তি করেই দেখানো হচ্ছে। এই বিচারের ভিত্তি মূলতঃ তথাকথিত মূল্ধারার অর্থনীতির নিয়ামক উপাদান ( parameter)  GDP (Nominal), GDP ( PPP, Purchase Power Parity, International dollars) মাথাপিছু GDP কেই ভিত্তি করা হচ্ছে। এই প্যারামিটারগুলোকে ভিত্তি করে অর্থনীতির শক্তিমত্তার বিচারের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতভেদ আছে, তবুও বহুজনগ্রাহ্য বিবেচনায় এই প্যরামিটারগুলোকেই বিচার্য হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। দেখা যাক চিত্রটি কি?

২। বিশ্বঅর্থনীতির এই পরাশক্তিরা কে কোথায়?

যুক্তরাষ্ট্রঃ GDP (nominal ) এর বিচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ অর্থনীতি। এবং এই তকমা ধরে রেখেছে  ১৮৭১ সাল থেকে। তার জিডিপি ( nominal ) এর পরিমাণ ২১.৪৪ ট্রিলিয়ন ডলার এবং GDP (PPP) এর পরিমাণও ২৩. ৪৪ ট্রিলিয়ন ডলার।  ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আয়তন ছিল ২০.৫৮  ট্রিলিয়ন ডলার। করোনা পূর্ববর্তী অবস্থায় আশা করা গিয়েছিল ২০২০ সালে তা পৌঁছাবে ২২.৩২ ট্রিলিয়ন ডলারে। করোনা পৃথিবীর শীর্ষ অর্থনীতিকে প্রচন্ডভাবে আঘাত করেছে তাই এই ভবিষ্যতবানী কার্যকর হয়নি। এটাই যুক্তিযুক্ত।  দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, গোটা বিশ্বের অর্থনীতির প্রায় এক-চতুর্থাংশ। উন্নত পরিকাঠামো ও প্রযুক্তি, এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এর ভিত্তি। কিন্তু চিত্তাকর্ষক বিষয় হলো – এই অর্থনীতিকে যখন  GDP (PPP) বা Purchase Power Parity ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রকে তার শীর্ষ স্থানটি ছেড়ে দিতে হয়, তার ঘাড়ে নিঃশেষ ফেলা অর্থনৈতিক শক্তি চীনের কাছে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির GDP (PPP) ছিল ২১.৪৪ ট্রিলিয়ন ডলার, চীনের ছিল ২৭.৩১ ট্রিলিয়ন ডলার। Nominal GDP বিচারেও ২০২৩ সালে চীনের অর্থনীতি পৌঁছাবে ১৯.৪১ ট্রিলিয়ন ডলারে, যুক্ত্ররাষ্ট্র এর হবে ২৪.৮৮ ট্রিলিয়ন ডলারে। করোনা পরবর্তী বাস্তবতায় তা পালটে কোথায় যেতে পারে সেটাই দেখার বিষয়।

চীনঃ চীনের Nominal GDP র পরিমাণ ১৪.১৪ ট্রিলিয়ন ডলার। আগেই বলা হয়েছে  GDP (PPP) তা ২৭.৩১  ট্রিলিয়ন ডলার। বিগত দশকগুলোতে চীনের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে  তাৎপর্যপূর্ণভাবে যাকে বলা যায় exponentially. কারুর কারুর মতে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার বদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে চীনের অর্থনীতি অন্যতম বৃহৎ manufacturing এবং রফতানি hub এ পরিণত হয়েছে। চীনকে অনেক সময় ‘World factory’ বা বিশ্ব কারখানা বলা হয়ে থাকে। ১৯৮০ সালের দিকে চীন ছিল বিশ্বের ৭ম বৃহত্তম অর্থনীতি যার GDP  ছিল ২.৮৬ ট্রিলিয়ন ডলার। বিগত দশকগুলোয় প্রায় ১০% জি ডি পি বৃদ্ধির হারে বর্তমানে তার অর্থনীতি এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে  GDP (PPP) এর হিসেবে চীনের অর্থনীতি সর্ববৃহৎ এবং তার পরিমাণ ২৫.২৭ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে তার পরিমাণ হবে GDP (PPP) এর হিসেবে ৩৬.৯৯ ট্রিলিয়ন ডলার ।  তবে যেহেতু, চীনের জনসংখ্যা বিপুল সেহেতু তার GDP per capita অর্থাৎ মাথাপিছু GDP হলো মাত্র ১০ হাজার ডলার, যা বিশ্বের হিসেবে ৭০ তম। এটাই চীনের অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া এই বিপুল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশে পাশে বেড়েছে অর্থনৈতিক  বৈষম্য। দারিদ্র্যের হার আশাতিরিক্তভাবে কমলেও  বৈষম্যও একটা সংকট।  

জাপানঃ বিশ্বে তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতি হলো জাপান। Nominal GDP হিসেবে জাপানের অর্থনীতির আয়তন ৫.১৫ ট্রিলিয়ন ডলার, GDP (PPP) এর হিসেবে তা ৫,৭৫ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে জাপানের অর্থনীতি ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দা জাপানের অর্থনীতিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। জাপানের আভ্যন্তরীণ চাহিদার দূর্বলতা ও বিশাল পাবলিক ঋণ একটি বড় বাধা। এই সময়কালে বিধ্বংসী ভূমিকম্প ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূর্ঘটনা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশা করা গিয়েছিল ২০২০ সালের অলিম্পিক জাপানের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সুযোগ করে দেবে। কিন্তু, করোনা অতিমারির ফলে অলিম্পিক পিছিয়ে যাওয়া এবং স্থগিত হওয়া জাপানী অর্থনীতির জন্য একটি বড় বিপর্যয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

জার্মানীঃ ইউরোপের সবচাইতে বড় এবং শক্তিশালী অর্থনীতি হলো জার্মানী। এর Nominal GDP ৩.৮৬ ট্রিলিয়ন ডলার এবং  GDP (PPP)  ৪.৪৪ ট্রিলিয়ন ডলার. ১৯৮০ সালের দিকে জার্মানী ছিল   বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম অর্থনীতি। জার্মানীর GDP per Capita র পরিমাণ ৪৬,৫৬০ ডলার, যা বিশ্বের ১৮ তম। জার্মান অর্থনীতি মূলতঃ capital good export এর উপর নির্ভরশীল। ২০০৮ সসালে বিশ্ব মন্দার সময়    জার্মানী বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। GDP প্রবৃদ্ধি ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যথাক্রমে ১.৫% ও ০.৫% এ নেমে এসেছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য জার্মানীতে  ‘Industrie 4.0’ এর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে যা তাকে উন্নত উৎপাদন ও শীর্ষ বাজারে পরিণত করতে পারে বলে দাবী করা হচ্ছে।

ভারতঃ করোনা পূর্ব বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে ভারত এখন পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম অর্থনীতি যার GDP Nominal ২.৯৪ ট্রিলিয়ন ডলার। GDP (PPP) র হিসেবে বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম অর্থনীতি যার পরিমাণ ১০.৫১ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে যুক্ত্ররাজ্য ও ফ্রান্সকে অতিক্রম করে ভারত ৫ম বৃহত্তম অর্থনীতিতে প্রিণত হয়েছে। Service sector প্রবৃদ্ধিতে ভারত বিশ্বে এখন ১ম – যা তার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির প্রায় ৬০% এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তা প্রায় ২৮% ভূমিকা পালন করে। যদিও বিপুল জনগোষ্ঠীর ফলে তার GDP per Capita মাত্র ২,১৭০ ডলার, যা নিঃসন্দেহে বিশ্ব পরিসরের হিসেবে অনেক নীচের দিকে। ভারতের অর্থনীতির শক্তিমত্তার দিক হলো বিশাল আভ্যন্তরীণ বাজারের ফলে রফতানীর উপর বেশী নির্ভরশীলতা না থাকা, উচ্চমাত্রার সঞ্চয় হার, সহায়ক জনশক্তি এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী।

যুক্তরাজ্যঃ Nominal GDP র পরিমাণ ২.৪৩ ট্রিলিয়ন ডলার। GDP(PPP) ৩.০৪ ট্রিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর ৬ষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি। যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির সিংহ ভাগ আসে সার্ভিস সেক্টর থেকে যার পরিমাণ প্রায় জি ডি পির ৭৫%, দ্বিতীয় শিল্প, ৩য় কৃষি। যদিও জি ডি পি র বেশী অবদান কৃষির নয়, তবুও দেশের ৬০% খাদ্যের প্রয়োজন মেটে আভ্যন্তরীণ কৃষি থেকে, যদিও মাত্র ২% জনশক্তি এতে নিয়োজিত এই খাতে।

ফ্রান্সঃ Nominal GDP ২.৭১ ট্রিলিয়ন ডলার, GDP (PPP) র পরিমাণ ২.৯৬ ট্রিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর সবচাইতে বেশী পরিব্রাজক এই দেশ ভ্রমন করে। ইউরোপের ৩য় বৃহত্তম অর্থনীতি। জীবনযাত্রার মান উঁচু । GDP per Capita ৪২, ৮৭৭.৫৬ ডলার। স্মপ্রতি এদেশের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। বেকারত্বের হার ৯% এর বেশী। ট্যুরিজমের বাইরে ফ্রান্সের অর্থনীতির প্রধান নির্ভরতার জাউগা হলো কৃষি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক তৃতীয়াংশ কৃষিজমির পরিমাণ রয়েছে ফ্রান্সে। ফ্রান্স পৃথিবীর ৬ষ্ঠ বৃহত্তম কৃষি উৎপাদক দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ২য় বৃহত্তম কৃষি রফতানীকারক দেশ। শিল্প উৎপাদনে মূলতঃ রাসায়নিক, অটমোবাইল ও অস্ত্র উৎপাদনই  প্রধান।

ইটালিঃ Nominal GDP ১.৯৯ ট্রিলিয়ন এবং GDP(PPP) ২.৪০ ট্রিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম অর্থনীতি। মাথাপিছু GDP ৩৪,২৬০.৩৬ ডলার। সম্প্রতি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে। বেকারত্বের হার ১০ শতাংশের উপরে। তবে রফতানি ও ব্যবসায়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।

ব্রাজিলঃ লাতিন আমেরিকার সবচাইতে জনবহুল ও বৃহত্তম অর্থনীতি হলো ব্রাজিল। বিশ্বের হিসেবে ৯ম।  GDP Nominal ১.৮৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং GDP (PPP) ৩.৩৭  ট্রিলিয়ন । অর্থনীতির দূর্বলতম স্থান হলো দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা যা বিনিয়োগ ও ব্যবসায়কে স্থবির করে রেখেছে। ব্রাজিল BRICS এর অংশীদার। মাথাপিছু GDP ৮,৯৬৭ ডলার।

কানাডাঃ Nominal GDP র পরিমাণ ১.৭৩ ট্রিলিয়ন ডলার। GDP (PPP) ১.৮৪ ট্রিলিয়ন ডলার। আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে জি ডি পি ২.১৩ ট্রিলিয়ন ডলারে উওঠে যেতে পারে বলে ধারণা রয়েছে। মাথা পিছু জি ডি পি র পরিমাণ ৪৬,২৬.৭১ ডলার, বৈশ্বিকভাবে যা ২০তম। সার্ভিস সেক্টর অর্থনীতির একটি প্রধান দিক। ‘ম্যনুফ্যাকচারিং’ কানাডার অর্থনীতির মূল ভিত্তি। রফতানির প্রায় ৬৮% এই খাত থেকে আসে। কানাডায় বেকারত্বের হার নিয়ন্ত্রনের মধ্যে।

রাশিয়াঃ স্থল ভাগের হিসেবে রাশিয়া পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ দেশ। Nominal GDP ১.৬৪ ট্রিলিয়ন ডলার, GDP(PPP) ৪.২১ ট্রিলিয়ন ডলার। GDP (PPP) হিসেবে রাশিয়ার অর্থনীতি বিশ্বের ৬ষ্ঠতম, GDP Nominal এর হিসেবে ১১তম। সমাজতান্ত্রিক  অর্থনীতি থেকে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে রূপান্তরের ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছে। রাশিয়ার অর্থনীতি যে বেশ কিছুটা তেল নির্ভর তা স্পষ্ট হয়ে গেছে ২০০৮-২০০৯ বিশ্ব মন্দার কালে। এখনও পশ্চিমা দুনিয়ার অর্থনৈতিক অবরোধ রাশিয়ার অর্থনীতিতে বড় ধরণের চাপ তৈরী করেছে।

দক্ষিণ কোরিয়াঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই  পশ্চিম বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় এবং সহযোগিতায় দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতির যাত্রা শুরু। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিকে বলা হয় Samsung  এবং Hyundai এর conglomerate. বিগত দশকগুলোতে দেশটি Hi Tech শিল্পায়িত দেশ হিসেবে প্রভূত অগ্রগতি করেছে। এর GP Nominal ১.৬৩ ট্রিলিয়ন ডলার এবং GDp(PPP) র পরিমাণ ২.১৪ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু জিডি পি তে ১৯৬০ এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়া ছিল দরিদ্র দেশগুলোর সারিতে , এখন তা ৩১,৩৪৫.৬২ ডলার যা বিস্বের ২৯তম।

স্পেনঃ  বিশ্বের ১৩ তম বৃহৎ অর্থনীতি হলো স্পেন। স্পেনের  GDP Nominal হলো ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার এবং GDP(PPP) ১.৮৬ ট্রিলিয়ন ডলার। ব্রেক্সিট পরবর্তী ইউরো জোনে স্পেন ৪র্থ বৃহৎ অর্থনীতি। ২০০৮ -২০০৯ সালে বিশ্ব মন্দার সময় স্পেনের অর্থনীতি প্রচন্ড ধাক্কা খায়। ২০১৪ সালে র পর ট্যুরিজম, আভ্যন্তরীণ চাহিদা ও রফতানির উপর ভিত্তি করে স্পেনের অর্থনীতি বেশ কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপের দ্বিতীয় সর্বাধিক পরিব্রাজক দেশটিতে ভ্রমন করে। কৃষি এদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। রফতানি বাণিজ্যে অলিভ ওয়েল, মাংস এবং মদ প্রধান পণ্য। প্রধান শিল্পের মধ্যে রয়েছে অটোমোবাইল, রসায়নিক দ্রব্য, ঔষধ প্রস্তুত ও যন্ত্রাংশ নির্মান। বর্তমানে এদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ২% থেকে ৩% এর মধ্যে।

অষ্ট্রেলিয়াঃ গত দু দশকে অষ্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি কম বেকারত্ব, নিম্ন হারের পাবলিক ঋণ, বৃহৎ রফতানি, শক্ত সেবা খাতের উপর দাঁড়িয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। এর Nominal GDP ১.৩৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং GDP(PPP) ১.৩২ ট্রিলিয়ন ডলার । খনিজ সম্পদে অস্ট্রেলিয়া সমৃদ্ধ। অষ্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে GDP এর অবদানে কৃষি, শিল্প ও সেবাখাত যথাক্রমে ৪%, ২৬% ও ৭০% ভূমিকা রাখে। মাথাপিছু GDP র পরিমাণ ৫৬, ৩৬১.৫৮ ডলার, যা বিশ্বে ১১তম।

মেক্সিকোঃ মেক্সিকো লাতিন আমেরিকার ২য় বৃহত্তম অর্থনীতি। GDP Nominal ১.২২ ট্রিলিয়ন ডলার, GDP (PPP) ২.৫৭ ট্রিলিয়ন। মেক্সিকোর অর্থনীতি ২০২৩ সাল নাগাদ GDP র পরিমাণ দাঁড়াবে ১.৫০ ট্রিলিয়ন ডলার, GDP (PPP) ৩.১৮ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াতে পারে বললে ভবিহ্যত বানী করা হয়েছে। দুদশক ধরে মেক্সিকোর অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা ৪% এর নীচে থেকেছে, পক্ষান্তরে শিল্প ও সেবা খাতে ভূমিকা ছিল যথাক্রমে ৩৩% ও ৬৩%। অটোমোটিভ, তেল, ইলেকট্রনিক্স হলো এর শিল্পের ভিত্তি। অন্যদিকে অর্থনীতিক ব্যবস্থাপনা ও ট্যুরিজমে সেবাখাতের প্রধান ভিত্তি।

ইন্দোনেশিয়াঃ ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্ব বৃহৎ অর্থনীতি এবং বৈশ্বিক ক্ষেত্রে ১৬ তম। ১৯৯৭ সালে এইয়ার অর্থনীতি ক সংকটের পর বিগত দু দ শকে ইন্দোনেশিয়া অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি ঘটিয়েছে। GP nominal ১.১১ ট্রিলিয়ন অলার। GDP (PPP) ৩.৫০ ট্রিলিয়ন লার। ইন্দোনেশিয়া এখন ট্রিলিয়ন ডলার ক্লাবের সদস্য। দারিদ্র বিমোচনে ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকা জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রসংশিত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার মাথাপিছু জিডি পি ২০০০ সালে ছিল্ ৮৫৭  আর যা এখন হয়েছে ৩,৮৭১ অলার। ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতিতে GDP তে কৃষির ভূমিকা ১৪% এবং শিল্প ও  সেবা খাত থেকে আসে ৪৩% করে।  

এই ২০ টির বাইরেও রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি দেশ যারা দ্রুত বিকাশমান। আসিয়ান দেশগুলির মধ্যে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন দ্রুত বর্ধনশীল। সাউথ আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ আছে যারা প্রাকৃতিক সম্পদে শক্তিশালী। স্ক্যান্ডিনাভিয়ার দেশগুলির অর্থনীতি অগ্রসর ও অনেকটা স্থিতিশীল। বাংলাদেশ সামষ্ঠিক অর্থনীতিতে বেশ আলোচনায় রয়েছে। তবে, এরা সবাই প্রান্তিক। বৈশ্বিক অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তির ‘কোর’ বা কেন্দ্র প্রথম ২০ টি অর্থনীতিই।

৩। তুলনামূলক বিশ্লেষণঃ

উপরের তথ্য উপাত্ত থেকে এটা স্পষ্ট যে, প্রধান ২০ টি অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলি মাথাপিছু জিডিপি, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা বা অন্যন্য অর্থনৈতিক পরিমাপের  বিবেচনায় উন্নত দেশের সারিতে রয়েছে। এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে জাপানও উন্নত দেশের মধ্যেই পড়ে। চীন ও ভারত বড় অর্থনীতির আকারে সামনের সারিতে থাকলেও সেই বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু, একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে চীনের অর্থনীতির গতি এবং বিকাশমানতার নিরিখে উন্নত বিশ্বের অর্থনীতি অনেকটাই স্থবির বা সংকটাপূর্ণ। কোভিড ১৯ সংক্রমনের পর এটা আরও স্পষ্ট। বৈশ্বিক অর্থনীতির বহুমাত্রিক দ্বন্দ ও প্রতিযোগীতার বিবেচনায়, বিশ্বের সর্ববৃহৎ বা শক্তিশালি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি দৃশ্যতঃই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এবং চ্যালেঞ্জ প্রদানকারী  দেশ চীন। ১৫ নভেম্বর এশিয়া অঞ্চলের এই বাণিজ্য চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় উন্নত দেশগুলির জন্য বড় ভাবনা।

রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিচারে, পৃথিবীর গোটা অর্থনীতিকে দুটি মৌলিক কাঠামোতে ভাগ করা যায়। অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্কের নিরিখে- এই কাঠামোর একটি  পুঁজিবাদী কাঠামো আর একটি সমাজতন্ত্রমুখী কাঠামো ( সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটা না বলেও) । এ নিয়ে বিপুল বিতর্ক রয়েছে। কোন কোন দেশ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে তাঁদের ভিত্তি বা লক্ষ্য মনে করে আর কারা তাঁদের অর্থনীতিকে ঘোষিতভাবেই পুঁজিবাদী মনে করে – সেটা খুব অজানা নয়। পৃথিবীর মূল অর্থনীতির ধারা এখনো পুঁজিবাদী।  আলোচিত দেশগুলির মধ্যে চীন, ভিয়েতনাম মনে করে তারা সমাজতন্ত্র বিনির্মানের জন্য এগিয়ে যাচ্ছে তাঁদের লক্ষ্য সমাজতন্ত্র। এবং তা  তাদের দেশের বাস্তবতার ভিত্তিতে। চীনা পার্টির কংগ্রেস দলিল ও তার ভিত্তিতে সম্প্রতি চীনা পার্টির সাধারণ সম্পাদক শী জিন পিং এর  এক প্রকাশিত লেখায়, বা  ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির দ্বাদশ পার্টি কংগ্রেস দলিলে বিশদে তাঁদের কর্মসূচী ও মূল লক্ষ্য  বিধৃত রয়েছে। এর বাইরে কিউবা, লাওস এবং উত্তর কোরিয়া সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকেই  তাঁদের লক্ষ্য হিসেবে   ঘোষণা করে। কাম্পুচিয়া সমাজতন্ত্র অভিমুখীন  জনগণের গণতান্ত্রিক অর্থনীতিকে  তাঁদের লক্ষ্য মনে করে। নেপালে সাধারণ নির্বাচনে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি সরকার গঠন করেছে। তাঁদের লক্ষ্যও সমাজতন্ত্র। এর বাইরে পৃথিবীর অনেক অর্থনীতি আছে যাকে মিশ্র বলা চলে। লাতিন আমেরিকার অনেক অর্থনীতি সমাজতন্ত্রমুখী হিসেবে ঘোষিত। অর্থাৎ তাঁদের অর্থনীতিকে কল্যানমুখী রাষ্ট্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলা হয়। তাই রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিচারে বৈশ্বিক অর্থনীতি মোটা দাগে হয় পুঁজিবাদী নতুবা, সমাজতন্ত্রমুখী বা সমাজতান্ত্রিক। প্রথম ২০ টি প্রধান অর্থনীতিকভাবে শক্তিশালী দেশের মধ্যে চীন ভিন্ন সবাই ঘোষিতভাবে পুঁজিবাদী। তাই বিশ্ব অর্থনীতির সংকট আসলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকট। প্রশ্ন হল, যে দেশগুলো নিজেদেরকে  সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কাঠামোর  অংশিদার বা সমাজতন্ত্রমুখী বলছে তাঁরা এই সংকট কিভাবে  মোকাবিলা করবে। মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক-অর্থনীতির আদিপাঠের দৃষ্টিতেই যদি বলা যায়, এখনো বিশ্ব অর্থনীতি সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির শোষণের অধীন। যাকে এখন নয়া-উদারতাবাদী নীতি বলা হয়। এই  নয়া-উদারনীতিবাদী নীতির আওতায় যে  পুঁজিবাদী দেশটা  প্রধান, তাঁদের শোষণটাও প্রধান। সেই বিবেচনায় মার্কিন পুঁজিই এই শোষণের  নির্ধারক। আরও যারা কাছাকাছি অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশ রয়েছে, তাঁরাও এই শোষণের অংশীদার আর তার ফলে এদের মধ্যেও দ্বন্দ বা প্রতিযোগিতা রয়েছে। গত শতাব্দিতে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর দ্বন্দের  ফলে দু’ দুটি বিশ্ব যুদ্ধ হয়েছে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর  প্রধান দ্বন্দ দৃশ্যতঃই শুরু হয়েছিল সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদের মধ্যে।  পুঁজিবাদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ সাময়িকভাবে পিছনে চলে যায় বা তাঁদের মধ্যে আপোষ রফা হয়।  সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সোভিয়েত সমাজতন্ত্র হেরে গেছে। কেন হেরেছে সেটা আলাদা। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিলুপ্তির পর পুঁজিবাদের যারা ধারক বাহক তাঁরা বলেছেন, সমাজতন্ত্র ইতিহাসে একটা দুর্ঘটনা। পুঁজিবাদই শেষ কথা। তাঁরা বলেছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সাথে সমাজতন্ত্র ঘোষিত অন্যান্য দেশসমূহ বিলুপ্ত হবে অথবা  সার্বিক অর্থে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শেরই ইতি হবে।  আর তাঁদের দৃষ্টিতে নয়া-উদারনীতিবাদই শেষ উত্তর। কিন্তু, বিগত দু থেকে আড়াই দশকের মধ্যে আজ এটা স্পষ্ট যে, এই দাবী কতটা  অর্থহীন। কোভিট-১৯ এর আঘাতের পর আজ খোদ আমেরিকাতেই এই প্রশ্ন উঠছে-৯৯ ভাগের  না ১ ভগের দেশ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজপথে এখন লালপতাকা দেখা যায়। সেখানেও সমাজতন্ত্র এই শব্দটা এখন অনেক বেশী প্রাসংগিক। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এটার উত্তর আরও প্রকট হয়ে উঠবে।      

যারা সমাজতন্ত্রে বা মার্ক্সীয় রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে বিশ্বাসী তাঁদেরও  অনেকের মতে চীনের অর্থনীতিরও মূল কাঠামো পুঁজিবাদী। সেটা আলাদা বিতর্ক। আগেই বলা হয়েছে, চীনা পার্টি বলছে তাঁরা সমাজতন্ত্র গড়ার লড়াইএ আছে এবং মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ তাঁদের মূল মতাদর্শ। তাই অন্যদের সমালোচনা বা বিতর্ক যাই থাক, সেটা বিতর্ক করে সমাধানযোগ্য নয়। আর চীনা রাজনৈতিক-অর্থনীতি যে চিরায়ত পুজিবাদের বিরুদ্ধে তাও স্পষ্ট। তাদের মধ্যকার দ্বন্দ দু’টি পুঁজিবাদের মধ্যেকার দ্বন্দ নাকি পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ সেটা তর্ক করে  প্রমান সহজ নয়। তাছাড়া বেশকিছু সীমাবদ্ধতা সত্বেও চীনের অর্থনীতির বিকাশ গতিশীল, অথচ চিরায়ত পুজিবাদের অর্থনীতি যে ভয়াবহ  সংকটে এটা সম্পর্কে কারুর খুব একটা দ্বিমত নেই। এমনকি যারা সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ককেও সঠিক মনে করেন না,  তাঁরাও বর্তমান শীর্ষ পুঁজিবাদী দেশগুলির  অর্থনীতির চরম সংকটের কথা বলছেন। সম্প্রতি ফরাসী অর্থনীতিবিদ  থমাস পিকেটির ‘Capital in the Twenty first century’ বই এ  বৈশ্বিক অর্থনীতির ভয়াবহ ঘনীভবন ও বৈষম্যের কথা তুলেছেন সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে। অর্থাৎ এই চুড়ান্ত ঘনীভবন ও বৈষম্যের উৎস বন্ধ না করলে বৈশ্বিক অর্থনীতি এক ভয়াবহ সংকটে পড়বে। এর হাত থেকে বাঁচার  জন্য তার নিজস্ব প্রস্তাব আছে, তা প্রয়োগসাপেক্ষ কিনা, সেটা আলোচনা হতে পারে বা বিকল্প প্রস্তাব আসতে পারে, কিন্তু তা দিয়ে পুঁজিবাদের সংকটকে অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করা চলে না। উপরের বাস্তব চেহারা তাই নির্দেশ করছে। পৃথিবীব্যাপী উন্নয়ন অর্থনীতির অনেক মডেল রয়েছে। সে সব মডেলের লক্ষ্য অবশ্যই জনমুখী, বৈষম্য কমানো বা অতিকেন্দ্রীভবনের বিপক্ষে। কিন্তু প্রশ্ন হল কোন রাজনৈতিক রাষ্ট্রকাঠামোতে তা অর্জন করা সম্ভব? এখানেই আসে মৌলিকভাবে উৎপাদন কাঠামো ও রাষ্ট্রকাঠামো বদলের। আর রাজনৈতিক –অর্থনৈতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় তা ‘বিপ্লব’। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই সংকট তারই আলামত, এটা রাজনৈতিকভাবে বলাটাই বৈপ্লবিক চিন্তা, অগ্রসর চিন্তা।

এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান এই প্রতিযোগিতা বা দ্বন্দের পরিণতি কি? এটা কি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মত সমাজতন্ত্রমুখী রাজনৈতিক-অর্থনীতিকে পরাস্ত করতে পারবে, নাকি পুঁজিবাদ তার সঙ্কটের মধ্য দিয়েই পরাজয়ের মুখ দেখবে। তাত্বিক বা ব্যবহারিক সকল উত্তর এখানেই বর্তমান।

শেষ উত্তরটা কি ?ঃ

এটা বলা অযৌক্তিক নয় যে, বিশ্ব অর্থনীতির এই দ্বন্দ নতুন বাস্তবতা তৈরী হবার অন্তর্জালা। পুঁজিবাদের যেমন বৈশ্বিক সংকট দৃশ্যমান, তেমনি প্রতিটি দেশে দেশে রয়েছে এই সংকটের বহিঃপ্রকাশ এবং লড়াই। দেশে দেশে  এ লড়াই যত শক্তিশালী হয়, বৈশ্বিক পুঁজিবাদও তত দূর্বল হয়। দশকের পর দশকের ধরে এ লড়াই চলছে। কখনো শোষিত মানুষ বা তার রাজনৈতিক শক্তি জেতে, কখনো জেতে শোষক শক্তি। আর ইতিহাসের এই পর্যায়ে পুঁজিবাদ যেহেতু শোষকের হাতিয়ার, সেহেতু তার সংকট শোষকের সংকট। অনেকে বলেন, প্রায় ৬০০ বছর ধরে পুঁজিবাদ তার সংকট  মোকাবিলা করতে পেরেছে, এখনো পারবে। ইতিহাস বলে পুঁজিবাদ তার সংকট যতবার অতিক্রম করেছে, ততবার তার চাইতে অধিকতর সমাধানহীন সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। Giovanni Arrighi তাঁর ‘ Long Twentieth Century’ বইএর উপসংহারে লিখেছেন, ‘Capitalist history would also come to an end but by reverting permanently to the systemic chaos from which it began six hundred years ago and which has been reproduced on an ever-increasing scale with each transition. Whether this would mean the end of just of capitalist history or of all human history, it is impossible to tell’.  যতই বলা অসম্ভব হোক, বিশ্ব সভ্যতাকে ধ্বংসের নিয়ামক যদি পুঁজিবাদ হয়, বিশ্বসভ্যতাকে  রক্ষা করার শর্ত হলো পুঁজিবাদকে পরিত্যাগ এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ককে উৎখাত।


Sharing Helps!