প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা – ২০২১ দেরীতে হলেও কিছুটা আলোচনায় আসছে। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা ও শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে আমাদের একটা ঔৎসূক্য রয়েছে,রয়েছে একধরণের উদ্বেগ। কোন বিশেষজ্ঞের তকমা বা দাবী থেকে নয়, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কিছু কথা তুলতে চাই। শিক্ষার সকল স্তরের মধ্যে যদি আপেক্ষিক গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনা করা হতো, তাহলে এটা প্রায় অনস্বিকার্য যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক। একটি সুশিক্ষিত, দক্ষ ও মানবিক গুণসম্পন্ন জাতি গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার এই স্তরের অবদান সর্বাধিক। যে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কাঠামো, শিক্ষণ পদ্ধতি যত বেশী উন্নত, সংবেদনশীল, মানবিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সে দেশের উচ্চ শিক্ষাও তত বেশি সৃজনশীল ও দক্ষ হয়ে ওঠে। তাই, এই স্তরের শিক্ষাক্রম তৈরিতে যে কোন ভ্রান্তির জন্য জাতিকে কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে।
প্রস্তাবিত কারিকুলাম যার নাম ‘ জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণী’, তাতে উপক্রমণিকা বাদে ১৯ টি অধ্যায় রয়েছে। রূপকল্প, অভিলক্ষ্য, শিক্ষাক্রমের ধরন, যোগ্যতার ধারণা, মূল্যবোধ, শিখন-ক্ষেত্র, শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায় ও স্তরের উদ্দেশ্যসহ ‘পেডাগজি’ র নানাবিধ দৃষ্টিভঙ্গিগত বিষয়াদি এতে রয়েছে। এর অনেক বিষয় রয়েছে বিমূর্ত এবং সাধারণের কাছে বোধগম্য ও নির্দিষ্ট নয়। সে আলোচনা আলাদাভাবে হতে পারে, তা কিছুটা তাত্বিকও বটে। কিন্তু আজকের আলোচনায় নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে থাকার চেষ্টা করবো।
এই রূপরেখার ৮ম, ১১শ ও ১২শ অধ্যায়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য ১০ টি শিখন ক্ষেত্র বলা হয়েছে। নির্দিষ্টভাবে এই শিখন ক্ষেত্রগুলো হলোঃ (১) ভাষা ও যোগাযোগ (২) গণিত ও যুক্তি (৩) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (৪) ডিজিটাল প্রযুক্তি (৫) পরিবেশ ও জলবায়ু (৬) সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব (৭) জীবন ও জীবিকা (৮) মূল্যবোধ ও নৈতিকতা (৯) শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা (১০) শিল্প ও সংস্কৃতি ।
শিখন ক্ষেত্রগুলি নিয়ে সাধারণভাবে আপত্তির বেশি কিছু নাই। কারণ মতাদর্শগত বিষয় বিবেচনায় না আনলে বিশ্বব্যাপী এই শিখনক্ষেত্রগুলি বৈশ্বিকভাবে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত ।
এই রূপকল্পে শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায় বা স্তরের উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট করতে গিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে কয়েকটি স্তরে বিভক্ত করে তার উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। স্তরগুলি হলো প্রাক-প্রাথমিক যা মূলতঃ প্রস্তুতিমূলক, দ্বিতীয়টি প্রাথমিক যাকে বলা হয়েছে ভিত্তি, তৃতীয়টি মাধ্যমিক যার উদ্দেশ্য সামাজিকরণ, চতুর্থ উচ্চ-মাধ্যমিক যাকে বলা হচ্ছে বিশেষায়ণের জন্য প্রস্তুতি এবং পঞ্চম হলো উচ্চ-শিক্ষা যা হলো বিশেষায়ণ।
এই শিখন ক্ষেত্র ও কাঠামো বিন্যাসকে সামনে রেখেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তর বা ৫ম শ্রেণীর জন্য বিষয়গুলি হলোঃ বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, শিল্পকলা।
এরপর ৬ষ্ঠ থেকে ১০ শ্রেণী পর্যন্ত বিষয়গুলি হলোঃ বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, সামাজিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ধর্মশিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি। এই শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে বা পক্ষে কথা বলতে গেলে প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক, ৯ম ও ১০ম শ্রেণীতে গত প্রায় ষাট বছর কাঠামোটি কি ছিল। এটা প্রায় সবার জানা ৯ম ও দশম শ্রেণীতে শিক্ষাক্রমে মূলতঃ তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল তাহলো মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য। এই তিনটি বিভাগে বাংলা, ইংরেজী, সাধারণ গণিত ছিল সবার জন্য। যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়বে তারা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান অথবা উচ্চতর গণিত ঐচ্ছিক বিষয় নিতে পারতো। তেমনিভাবে মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগেও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পাঠ্য ছিল।
একটু তুলনা করলেই পূর্বতন ও বর্তমান শিক্ষাক্রমের মধ্যে পার্থক্যটা পরিষ্কার। অর্থাৎ আগের পাঠক্রমে ৯ম ও ১০ম শ্রেণী থেকেই ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্র প্রস্তুতের সিড়িতে উঠে যেতো (যদিও সেই শিক্ষাক্রমের পঠন-পাঠন পদ্ধতি, বইএর মান, অনাবশ্যক বিষয়বস্তু সন্নিবিষ্ট করা, মুখস্ত করা, কোচিং নির্ভরতাসহ অসংখ্য নেতিবাচক বিষয় এতে ছিল) । যারা বর্তমান শিক্ষাক্রম এর প্রণেতা তাদের প্রধান বক্তব্য হলো, পূর্বতন শিক্ষাক্রমে ৯ম ও ১০ শ্রেণীতেই এই ধরণের বিভক্তি মানব শক্তির সামাজিককরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, ফলে শিক্ষার্থীরা অতি শীঘ্র কৃত্রিম বিশেষায়ণের শিকার হয়। তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যাক যে আমাদের শিক্ষার্থীদের সামাজিককরণের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। সেই লক্ষ্যে নতুন প্রস্তাবণায় এই বিভক্তি তুলে দিয়ে সবার জন্য নতুন দশটি বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া হলো। সেখানে সবাইকে বাংলা, ইংরেজী, অংক পড়তে হবে আগের মত। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীব-বিজ্ঞান এমনকি বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সমন্বয়ে শুধু ‘বিজ্ঞান’ নামক বিষয় পড়ানো হবে। সেখানে ব্যবহারিক ক্ষেত্রও থাকছে না। এইটা বোঝার জন্য খুব কষ্ট করতে হয় না যে বিজ্ঞান পড়ার ক্ষেত্রে এ এক যুগান্তকারী (?) পরিবর্তন আনা হলো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে বিজ্ঞানের বিষয়কে আরও যুগোপযোগী না করে তাকে ছেঁটে ফেলে দেওয়া হলো তথাকথিত সামাজিককরণ ও একমুখীকরণের নামে। একইভাবে সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলো ছেঁটে ফেলে দেওয়া হলো বিজ্ঞান পড়ানোর ছলে। উচ্চতর গণিত বা আরও পরিশীলিত গণিতের পরিবর্তে সাধারণ গণিত পড়ানো হবে যা উচ্চ-মাধ্যমিক হোক আর উচ্চ শিক্ষায় হোক শিক্ষার্থীদের অস্ত্রহীন করে দেবার নামান্তর। বিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের প্রাথমিক বিশেষয়াণের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত করে কি বিষয় পড়ানো হবে সেটা একটু বুঝে নেওয়া যাক। সেগুলো হলোঃ জীবন জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ধর্মশিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, যার পোষাকী নাম ‘ভালো থাকা’। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পড়তে হবে জীবন-জীবিকার মত বিষয়। এর ‘পেডাগজিক্যাল বা প্রায়োগিক কোন যৌক্তিকতা কি প্রমান করা যায়? বিজ্ঞানের বা সমাজবিজ্ঞানে বিকল্প বা সমমানের এই বিষয়গুলি পাঠক্রমের সামাজিকরণের বা বিশেষায়ণ কোথায় ভূমিকা রাখবে?
অনেক প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলাপ করেছি যাদের অধিকাংশই নিম্নের বিষয়গুলির ব্যাপারে একমত এবং অত্যন্ত উদ্বিগ্নঃ (এক) সহজীকরণের নামে প্রস্তাবিত কারিকুলামকে অনাবশ্যকভাবে ‘লঘু করে ফেলা হয়েছে। (দুই) জীবন-জীবিকা নামক আবশ্যিক বিষয় শুধু অপ্রাসংগিক নয়, অনাবশ্যক। (৩) সামজিককরণের নামে বা প্রযুক্তির নামে মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ও পঠনের সময়কাল ও মানকে নীচে নামিয়ে ফেলা শুধু আত্মঘাতি নয়, গৃহীত শিক্ষানীতি ও সংবিধানে গৃহীত বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার অধিকার থেকে নতুন প্রজন্মকে বঞ্চিত করার সামিল। (৪) গণিত ও পরিসংখ্যানকে এই শিক্ষাক্রম থেকে কার্যতঃ বিদায় করা হয়েছে, যা শুধু বিজ্ঞান নয় উচ্চতর সমাজবিজ্ঞান যা অনেক ক্ষেত্রে গনিত ও পরিসংখ্যানবিদ্যা নির্ভর তাকে পংগু করে দেবার সামিল। (৫) তথ্য প্রযুক্তির উপর বেশী গুরুত্ব দিতে গিয়ে বিজ্ঞান ও অংককে সংকুচিত করার প্রয়াস শেষ বিচারে তথ্য প্রযুক্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। (৬) ধর্ম শিক্ষার বিশেষ উচ্চশিক্ষা থাকতেই পারে, কিন্তু সাধারণ শিক্ষার জন্য তা ৮ম শ্রেণী পর্যন্তই যথেষ্ট, ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত অবশ্যিক করলে তাতে পাঠক্রমে বিজ্ঞান ( সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক সহ) এর মত আবশ্যিক বিষয়ের সংকুচিত হতে বাধ্য।
মোটা দাগের এই বিষয়গুলি কি উপেক্ষা করার মত?
এ ছাড়া আসা যাক একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর বিষয়গুলো।
১৩ তম অধ্যায়ে বর্ণিত রয়েছে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে কিভাবে ছাত্র ছাত্রী বিষয় নির্বাচন করবে,সেগুলো। সেখানেও পরিস্কার বলা হয়নি নির্দিষ্ট বিষয়গুলো কি কি । সেখানে আবশ্যিক, নৈর্বাচনিক ও প্রায়োগিক ( ঐচ্ছিক) বিষয় নেবার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়গুলো কি, তাদের মান কোন মাত্রার হলে তা উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে, এই দু’ বছরে সেই কারিকুলাম ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষে ধারণযোগ্য কি না, সে বিষয়েও কিছু বলা হয়নি। এ ছাড়াও স্কুল এবং কলেজগুলোর মধ্যে মানগত যে বৈষম্য রয়েছে, তার ফলে উচ্চশিক্ষায় কোন এলাকার বা শ্রেণীর ছেলেমেয়েরাই সুযোগ পাবে, অন্যরা পাবে না, সে বিষয়ের উপর আলোকপাত নেই।
তাছাড়া এটা স্পষ্ট যে, ৯ম ও ১০ শ্রেণীতে যে ১০ টি শিখন বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, তার সাথে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর বিষয়গুলোর সমন্বয় বা ধারাবাহিকতা কিভাবে থাকবে তারো কোন উল্লেখ বা রূপরেখা নেই। যে কেউ একটু গভীরে গেলেই বুঝতে পারবে আসলে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত বিষয়ের সংগে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর আসলে কোন সম্পর্ক নাই। এখানে পঠিত অংক, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান কোনটাই পরবর্তী বিশেষায়ণের স্তরে খুব কাজে লাগবে না। যদি ধরেও নেই পড়ানোর পদ্ধতি, মূল্যায়নের পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে আমরা আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করছি ( যদিও এ ব্যাপারে বহুবিধ সংকট রয়েছে), তাহলেও যে বিষয়গুলো পড়ানোর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সিলেবাস তৈরি হবে, তাকে কিছুতেই অগ্রগতি হিসেবে ধরা যায় না, বরং এটা বড় ধরণের পশ্চাদপসরণ।
প্রস্তাবিত মাধ্যমিক কারিকুলাম নিয়ে ইতিমধ্যে অল্পবিস্তর পত্র পত্রিকা এবং সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটা বড় বিতর্ক রয়েছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে সামাজিকরণের উপর জোর দিতে হবে, নাকি বিশেষায়িতকরণের দিকে জোর দিতে হবে। বিপত্তিটা এখানেই। সময়ের সংগে সংগে এই বিষয়গুলো পালটায়। একটা উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে, একজন মানুষ বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিষ্কার বা সত্যগুলো না জেনে কি তার সামাজিক বোধকে উন্নত করতে পারে? বিজ্ঞানের সত্য আর সেই সময়ে সামাজিক চেতনা সব সময় একই পর্যায়ে থাকে না। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। এ বিষয়ে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও থেকে শুরু করে ইতিহাসের অনেক উদাহরণ আছে। আমাদের শিক্ষার কারিকুলামে অনেক কিছু আছে যা বিজ্ঞানবিরোধী আমরা কি তা পড়তে থাকবো না পড়বো? আবার আমাদের অনেকে বিজ্ঞান পড়েন অথচ তিনি দার্শনিক চিন্তায় বিজ্ঞানকে মানেন না। তাহলে এই বিজ্ঞান কোন কাজে লাগবে? প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। একজন ভালো প্রযুক্তিবিদ হলেই তিনি বৈজ্ঞানিক চিন্তায় উন্নীত মানুষ হবেন তা নয়। যাহোক, আগেই বলেছি, শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের একটি। একে বলা যেতে পারে transitional phase. প্রকৃতির মত এখানেও অতিরিক্ত সুপ্তশক্তি (latent heat) দিতে হবে। এখানে কোন ধরণের ভারসাম্যহীনতা ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যত জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ব্যক্তিগত রেষারেষি বাদ দিয়ে গভীরভাবে ও সুচিন্তিতভাবে বিষয়টি আলোচনায় আসতে হবে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও বলবো তাড়াহুড়ো না করে আরো ব্যাপকভাবে আলোচনায় আনুন ।
আগেই বলেছি, যে ১০ টি বিষয় প্রস্তাব করা হয়েছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। আমাদের সুনির্দিষ্ট মত, বাংলা, ইংরেজি, অংকসহ কয়েকটি কোর কোর্স থাকা উচিত। বাকীগুলো বিজ্ঞানে অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিত এদের আলাদা কোর্স করে, তেমনি মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানএর আলাদা কোর্সগুলো ঐচ্ছিক বিষয় করা উচিত। এখানে একটা বিষয় করা যেতে পারে তাহলো যারা বিজ্ঞানের কোর্সগুলোকে নেবে তাদের অবশ্যই একটি সমাজবিজ্ঞান এর ইন্টিগ্রেটেড কোর্স নিতে হবে এবং যারা মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানের কোর্স পড়বেন তাদেরকে একটি ইন্টিগ্রটেড বিজ্ঞান কোর্স নিতে হবে। অন্যান্য কোর্সগুলোকে ঐচ্ছিক করতে হবে, কেউ ইচ্ছে করলে তা নিতে পারে। তথ্য প্রযুক্তির বিষয়কে বেশী গুরুত্ব দিতে চাইলে তা ঐচ্ছিক বিষয়ের মধ্যে আনা যেতে পারে। কারিগরি শিক্ষাকে একটি সমান্তরাল ও গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে এর সংগে যুক্ত করতে হবে। আসলে বর্তমান বাস্তবতায় বিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞান উভয়কেই যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই কারিকুলাম করতে হবে- তা ঠিক। তবে সবাইকে মিলিয়ে স্যালাইন বানানোটা উচিত হবে না। ধারাবাহিকতাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্যবিষয়।
তাছাড়া আসল চ্যালেঞ্জ হলো বইগুলো কিভাবে লিখতে হবে এবং শিক্ষণ ও পরীক্ষণ পদ্ধতিটা কতটা বৈজ্ঞানিক ও সৃজনধর্মী হবে। মডেল বইগুলো তৈরি করার আগে পদ্ধতি বা কাঠামো গত পরিবর্তন মারাত্মক হতে পারে।
যতই বলা হোক যথেষ্ট সময় দিয়ে পাঠক্রম তৈরি করা হচ্ছে। কার্যতঃ মনে হয় অনেকেই বিষয়টি গভীরে যেতে চাননি, অথবা যাবার সময় পাননি । অনেকে জানেনই না কি হচ্ছে। এই আলোচনার মধ্যে আমার অনেক বন্ধু, ছাত্রপ্রতীম এবং ছাত্ররাও দেখছি। সবাইকে অনুরোধ করবো, ব্যক্তিগত আক্রমণ না করে মতামতের গুরুত্বকে মূল্য দিন। আমি মনে করি প্রস্তাবিত কারিকুলাম প্রয়োজনকে মিটাচ্ছে না। এটা ক্ষতিকর হতে পারে। তাড়াহুড়ো করে কোন জিনিস অন্তত শিক্ষায় আনা ঠিক নয়। কারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন জিনিসের ফলাফল দীর্ঘমেয়াদি হয়।
যতই বলা হোক, তৃণমূল এ আমরা আলোচনা করছি, বহু বিশেষজ্ঞরা নিয়োজিত হয়েছেন, তবুও আমার মনে হয় সে সকল উদ্যোগে ‘ক্রিটিক্যাল বিশ্লেষণে’ র চেয়ে, যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে ধরণের মনোভাবই প্রধান ধারা হিসেবে রয়েছে। তাই আমার মনে হচ্ছে, আমরা স্পষ্টতঃই বিজ্ঞানের উচ্চ শিক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত তো করছিই, মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানকেও দিশাহীন ও ক্ষতিগ্রস্ত করছি। আমরা মুখে যত কথাই বলি না কেন, এই কারিকুলাম কোনভাবেই আমাদের দক্ষ জনশক্তি বা মানবিক মানুষ তৈরির জন্য যুগোপযোগী হচ্ছে বলে মনে করতে পারছি না।
বিষয়গুলো শুধু বিমূর্তভাবে নয়, নির্দিষ্ট সিলেবাস এবং তার ভিত্তিতে পাইলট বই তৈরি করে এগুনো উচিত। যতদিন তা হচ্ছে না, কারিকুলাম পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে এগুনোর চেষ্টা ফলবতী হতে পারে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবশ্যই ভাবতে হবে তাহলো এ পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, তাদের বেতন কাঠামো, শহর এবং গ্রামের স্কুলের মধ্যে বৈষম্য নিরসনের প্রকল্প ও কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা এই কারিকুলামের সংগে কিভাবে সমন্বিত ও সম্পর্কিত হবে তা নির্দিষ্ট করা। তা না হলে ব্রেকহীন গাড়ির মত শিক্ষাব্যবস্থা গহীন খাদের দিকে চলে যেতে পারে।
সবশেষে এটা বলা উচিত, আমরা বড় গলা করে নতুন শিক্ষা রূপকল্পের কথা বলি, কিন্তু যখনই বাজেটের প্রশ্ন আসে, তখনই মান্ধাতা আমলের জিডিপির ২% এর বেশী বরাদ্দ করি না। শুধু কথায় চিড়ে ভিজবে না। আর এর দায় সরকারকে নিতে হবে।
বড় সমস্যা হলো আমাদের দেশের পত্রিকা বা গণমাধ্যমেও এ ব্যাপারে আরোও ক্রিটিক্যাল আলোচনা আসা উচিত, কিন্তু তা আসছে না। জানি না তারা সবাই এই রূপকল্পের ব্যাপারে কি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মনে হচ্ছে, সবক্ষেত্রেই এ এক আশ্চর্য নিরবতা। ‘রোম পোড়ে, নিরো বাঁশী বাজায়’।