খন্ড কথা, অখন্ড ভাবনা

Sharing Helps!

 

মৌলিক শিক্ষা কোন পথে?

মাধ্যমিকে আমি মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিলাম। যেহেতু অজ গ্রামের স্কুলে পড়তাম তাই বিজ্ঞান বিভাগ নিতে পারিনি। তাই বাধ্য হয়ে অর্থনীতি, পৌরনীতি ও ইতিহাস পড়তে হয়েছিল। আজও প্রায় ষাট বছর পর অবস্থা খুব পাল্টেনি। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নেবার সুযোগ হলো। হয়ে গেলাম বিজ্ঞানের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়া শেষ করে চাকরি না করে ঢুকে পড়লাম রাজনীতিতে। ২০ বছর প্রায় সেখানে কাটালাম। ফলে আবার অর্থনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস সেগুলো পড়তে হলো। সে তো নিজে পড়া। অক্সফোর্ড, হার্ভার্ডে তো নয়। জীবনের পাঠশালায়। পরবর্তী ২৬ বছর যখন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে হলো, আবার পদার্থবিজ্ঞান। তাই জীবনের শেষপ্রান্তে এসে মনে হচ্ছে কিছুই শেখা হলো না।কোনটাই গভীরভাবে শেখা হল না। এই উপক্রমণিকার কারণ হলো, মাঝে মাঝে দেখি সামাজিক এই মাধ্যমে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের বিতর্কটাই সবচাইতে জমে ওঠে। যারা পুঁজিবাদের সমর্থক তারা সমাজতন্ত্রের তত্বকে আক্রমণ করার চেয়ে, যারা সমাজতন্ত্রের সমর্থক তাদেরকে ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণ বেশী করেন। তেমনি যারা সমাজতন্ত্রের পক্ষের তারা পুঁজিবাদের চিরায়ত বা সাম্প্রতিক কোন তত্ব পড়ার ধারে কাছে না গিয়ে পুঁজিবাদের পতন চাচ্ছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হবার পর, বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভক্তি, ভাটা ইত্যাদি কারণে, পুঁজিবাদের সমর্থকদের জন্য আক্রমণ করাটা সহজ হয়ে উঠেছে। যেহেতু সমাজতন্ত্র এখন কিছুটা কোনঠাসা, সেজন্য। তাছাড়া সমাজতন্ত্রী বা মার্ক্সবাদী রা বহুভাগে বিভক্ত বিধায় তারা পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মত গালাগালি দেয়। এমনকি যারা মার্ক্সের লেখা একটা বইও পড়েননি তারা মার্ক্সবাদ বস্তাপচা মতবাদ এই হিসেবে চালিয়ে দেন। ( একদিন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সিলেকশনে গিয়েছিলাম। সিলেকশন শেষে নানা আলোচনার মধ্যে হঠাৎ করে মার্ক্সের পুঁজি গ্রন্থের কথা উঠলো। আমার এক অধ্যাপক বন্ধু বললেন, ‘ও সব এখন আউটডেটেড।’ আমি সবিনয়ে বললাম, বন্ধু তুমি পুঁজি বইএর এক পৃষ্ঠাও পড়েছ? যেহেতু, উপস্থিত সবাই আমাকে চেনে, তারা চুপ করে গেলেন, আমার বন্ধুটিও চুপ। কারণ তিনি জানেন, আমি ঐ বইএর অন্তত দু এক পৃষ্ঠা পড়েছি। এই হলো আমাদের কোন বিষয়ে মন্তব্য করার ধরণ।) তাই অনেকেই সমাজতন্ত্র এই মতবাদ এখন মৃত এটা বলে দেন অবলীলায়। কিন্তু, যারা পুঁজিবাদের মূল তাত্বিক তারা কিন্তু প্রতিদিন গভীর মনোযোগ দিয়ে মার্ক্সের পুঁজি গ্রন্থ বা অন্যান্য বই অনুশীলন করেন। শুধু তাই নয়, বিগত শতাব্দীতে মার্ক্সবাদের পক্ষে, নিও মার্ক্সিজমের নামে বা মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ পৃষ্ঠা খরচ হয়েছে। তারপরও এ বিতর্ক সমাধানহীন ভাবে চলছে। কারণ সহজ, সমাজ ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা নয়, যে একদল জিতে যাবে। সমাজের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত যে সংকট রয়েছে তার সমাধান প্রয়োজন।সেজন্য এটা অত্যন্ত প্রাসংগিক যে কি করিতে হইবে। মার্ক্সের সেই বিখ্যাত কথা, দার্শনিকরা পৃথিবীকে ব্যখ্যা করেছেন, কিন্তু প্রয়োজন তাকে পরিবর্তন করা। তাই এই পরিবর্তনটা কি করে হবে। সেখানেই সমাজ বিপ্লবের কথা আসে। কিভাবে সে বিপ্লব হবে? তার তত্ব কি? ব্যবহারিক প্রয়োগ কি? আর বিপ্লব হলেই তো হল না, তাকে রক্ষা কি করে হবে? সমাজ বিপ্লব তো মানুষের জীবন সংকটের হাত থেকে উত্তরণের জন্যে। সেই উত্তরনের পথটা কি? এই উত্তরণের সময়কালটায়, সামাজিক শক্তি বলি আর রাজনৈতিক শক্তি বলি তার রূপ কি হবে। রুশ বিপ্লব হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যা তৈরি হয়েছিল তা বিলুপ্ত হয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে ওই রাস্তা ভুল না ঠিক। তা ছাড়া সমাজ স্থির নেই। পুঁজিবাদও একজায়গায় দাঁড়িয়ে নাই। এই পরিবর্তনগুলোই বা কি এই অসংখ্য প্রশ্ন আজ আলোচিত হতে হবেই। তাই বিতর্কের গভীরতা অত্যন্ত প্রাসংগিক। প্রযুক্তির বিবর্তনে এই সামাজিক মাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রসংগ এজন্য তুললাম, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর এই মৌলিক বিষয়গুলোকে পাঠ্যবিষয় হিসেবে রাখছেন না। আজ যখন দেখি, অর্থনীতিতে রাজনৈতিক অর্থনীতি পড়ানো হয় না, এমনকি নানান তত্বের আড়ালে ‘মূল্যতত্বে’ র মৌলিক বিষয়গুলোকে ছাত্রদের পড়ানো হয়না। মার্ক্সের তত্ব না পড়িয়ে মার্ক্সীয় তত্বের সমালোচনা পড়ানো হয় বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্র কি তার মূল বিষয় থাকে না। সমাজবিজ্ঞানে সামাজিক সমস্যার ডিসকোর্স অনুপস্থিত, তখন মনে হয়, আমরা কি করছি। তেমনি রাজনৈতিক অংগনে পড়াশোনা অনুপস্থিত শুধু নয়, যারা পড়াশোনার কথা বলবে তারা অপাংতেয়। মাথা আর প্রয়োজন নেই হাত আর হাতিয়ার হলেই যেন সব

হয়ে যাবে। তার অর্থ এই সমাজের সংকট উত্তরণের জন্য মৌলিক জ্ঞানের আর প্রয়োজন নেই। এমনকি বিজ্ঞানের মৌলিক জ্ঞানেরও যেন প্রয়োজন ফুরিয়েছে, শুধু প্রযুক্তি এবং তার ব্যবহার জানলেই হবে। সেজন্যই আজকাল পত্রিকায় লেখা বের হয় ফরমায়েশি, সামাজিক মাধ্যমে শুধু গালাগালি। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল শিক্ষাতেই আজ সংকট। এই সংকট যত তাড়াতাড়ি আমরা বুঝবো, তত তাড়াতাড়ি এই সংকট উত্তরণের রাস্তা আমরা পাব। খন্ড খন্ড নয়, সামগ্রিক এই বুঝটা আজ জরুরি।

প্রকৃতি-বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান

যারা পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র তাঁদের ‘Principle of Least Action’ জানতেই হয়। কিন্তু এই জানাটা যদি শুধু মুখস্ত হয় তাহলে কিছুই হবে না। সংক্ষেপে বললে এটা কিভাবে বলা যায়? যদি কোন বস্তু কোন বলের অধীনে থাকে তাহলে আদি অবস্থান থেকে শেষ অবস্থানে যেতে সে এমন একটা পথ বেছে নেবে যে পথে  ঐ বস্তুর সময়ভিত্তিক গড় গতিশক্তি বিয়োগ সময় ভিত্তিক স্থিতিশক্তি হবে ন্যূনতম। ইংরেজীতে বললে বলা যায়, The path will result in the minimum of : time average Kinetic energy-time average Potential Energy. আদি সময় থেকে শেষ সময় পর্যন্ত যদি এর গাণিতিক যোগ করা হয় পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলে ‘action’ বাংলায় বলা যায় ‘ক্রিয়া’। এই ‘ন্যুনতম ক্রিয়ার নীতি’ পদার্থবিজ্ঞানের অমিত প্রভাববিস্তারকারী তত্ব। এর সঙ্গে আর যে কথাটা যুক্ত করা যায় যা ‘কোয়ান্টাম গতিবিদ্যা’র সাথে সংগতিপূর্ণ তাহলো বস্তুর এই আদি অবস্থান থেকে শেষ অবস্থানে যাবার সব রাস্তায় চলার সম্ভাবনা আছে। রাস্তাটা সরলরৈখিক নয়, ন্যুনতম। এখানে দু’টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, (এক) আদি অবস্থান থেকে শেষ অবস্থানে যাবার সম্ভাব্য সব রাস্তাই খোলা। (দুই) প্রকৃতি সেই রাস্তায় যাওয়াটাই চাইবে, যেখানে ‘ক্রিয়া’ হবে ন্যূনতম।

একটু সমাজবিজ্ঞানের দিকে তাকানো যাক। যারা কার্ল মার্ক্সের ‘গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা প্রসংগে’ পুস্তিকাটির সঙ্গে পরিচিতি আছে তাঁদেরকে মার্ক্সের একটি বাক্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে পারি। তিনি বলেছেন, ‘ “Between capitalist and communist society there lies the period of the revolutionary transformation of the one into the other. Corresponding to this is also a political transition period in which the state can be nothing but the revolutionary dictatorship of the proletariat.” –Karl Marx, Critique of the Gotha Program

Principle of Least Action এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাক। পুঁজিবাদ যদি আদি অবস্থান হয় এবং সাম্যবাদ যদি শেষ অবস্থান হয়, তাহলে সেখানে পৌঁছানোর পথ কি। মার্ক্স এই Least action এর কথা বলেছেন তা হবে The  revolutionary dictatorship of the proletariat । তাঁর অর্থ কি এই যে এই পথ ভিন্ন অন্য পথে যাওয়া যাবে না? প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী অনেক সম্ভাব্য পথ থাকতে পারে। লেনিন বিবর্তনবাদের বিপরীতে  বিপ্লবী পথের যাওয়ার যৌক্তিকতা বোঝাতে যেয়ে বলেছিলেন, বিপ্লবী রাস্তাটা হলো ন্যূনতম ‘ক্রিয়া পথ’ যে পথে সবচাইতে কম ক্ষতির মধ্য দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, যদিও এই আত্মত্যাগ আর ক্ষতির পরিমাণটা আপেক্ষিক, সরলরৈখিক কম নয়, ন্যূনতম। আজ পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদ বা বৈষম্যহীণ সাম্যবাদী সমাজে পৌঁছানোর রাস্তা বা মডেল নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে এবং হবে। সেই বিতর্ক বন্ধের জন্য নয়, সেই বিতর্ককে মনে করছি অত্যন্ত আবশ্যক। কারণ, প্রকৃতির কোন পথ বা সমীকরণ বের করার জন্য যেমন, Integral of Least Action  সমাধান করতে হয়, সমাজ প্রগতি বা অগ্রগতির জন্যও এই ‘ইন্টিগ্র্যাল সমাধান করতে হয়। সম্ভবতঃ এটাই  বিপ্লবী নেতা ও কর্মীদের অন্যতম প্রধান কাজ। সোভিয়েত মডেল, না চীনা মডেল, না ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকার মডেল, কোনটা হবে সেই রাস্তা? নাকি প্রত্যেকটি দেশের নির্দিষ্ট বাস্তবতায় ন্যুনতম ‘ক্রিয়া’ পথ বের করতে হবে এটাই আজ গবেষণা এবং নির্ধারণের বিষয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিরিখে গন্তব্য নির্ধারিত। সাম্যবাদী সমাজে পৌঁছাতে হবেই।  প্রয়োজন পথ নির্ধারণ ও অনুসরন। এটা প্রকৃতিবিজ্ঞানের মত অংকের হিসেবে নাও মিলতে পারে কিন্তু, দার্শনিক চিন্তায় সমার্থক হতে পারে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের এই আবিষ্কার মার্ক্সবাদের সবচাইতে বড় অবদান আর তাকে বাস্তব প্রয়োগের রাস্তায় অবিস্মরণীয় অবদান লেনিনের ‘রুশ বিপ্লব’। তার ব্যর্থতা সার্থকতার হিসেব আলাদা। পথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা মাইলফলক।

                                                                                                

চলে গেলেন প্রিয় বন্ধু সহযোদ্ধা কমরেড সাইদ, সবার ‘সাইদ ভাই’

 

২২ আগষ্ট, ২০২১ সাল, ভোর প্রায় সাড়ে পাঁচটা, চলে গেলেন খুলনার প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা, কৃষক- শ্রমিকের প্রানপ্রিয় বন্ধু, খুলনার প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, সাবেক সংসদ সদস্য, দিঘলিয়া হাইস্কুলের প্রথিতযশা শিক্ষক কমরেড সাইদুর রহমান। রেখে গেলেন অসংখ্য সংগ্রামের স্মৃতি আর স্বাক্ষর, অশ্রুশিক্ত হাজার হাজার গুণগ্রাহী মানুষ ও কমরেডদের। কিছুদিন আগে তাঁর বহু সংগ্রামের সাথী, সহধর্মিনী আমদের ছেড়ে চলে গেছেন। সেদিন অশ্রুভারাক্রান্ত কন্ঠে বলেছিলেন, দাদা, আপনার ভাবী চলে গেলেন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে।‘  কারণ কিছুদিন আগেই কমরেড সাইদের ‘ওপেন হার্ট’ সার্জারি হয়েছিল। ভাবী প্রাণান্ত চেষ্টায় তাকে সারিয়ে তুলেছিলেন। পুত্র কন্যারা বড় হয়ে গেছে। ভাইপো, ভাইঝি, ভাই ভাবি নিয়ে তবুও তাঁর বড় সংসার। আর ছিল সহযোদ্ধা কমরেডরা। ব্যক্তিজীবনের একাকীত্ব তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের পার্টির অভিভাবক। কিংবদন্তির শ্রমিক নেতা কমরেড হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি খুলনা জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘকাল পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছিলেন। নবম কংগ্রেসে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ছিলেন জাতীয় কৃষক সমিতির সহসভাপতি।

তিনি ছিলেন খুলনার ভূমিপুত্র। ছাত্রজীবন থেকে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। খুলনার বি এল কলেজ বৃটিশ আমল থেকেই প্রগতিশীল আন্দোলনের সূতিকাগার। কমরেড সাইদের জন্মস্থান ছিল এই বি  এল কলেজের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদীর অপর পাড়ে। প্রাকৃতিক কারণেই এই এলাকা ছিল সকল আন্দোলনের ‘পশ্চাদভূমি’। কিংবদন্তীর কমিউনিস্ট নেতা কমরেড নজরুল ইসলামের হাত ধরে তিনি পার্টিতে আসেন। তাঁর বড় ভাই ছিলেন কমরেড নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ট বন্ধু। তখন দৌলতপুর, খালিশপুর, দিঘলিয়া, আটরা, পাশে ডুমুরিয়া, ফুলতলা ছিল বামপন্থী আন্দোলনের লাল দূর্গ। কমরেড সাইদ এই পরিবেশেই গড়ে উঠেছিলেন। ভৈরব নদীয় দুই পার্শ্বে গড়ে ওঠা জুটপ্রেস, জুট্মিল শ্রমিকদের আন্দোলনের সূতিকাগার। দিঘলিয়া থেকে শুরু করে নড়াইল জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত কৃষক এলাকা ছিল কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভিত্তিভূমি।

কমরেড সাইদ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বড় ভাই ভাবিসহ গোটা পরিবারই ছিল প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রতি সহমর্মী। তাঁর ভাই ভাবিসহ গোটা পরিবার  সারাজীবন তাঁর আন্দোলন সংগ্রামের পাশে থেকেছেন।

তিনি দীঘলিয়া হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এবং ‘সাইদ মাস্টার’ হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন ছাত্রদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। তাঁর অনেক ছাত্র ছাত্রী পরবর্তী জীবনে বহু উচ্চপদে গেছেন। তারাও তাকে শ্রদ্ধা করতেন। এত বড় রাজনৈতিক নেতা হওয়া সত্বেও তাঁর শিক্ষক পরিচিতি কখনো ম্লান হয়নি। এ এক অনন্য উদাহরণযোগ্য এবং অর্থবহ ঘটনা।

তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন আমার সমবয়সী, ঘনিষ্ট বন্ধু। আজ তাই বহু স্মৃতি ভীড় করে আসছে। কখনো কখনো কলম  থেমে যায় স্মৃতির ভারে। আমি ১৯৭৫ সালের শেষদিকে রাজশাহী জেলা থেকে এসে পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে খুলনা অঞ্চলে কাজ শুরু করি।  দৌলতপুর জুটপ্রেস এলাকা এবং  দিঘলিয়া ছিল আমার পার্টি ও সংগঠন গড়ে তোলার মূল ক্ষেত্র। তখন জুটপ্রেস নেতা প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা ধলা মিয়া, মজিবর রহমান, আয়ুব আলী, হাকিম, আনসার আলী, আলাউদ্দিন সিং, হোসেন আলী এরা সবাই ছিলেন শ্রমজীবি মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা নেতা। কমরেড আয়ুব আলী বলতেন, ‘ কমরেড, পাটের বোঝা মাথায় তুললে সমাজতন্ত্র পেটে চলে আসে, ফেললে তখন মাথায় আসে।‘  গভীর দার্শনিক উক্তি। কমরেড সাইদ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েও এই শ্রমিক নেতাদের সহযোদ্ধা ও নেতা হয়ে ওঠেন। আমি প্রায় অলৌকিকভাবে এদের পরিবারের অংশ হয়ে গিয়েছিলাম। একযুগের বেশী সময় এদের সহযোদ্ধা হিসেবে  থেকে পার্টির কাজে অন্যত্র চলে গেছি, কিন্তু এরা আমাকে ভোলেনি। আজ কমরেড সাইদের মৃত্যুর খবরটা আমাকেই প্রথম দিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন তাঁর মেয়ে টেলিফোন করে বলছিলো, ‘কাকু, আব্বু ভালো করে কথা বলতে পারছে না। আপনাকে টেলিফোন করতে বলছে তাঁর অবস্থা জানানোর জন্যে’। আজ তিনি চলে গেলেন। আমি শুধু তাঁর সহযোদ্ধা ছিলাম না , ছিলাম তাঁর পরিবারের অংশ।

তিনি আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জননেতা  হয়ে ওঠেন। তিনি বারবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সংসদ সদস্য হয়েছেন। তাঁর সংসদ নির্বাচনে আমি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক ছিলাম। সেই নির্বাচনী লড়াইএর কঠিন সময় আমরা বহু  বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি সাধারণ মানুষের  মধ্যে।

তিনি ১৯৮০ সালে পার্টির খুলনা জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। আমি তখন পার্টির জেলা কমিটির সম্পাদক। আমরা সমবয়সী হলেও কোন আচরণেই তিনি পার্টির শৃংখলার বাইরে ব্যবহার করেননি।  আমৃত্যু তিনি আমাকে ‘নেতা’ মেনেছেন। এ এক অসাধারণ পার্টি চেতনা। তিনি পার্টির বহু কঠিন সময়ে তাঁর দৃঢ় এবং স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে  অবস্থান নিয়েছেন। তিনি  সারাজীবন পার্টির আভ্যন্তরীণ কোন দ্বন্দ, ব্যক্তিগত ভালোলাগাকে প্রশ্রয় দেননি। সেজন্যেই কংগ্রেস তাকে সর্বস্মমতিক্রমে ‘কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যান’ নির্বাচিত করেন। সকল কমরেডদের অধিকার তাঁর হাতে সুরক্ষিত ছিল।

ব্যক্তিগত ভাবে তিনি ছিলেন অসম্ভব সাহসী মানুষ। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৭৮-’৭৯ সালে জুটপ্রেস শ্রমিকদের আন্দোলনের সময় এক শ্রমিক জনসভায় মালিকদের গুন্ডারা  লাঠিসোঠা নিয়ে আক্রমন  করে। সেই জনসভার বক্তৃতা মঞ্চে ছিলেন কমরেড নজরুল ইসলাম, কমরেড কামরুজ্জান লিচু, কমরেড হাফিজুর রহমান, ধলা মিয়া, মজিবর রহমান সহ শ্রমিক নেতারা। আমিও মঞ্চে ছিলাম পার্টির জেলা নেতা হিসেবে। গুন্ডাদের উদ্দেশ্য ছিল নেতাদের আক্রমন করা এবং জনসভা ভেংগে দেওয়া। সেদিন কমরেড সাইদ লাঠি হাতে শ্রমিকদের নিয়ে রুখে দিয়েছিলেন সে আক্রমণ। পরবর্তী জীবনে বহুবার জীবন সংকট করেও তিনি এ ধরণের লড়াইএ অংশ নিয়েছেন।

কমরেড সাইদ কোনদিন শ্রমজীবি কৃষক-শ্রমিক আর পার্টির সংগ্রাম থেকে সরে দাঁড়াননি, ছেড়ে যাননি হাজার প্রতিকূলতা সত্বেও।  থেকেছেন অভিভাবক হয়ে। আজো তাঁর প্রয়োজন ছিল সবচাইতে বেশী, কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলেন বহু সংগ্রাম আর লড়াইএর স্বাক্ষর। জীবন যায়, জীবন আসে, কিন্তু তাকে অর্থবহ করে রাখে এই এগিয়ে চলার সংগ্রামী ইতিহাস। কমরেড সাইদ লাল সালাম। আপনার পতাকা বহন করবে আপনার উত্তরসূরিরা যারা দেখেছে আপনাকে লড়াইএ ময়দানে।

(৪)

 বিজ্ঞান ও দর্শন

 

আমার কিছু তরুণ বিজ্ঞানী বন্ধুরা দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ইনস্টিটিউট করার বিষয়ে তাঁদের উদ্যোগের কথা বলছেন। তাঁদের এই উদ্যোগের বিষয় নিয়ে একধরণের ভালো লাগার অনুভূতি  এবং কিছুটা অভ্যাস বশেই  Philip D Mannheim এর লেখা একটি আর্টিকেল ‘ Mass Generation, the Cosmological Constant Problem, Conformal Symmetry and the Higgs Boson’ পড়ছিলাম। আর্টিকেলটা লেখা ২০১৭ সালে। ২০১২ সালে পদার্থবিজ্ঞানীদের বহু প্রতীক্ষিত Higgs Boson আবিষ্কারের পর থেকেই  Standard Model এবং Higgs Mechanism এর উপর পৃথিবীব্যাপী নতুন করে বহু প্রবন্ধ লেখা হয় বিজ্ঞান জার্নালগুলোতে। ১৯৬৪ সালে F E Englert, Peter Higgs এবং Robert Brout এর বস্তুর ভর সৃষ্টি সংক্রান্ত রহস্য ভেদে এই Higgs Mechanism এর তাত্বিক প্রস্তাব দেবার পর থেকেই এই  ভর সৃষ্টির প্রস্তাবিত আদিকণা Higgs Boson এর বাস্তব অস্তিত্ব পরীক্ষাগারে পাওয়া নিয়ে শুরু হয় বিশ্বব্যাপী এক মহাউদ্যোগ। আর তাঁরই ফলশ্রুতিতে গঠিত Large Hadron Collider ( LHC ) ২০১২ সালে সেই অসাধ্য সাধনটি করে। যা আগেই বলা হয়েছে। এর ফলে Standard Model এর মাথায় আর একটি সাফল্যের পালক যুক্ত হয়েছে। কিন্তু যাত্রা থামেনি, বরং জমা হয়েছে আরোও বড় চ্যালেঞ্জ। যাত্রা চলেছে Theory of Everything আবিষ্কারের পথে। প্রসংগটি তোলার কারণ পদার্থবিজ্ঞানের এই জটিল তত্ব আলোচনার জন্যে নয়। সেটার স্থানও এটা নয়। কারণ হলো কিছু দার্শনিক বিষয় নিয়ে তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টি আকর্ষণ। বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী Stephen Hawkings ২০১০ সালে বলেছিলেন, ‘ Philosophy is dead. …. Scientists rather than Philosophers have become bearers of the torch of discovery in our quest for knowledge’. এ বক্তব্য  নিয়ে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে শুধু নয় সাধারণ বিদ্বজ্জনের মধ্যেও প্রচুর আলোচনা আছে। তা চলতেই থাকবে। আমার শুধু বলার বিষয় এক বিজ্ঞানের এই সকল আবিস্কার মানুষের চিন্তা বা বোধকে কতটুকু এগিয়ে নিচ্ছে? এখানে দর্শনের ভূমিকা আছে কি নেই। দুই বিজ্ঞানের এই প্রবহমান সত্য অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই কি দর্শনের সার্বিক দৃষ্টি বা বোধকে সমৃদ্ধ করে না। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞান বোঝার ক্ষেত্রেও রয়েছে অনেক দার্শনিক দ্বন্দ, যা এখনও নিরসিত নয়। যেমন  কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার ব্যাখ্যা বা পর্যবেক্ষণ ও বস্তুর পর্যবেক্ষণ নিরপেক্ষ অস্তিত্বের প্রশ্নেও রয়েছে অনেক   বড় বড় বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ। তাই, দর্শনকে বিদায় না জানিয়ে বিজ্ঞানকে দার্শনিক দৃষ্টিভংগীর ভিত্তি করার নিরন্তর প্রয়াসই বোধহয় প্রয়োজন। প্রসংগক্রমে আর একটি বিষয় অবতারণা হতেই পারে। বস্তুবাদ আর ভাববাদের দ্বন্দবিরোধে না যেয়ে যারা বস্তুবাদী দার্শনিক বা আরও সুস্পষ্টভাবে বললে যারা দ্বান্দিক বস্তুবাদী তাঁদের পদার্থবিজ্ঞানের এই অতি বিখ্যাত Higgs Mechanism এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিসাম্য বা Symmetry  ও প্রতিসাম্য ভংগ বা Symmetry breaking সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবার  জন্য বলি। কারণ, দ্বান্দিকতার মৌলিক বৈশিষ্টগুলি যা হেগেল হয়ে মার্ক্স ও এঙ্গেলস এর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সঙ্গে সংগে যে আরও কার্যকর ভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, এই বিষয়ে মনোযোগ নেই বললেই চলে। বিজ্ঞানে বিবিধ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে  Unity in opposites, Transition from quantity to quality, Negation of Negation  ইত্যাদি আরও জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরাও উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখেন, আর যারা দর্শনের চর্চা করেন, তাঁরাও  এ বিষয়গুলোকে আরও গভীরভাবে নিতে চান না। এ প্রসংগে আমি মনে করি, Symmetry ও   Symmetry breaking এই বৈজ্ঞানিক প্রতিপাদ্য দু’টি অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে দ্বান্দিক বস্তুবাদের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি মনে  করি এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন। এমনই আরও প্রচুর বিষয় যা প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান উভয়ের ক্ষেত্রেই অপরিহার্য। তাই আমার কিছু তরুণ বিজ্ঞানী বন্ধুরা যখন দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ইনস্টিউট  করতে চান তাঁদের কাছে অনুরোধ বিজ্ঞানী Stephen Hawking যতই বলুন ‘Philosophy is dead’. দর্শনকে বাদ দিয়ে সমাজও এগোয়না বিজ্ঞানও এগোয়না ।  তিনি নিজেও বহু গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক বিষয়ে মন্তব্য রেখেছেন এবং তা বিজ্ঞানসিদ্ধভাবে, যা   দিক-নির্দেশক। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এখন দর্শনকে বিজ্ঞানের সঙ্গে এবং বিজ্ঞানকে দর্শনের সঙ্গে যুক্ত করে লেখাপড়া শূন্যের কোঠায়। গবেষণা তো দূরে থাক। তাই যারা এই উদ্যোগ নিচ্ছেন তাঁরা   এই ইনস্টিউটে দর্শন ও বিজ্ঞানের অন্তঃসম্পর্কের উপর গভীর গবেষণার বিষয়টি যেন বিবেচনায় রাখেন।

দু;খের বিষয় দর্শনের বহু  গুরুত্বপুর্ণ বিষয়কে ‘তথাকথিত’ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত করে এর সমৃদ্ধ  দার্শনিক মৌলিকতা উপেক্ষা করা হয়েছে, ফলে তা বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রেও যে মৌলিক অবদান রাখতে পারে তা মনে করা হয়নি। বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারই তাৎক্ষনিক ভুল দর্শনকে আঘাত না করে  এগোয়নি।  এটা ঠিক যে কোন দার্শনিক দৃষ্টিভংগী সামাজিক নির্দিষ্ট চেতনার সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞানকে অনেক ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ হিসেবে চিন্তা করা হয়, কিন্তু বিজ্ঞান থেকে উদ্ভূত চিন্তাকে গ্রহণ করা  হয় না। এর উদাহরণ অসংখ্য রয়েছে আমাদের চারপাশে।

 

জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা – ২০২১ শিক্ষার্থীদের কতটুকু সহায়ক হবে?

 

                                                                                                                (১)

 

প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা – ২০২১ দেরীতে হলেও কিছুটা আলোচনায় আসছে। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা ও শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে আমার একটা ঔৎসূক্য রয়েছে,রয়েছে একধরণের উদ্বেগ। কোন বিশেষজ্ঞের তকমা বা দাবী থেকে নয়, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কিছু কথা তুলতে চাই। যদি সোজা সাপটা বলতে হয়, তাহলে বলবো,  এই প্রস্তাবিত কারিকুলামকে আত্মঘাতি প্রস্তাবনা মনে করি।

 

প্রথমে আমি আমার কিছুটা  ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি ১৯৬৭ সালে অজগ্রামের একস্কুল থেকে এস এস সি পাশ করেছি মানবিক বিভাগ নিয়ে। কারণ আমার স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ ছিল না ( এই অবস্থা অতটা না হলেও এখনও দেশে বিদ্যমান)। আমি অর্থনীতি, পৌরনীতি, ইতিহাস পড়েছিলাম। উচ্চতর গণিত নিতে পারিনি, কারণ স্কুলে বি এস সি শিক্ষক ছিলেন না। এত বিপত্তির কারণ কি? সেটা লিখতে গেলে অনেক ব্যক্তিগত কথা লিখতে হবে। তা বিব্রতকর। তবে হিউম্যানিটিজ বা মানবিক  গ্রুপে ভালো রেজাল্ট করার ফলে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর সাঈদুর রহমান খান নিজে উদ্যোগ নিয়ে আমার বাবাকে বলে আমাকে রাজশাহী সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করান। এই উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন কারণ তিনি আমার বাবার ছাত্র ছিলেন, ওই এলাকার ছেলে এবং ঐ স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পড়ে অন্য স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছিলেন। আমি না থাকলে যেহেতু স্কুল সেবারে হাই স্কুল হতে পারবে না, সেহেতু আমাকে থাকতে হয়েছিল। যাহোক, বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবার পর আমার লড়াই শুরু হলো। আমি বুঝেছিলাম এস এস সি তে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকলে, উচ্চতর গণিত না থাকলে এইচ এস সি তে পড়া কি কঠিন। যদিও শেষ পর্যন্ত আমি এইচ এস সি তে বোর্ডএ  ৮ম স্থান পেয়েছিলাম, ১ম স্থান অধিকারের জন্য যে কয়েকটি মার্কের প্রয়োজন ছিল তার ঘাটতি হয়েছিল রসায়নে ১ম কোর্সে অন্তত ২০ মার্ক কম পাবার জন্য। আর তা হয়েছিল এস এস সি তে রসায়ন না থাকার ফলে। তারপরও আমি লড়াই করেছিলাম এক প্রচন্ড জেদ থেকে। তবুও আমি জানি সে লড়াইটা কি ছিল। যতদূর মনে আছে মানবিক বিভাগ থেকে এসে এইচ এস সি তে আমি ছাড়া আর কেউ বোর্ডে স্থান পায়নি। আদৌ আমার মত মানবিক বিভাগ থেকে পাশ করে আর বাংলাদেশে কেউ এইচ এস সি তে বোর্ডে স্থান করতে  পেরেছেন কিনা জানি না। তারপর আবার পদার্থবিজ্ঞান এ পড়তে গেছেন কি না তাও জানি না।অংকে অত্যন্ত ভালো হওয়া সত্বেও পদার্থবিজ্ঞান পড়তে যেয়ে আমাকে সারাজীবন লড়াই করতে হয়েছে ঐ গ্যাপটার জন্য। যদিও জেদ করে আমি তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞান  পড়েছিলাম। তারপর দীর্ঘদিন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে দেখেছি আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অপ্রতুল অংক ও বিজ্ঞানের জ্ঞান কি অসুবিধা করে। যে চারজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছ, তাদের  ৩ জন আমার ঘনিষ্ট বন্ধু এবং শ্রদ্ধেয়। আর একজন শিক্ষকপ্রতীম। বহুবার তাদের সংগে আমার আলাপ হয়েছে। সারাজীবন তাদের সংগে প্রধান কোন বিষয়েই অমিল হয়নি। আজ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাদের সংগে আমার দ্বিমত হলো। আমি এই কারিকুলামকে সঠিক মনে করি না।এটা কার্যকর করার ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে দেশের বিজ্ঞান পড়া শুধু নয়, শিক্ষাব্যবস্থা তলিয়ে যেতে পারে। আমি পৃথিবীর প্রধান প্রধান দেশের কারিকুলাম দেখেছি অতি সম্প্রতি। বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোতে যে কাঠামোতে পড়ানো হয়, আমাদের এই প্রস্তাবনার দৃষ্টিভংগী বা বিষয়বস্তু কোনটাই মেলে না। আমাকে কিছু ব্যক্তিগত কথা বলতে হলো বলে সবার কাছে আমি মাফ চেয়ে নিচ্ছি। আমি যে ভুক্তভোগী।

 

                                                                                                                (২)

 

প্রস্তাবিত মাধ্যমিক কারিকুলাম নিয়ে পত্র পত্রিকা এবং সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে। আমার মতামত সংক্ষেপে হলেও সামাজিক মাধ্যমে এর আগেও উল্লেখ করেছি। যেহেতু  বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুনছি দ্রুতই নাকি একটি ওয়ার্কশপ করে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাই বিবেকের তাড়নাতেই নিজের আরও কিছু মতামত দিচ্ছি। জানি হয়ত কোথাও গুরুত্ব পাবে না। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটা বড় বিতর্ক রয়েছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে সামাজিকরণের উপর জোর দিতে হবে, নাকি বিশেষায়িতকরণের দিকে জোর দিতে হবে। বিপত্তিটা এখানেই। সময়ের সংগে সংগে এই বিষয়গুলো পালটায়। একটা উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে, একজন মানুষ বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিষ্কার বা সত্যগুলো না জেনে কি তার সামাজিক বোধকে উন্নত করতে পারে? বিজ্ঞানের সত্য আর সেই সময়ে সামাজিক চেতনা সব সময় একই পর্যায়ে থাকে না। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। এ বিষয়ে  কোপার্নিকাস,  গ্যালিলিও থেকে শুরু করে ইতিহাসের অনেক উদাহরণ আছে। আমাদের শিক্ষার কারিকুলামে অনেক কিছু আছে যা বিজ্ঞানবিরোধী আমরা কি তা পড়তে থাকবো না পড়বো? আবার আমাদের অনেকে বিজ্ঞান পড়েন অথচ তিনি দার্শনিক চিন্তায় বিজ্ঞানকে মানেন না। তাহলে এই বিজ্ঞান কোন কাজে লাগবে? প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। একজন ভালো প্রযুক্তিবিদ হলেই তিনি বৈজ্ঞানিক চিন্তায় উন্নীত মানুষ হবেন তা নয়। যাহোক, শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের একটি। একে বলা যেতে পারে transitional phase. প্রকৃতির মত এখানেও অতিরিক্ত সুপ্তশক্তি ( latent heat)  দিতে হবে। এখানে কোন ধরণের ভারসাম্যহীনতা ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যত জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আমার মনে হয় ব্যক্তিগত রেষারেষি বাদ দিয়ে গভীরভাবে ও সুচিন্তিতভাবে বিষয়টি আলোচনায় আসতে হবে। আমি তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও বলবো তাড়াহুড়ো না করে আরো ব্যাপকভাবে আলোচনায় আনুন । 

যে ১০ টি বিষয় প্রস্তাব করা হয়েছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। আমার সুনির্দিষ্ট মত, বাংলা, ইংরেজি, অংকসহ কয়েকটি কোর কোর্স থাকা উচিত। বাকীগুলো বিজ্ঞানে অর্থাৎ  পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিত এদের আলাদা কোর্স করে তেমনি মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানএর আলাদা কোর্সগুলো করা উচিত।  এখানে একটা বিষয় করা যেতে পারে তাহলো যারা বিজ্ঞানের কোর্সগুলোকে নেবে তাদের অবশ্যই একটি সমাজবিজ্ঞান এর ইন্টিগ্রেটেড কোর্স নিতে হবে এবং যারা মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানের কোর্স পড়বেন তাদেরকে একটি ইন্টিগ্রটেড বিজ্ঞান কোর্স নিতে হবে। অন্যান্য কোর্সগুলোকে ঐচ্ছিক করতে হবে, কেউ ইচ্ছে করলে তা নিতে পারে। তথ্য প্রযুক্তির বিষয়কে বেশী গুরুত্ব দিতে চাইলে তা এর মধ্যে আনা যেতে পারে। কারিগরি শিক্ষাকে একটি সমান্তরাল ও গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে এর সংগে যুক্ত করতে হবে। আসলে বর্তমান বাস্তবতায় বিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞান সবাইকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই কারিকুলাম করতে হবে। তবে  সবাইকে মিলিয়ে স্যালাইন বানানোটা উচিত হবে না। ধারাবাহিকতাও  একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্যবিষয়।

 

 তাছাড়া আসল চ্যালেঞ্জ হলো বইগুলো কিভাবে লিখতে হবে এবং শিক্ষণ পদ্ধতিটা কতটা বৈজ্ঞানিক ও সৃজনধর্মী হবে। মডেল বইগুলো তৈরি করার আগে পদ্ধতি বা কাঠামো গত পরিবর্তন মারাত্মক হতে পারে। 

 

 আমার মনে হয় অনেকেই বিষয়টি গভীরে যেতে পারেননি, যাবার সময় পাননি । অনেকে জানেনই না কি হচ্ছে। এর আলোচনার মধ্যে আমার অনেক বন্ধু, ছাত্রপ্রতীম এবং ছাত্ররাও দেখছি। সবাইকে অনুরোধ করবো, ব্যক্তিগত আক্রমণ না করে মতামতের গুরুত্বকে মূল্য দিন। আমি মনে করি প্রস্তাবিত কারিকুলাম প্রয়োজনকে মিটাচ্ছে না। এটা ক্ষতিকর হতে পারে। তাড়াহুড়ো করে কোন জিনিস অন্তত শিক্ষায় আনা ঠিক নয়। কারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন জিনিসের ফলাফল দীর্ঘমেয়াদি হয়।

 

                                                                                                            (৩)

 

জীবনে কখনো হতাশ হবার কথা ভাবিনি, এখনো ভাবি না। কিন্তু আজ এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের দেশের বিজ্ঞজনেরা দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ভালো কিছু রেখে যাবার ব্যাপারে যথেষ্ট সংশ্লিষ্ট হচ্ছেন না।  আমি নাছোড়বান্দার মত  বলছি দেশের প্রস্তাবিত কারিকুলাম এর কথা। আমি কয়েকদিন গভীরভাবে পড়ার চেষ্টা করলাম, বোঝারও চেষ্টা করলাম। একটি বিষয় আমরা মোটামুটি জানি তাহলো একটি কারিকুলামে যে  দুটি জিনিস পরিস্কার থাকা দরকার তাহলো ছাত্র-ছাত্রীদের কি কি বিষয় পড়ানো হবে এবং কিভাবে তা পড়ানো দরকার। ভালো বিষয় পড়াতে চাইলাম, কিন্তু খারাপ ভাবে বা বলা উচিত অবৈজ্ঞানিকভাবে পড়ালাম তাতে উদ্দেশ্য বিফল হবে। উল্টোটাও সত্যি। খুবই সঠিক পদ্ধতিতে পড়ালাম বা শেখালাম, কিন্তু বিষয়গুলো যথাযথ নয়, তাহলেও তা কাজে দেবে না। ইংরেজিতে অনেক সময় বলা হয়, ‘,কোয়ালিটি এডুকেশন ‘ সেটা হলো এই দুটির সমন্বয়। প্রস্তাবিত কারিকুলাম যার নাম ‘ জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’ তাতে উপক্রমণিকা বাদে ১৯ টি অধ্যায় রয়েছে। রূপকল্প,অভিলক্ষয,  শিক্ষাক্রমের ধরন, যোগ্যতার ধারণা, মূল্যবোধ, শিখন-ক্ষেত্র, শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায় ও স্তরের উদ্দেশ্য  সহ ‘পেডাগজি’ র দৃষ্টিভঙ্গি গত বিষয়াদি রয়েছে। ১১ ও ১২ তম অধ্যায়ে নবম ও দশম শ্রেণীর জন্য ১০ টি শিখন ক্ষেত্র বলা হয়েছে।  ১৩ তম অধ্যায়ে বর্ণিত রয়েছে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে কিভাবে ছাত্র ছাত্রী বিষয় নির্বাচন করবে,সেগুলো।  সেখানেও পরিস্কার বলা হয়নি নির্দিষ্ট বিষয়গুলো কি কি । সেখানে আবশ্যিক, নৈর্বাচনিক ও প্রায়োগিক ( ঐচ্ছিক)  বিষয় নেবার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়গুলো কি, তাদের মান কোন মাত্রার হলে তা উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে, এই দু’ বছরে সেই কারিকুলাম ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষে ধারণযোগ্য কি না। এ ছাড়াও স্কুল এবং কলেজগুলোর মধ্যে মানগত যে  বৈষম্য রয়েছে, তারফলে উচ্চশিক্ষায় কোন এলাকার বা শ্রেণীর ছেলেমেয়েরাই সুযোগ পাবে, অন্যরা পাবে না, সে বিষয়ের উপর আলোকপাত নেই। 

তাছাড়া আমার মনে হয়েছে  ৯ম ও ১০ শ্রেণীতে যে ১০ টি শিখন বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, তার সাথে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর বিষয়গুলোর সমন্বয়  বা ধারাবাহিকতা কিভাবে থাকবে তারো কোন উল্লেখ বা রূপরেখা নেই। যে কেউ একটু গভীরে গেলেই বুঝতে পারবে আসলে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত বিষয়ের সংগে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর আসলে কোন সম্পর্ক নাই। এখানে পঠিত  অংক, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান কোনটাই পরবর্তী বিশেষায়ণের স্তরে খুব কাজে লাগবে না। যদি ধরেও নেই পড়ানোর পদ্ধতি, মূল্যায়নের পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে আমরা আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করছি ( যদিও এ ব্যাপারে বহুবিধ সংকট রয়েছে), তাহলেও যে বিষয়গুলো পড়ানোর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সিলেবাস তৈরি হবে, তাকে আমি কিছুতেই অগ্রগতি হিসেবে ধরতে পারছি না, বরং এটা বড় ধরণের পশ্চাদপসরণ। 

আমি বিজ্ঞজনদের কাছে আবেদন করছি, আপনারা যাদের জন্য কারিকুলাম করছেন অর্থাৎ ছাত্র-ছাত্রীরা, তাদের সংগেও কথা বলুন। শুনুন মানসিকভাবে তাদের উপলব্ধিটা কি। আমার প্রতিদিনই মনে হচ্ছে আমরা বড় ধরণের ভুলের দিকে যাচ্ছি। আমরা যতই বলি, তৃণমূল এ আমরা আলোচনা করছি, বহু বিশেষজ্ঞরা নিয়োজিত হয়েছেন, তবুও আমার মনে হয় সে সকল উদ্যোগে ‘ক্রিটিক্যাল বিশ্লেষণে’ র চেয়ে, যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে ধরণের মনোভাবই প্রধান ধারা হিসেবে রয়েছে। তাই আমার মনে হচ্ছে, 

আমরা স্পষ্টতঃই বিজ্ঞানের উচ্চ শিক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত তো করছিই, মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানকেও দিশাহীন ও ক্ষতিগ্রস্ত করছি। আমরা মুখে যত কথাই বলি না কেন, এই কারিকুলাম কোনভাবেই আমাদের দক্ষ জনশক্তি বা মানবিক মানুষ তৈরির জন্য যুগোপযোগী হচ্ছে বলে মনে করতে পারছি না। 

বিষয়গুলো শুধু বিমূর্তভাবে নয়,  নির্দিষ্ট সিলেবাস এবং তারভিত্তিতে পাইলট বই তৈরি করে এগুনো উচিত। যতদিন তা হচ্ছে না, কারিকুলাম পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে এগুনোর চেষ্টা ফলবতী হতে পারে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবশ্যই ভাবতে হবে তাহলো এ পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, তাদের বেতন কাঠামো, শহর এবং গ্রামের স্কুলের মধ্যে বৈষম্য নিরসনের প্রকল্প ও কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা এই কারিকুলামের সংগে কিভাবে সমন্বিত ও সম্পর্কিত হবে তা নির্দিষ্ট করা। তা না হলে ব্রেকহীন গাড়ির মত শিক্ষাব্যবস্থা গহীন খাদের দিকে চলে যেতে পারে।

সবশেষে এটা বলা উচিত, আমরা বড় গলা করে নতুন শিক্ষা রূপকল্পের কথা বলি, কিন্তু যখনই বাজেটের প্রশ্ন আসে, তখনই মান্ধাতা আমলের জিডিপির ২% এর বেশী বরাদ্দ করি না। শুধু কথায় চিড়ে ভিজবে না। 

বড় সমস্যা হলো আমাদের দেশের পত্রিকা বা গণমাধ্যমও এ ব্যাপারে একেবারে চুপ। কোন ক্রিটিক্যাল আলোচনা তারা ছাপবেন না। জানি না তারা সবাই এই রূপকল্পের ব্যাপারে কি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সবক্ষেত্রেই এক আশ্চর্য নিরবতা।

আমাদের শৈশব ও বর্তমান

আমাদের শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্য কোন কালেই জন্মদিন পালনের সুযোগ হয়নি।  আমাদের জন্মটা যে যুগে সে সময়, নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত কারোর ঘরেই এই রেওয়াজ ছিল না। একটু যারা সম্পন্ন তাদেরও যে হতো তা বলা যায় না, হলেও একেবারেই স্বল্প পরিসরে অন্য আংগিকে। কিন্তু যুগ  পাল্টালো। মধ্যবিত্ত এমন কি নিম্নবিত্তর ঘরেও ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালিত হতে শুরু হলো। কিন্তুইন্টারনেটহবার পর শুরু হলোভার্চুয়াল জন্মদিন গুগল সাহেব স্মরণ করিয়ে দেন, তারপর জন্মদিনের শুভেচ্ছা আসতে শুরু করে। প্রথম দিকে অনভ্যাসের অস্বস্তি হতো। এখন ভালো লাগে এই ভেবে যে, আমরা এই বয়সেও কিছুটা হলেও এখনো প্রাসঙ্গিক আছি। আমার সন্তানসম ছাত্রছাত্রীরা, রাজনীতির সব বয়সের সহকর্মীরা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় সবার কাছ থেকেই এই শুভেচ্ছা আসে। আমি সবাইকে আমার হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

 

আজ থেকে সত্তর বছর আগে মায়ের কোল ছাড়া কোন আশ্রয় ছিল না। আর আজ সত্তরতম জন্মদিনে পদ্মাসেতু পার হলাম। মা গত হয়েছেন প্রায় ৫০ বছর আগে। আমার জন্মস্থান পদ্মা আর যমুনার মিলনস্থলের পাশে। আশৈশব এই দুটি নদী আমদের মায়ের মত। এই দুটি নদী কখনো আমাদের আনন্দের উৎস ছিল, কখনো ছিল কীর্তিনাশার মত নিঃস্ব করে দেবার উৎস। এই আনন্দ বেদনা নিয়েই দুটি নদী  আমাদের কাছে চির প্রবহমান। আজ যখন পদ্মাসেতু দিয়ে পার হচ্ছিলাম, তখন আশৈশব বহু স্মৃতি ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে। পদ্মাসেতু নিয়ে উচ্ছাস আবেগ অনেক হয়েছে। সম্পর্কে কিছু বলাটাই এখন ক্লীশে হয়ে  যাবে। পদ্মাসেতু দেশের যেমন গৌরব এবং অর্জন, তেমনি এটা সামনের বেশ কয়েকবছরের জন্যরাজনীতি বটে। এটা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা পরে করার আশা রইলো। আজ প্রাসঙ্গিক কিছু কথা   বলার চেষ্টা করা যাক। দেশ বিদেশের অনেকেই আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। কিন্তু একটি শুভেচ্ছা ছিল ব্যতিক্রম। যিনি করেছেন তিনি আমার একসময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। তিনি যা লিখেছেন তার বাংলা বহু প্রচলিত একটি কথা,’রোম যখন পোড়ে, নীরো তখন বাঁশি বাজায়।অর্থটা কিন্তু খুবই স্পষ্ট। অর্থাৎ দেশে যখন অনেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে তখন জন্মদিনের শুভেচ্ছার মত অদিখ্যেতা কে আর কীইবা  বলা যায়? গত দুসপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে বাংলাদেশের উপর দিয়ে অশনি সংকেত বয়ে যাচ্ছে। সীতাকুন্ডের ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। অর্ধশত মানুষের নির্মম মৃত্যু, দ্বিশতাধিক মানুষের জীবম্মৃত হওয়ার  এক দুসঃসহ স্মৃতি। কিন্তু এর মধ্যে ২৫ জুন বহু প্রত্যাশিত পদ্মাসেতু উদ্বোধন ঘোষণা হয়েছে। স্বাভাবিক  প্রশ্ন ওঠে সীতাকুন্ডের ঘটনা কি দূর্ঘটনা না অন্য কিছু। তা জানা যায় নি সঠিকভাবে। কিন্তু তা নিয়ে কিঞ্চিত রাজনীতি হয়েছে। তারপর হয়েছে ট্রেনে অগ্নিকান্ড। এটা কি নাশকতা? পদ্মাসেতুর উদ্বোধন এগিয়ে আসছে। শুরু হলো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার। এক কোটিরও  বেশী মানূষ চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে  নিপতিত হলো।  বাংলাদেশের মানুষকে যে যাই বলুক অমানুষ বলা যাবে না। সরকারি উদ্যোগ কি হলো না হলো তা  নিয়ে রাজনীতি হবে, আলোচনা হবে, টানা পোড়েন হবে। কিন্তু মানুষ বসে  থাকলো না। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় লেগে গেল। জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে এই সিলেটে। ফলে এক উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটলো দিন। তারপর  দেখলাম শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক সহ চেনা রাজনীতির অনেকেই নেমেছে এই মানবিক বিপর্যয়কে রুখে দিতে। এখনো চলছে তা। কিন্তু পদ্মাসেতু উদ্বোধন হয়েছে এই বিপর্যয়ের মধ্যেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ আনন্দে উদ্বেল হয়েছে। মনে তো খটকা লাগেই। তারপরও  আলো আঁধারের এই জীবন চলছেই।

এর মধ্যে শুরু হলো আর এক বিপর্যয়(?) নড়াইলের এক কলেজের শিক্ষক এবং ভারপাপ্ত অধ্যক্ষকে ‘পাদুকা মালা’ পড়তে হল ঐ এলাকার প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিদের সামনে। এই শিক্ষককে কেন তা পড়তে হলো তা আমি পুনরায় ব্যক্ত করতে চাই না। এটা বহল প্রচারিত। আমি এই শিক্ষকের  ধর্মীয় পরিচয়ও আনছি না। তিনি একজন শিক্ষক এটাই তাঁর পরিচয়। এর প্রায় সঙ্গে  সংগেই সাভারের একটি কলেজের এক তরুণ শিক্ষক  প্রকাশ্যে সবার সামনে ছাত্রের হাতে নিগৃহীত এবং খুন হলেন। এরমধ্যে  দেখছি আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক বাংলাদেশের পদার্থবিজ্ঞানে একমাত্র এমিরিটাস প্রফেসর প্রফেসর অরুণ কুমার  বসাকের বসত বাটি তাঁরই পড়শির দ্বারা আত্মসাৎ হচ্ছে।  তিনি হাইকোর্টের নির্দেশ পেয়েছেন, কিন্তু সেখানকার প্রশাসন আত্মসাতকারীর পক্ষে। এই সব ঘটনাই কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এখানে যদি কেউ সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শ পায়, তাকে কি দোষ দেওয়া  যাবে? আবার শুনলাম নড়াইলের এই ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে লেখার ফলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষককে হেনস্তা করা হয়েছে। তাঁর সন্ত্রস্ত পিতা অনেক রাতে টেলিফোনে আমাকে তাঁর ভয়ের কথা জানালেন। এই সকল ঘটনার প্রেক্ষিতে এর আগে একটি   কথাও  উচ্চারণ করিনি প্রকাশ্যে। কিন্তু সব জায়গাতেই যোগাযোগের চেষ্টা করেছি।  প্রকাশ্যে কেন করিনি তা এখন বলছি না। সময় হলে বলবো। কেউ কাপুরুষ বা ভীতু বললেও আপত্তি করবো না।  এর মধ্যে কথা হলো নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়ের সঙ্গে। সে নিজেই টেলিফোন করেছিল, নড়াইলের ঘটনায় তিক্ত বিরক্ত বিক্ষুব্ধ। তিনি প্রতিকারের লড়াইএ নামবেন।  বাংলাদেশকে ফিরে পেলাম। অনেক বামপন্থী রাজনৈতিক দল এর বিরুদ্ধে  তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। আশ্বস্ত হলাম। প্রধান প্রধান অনেক বৃহৎ দল বা যারা গণতন্ত্রের কথা, মানবাধিকারের কথা বলেন, তাঁদের নীরবতায় বিস্মিত হলাম না।  কিন্তু যারা সরকারে  আছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন তাঁরা কি করছেন?  তাঁদের নীরবতা যে তাদেরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে তাঁরা কি তা বুঝতে পারেন? দুর্জনে তো বলেন তাঁদের বসনের আড়ালেই  এই কাজ করছেন  অনেকে। তাঁরা কতটা তাঁদের পর আর কতটা আপন এই কথাটা তাঁরা বোঝেন না? এর মধ্যে দেখি  তাঁদের মন্ত্রীরা  দেশে বিদেশে দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি রক্ষা করতে বদ্ধ পরিকর হচ্ছেন।

যাহোক এতসব অন্ধকারের  শেষে বাংলাদেশকে ফিরে পেলাম যখন সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাভারের নিহত শিক্ষকের ছাত্র ছাত্রীরা বিশেষ করে ছাত্রীরা বিচারের দাবীতে রাস্তায় শ্লোগান দিচ্ছে তা দেখে। আমার মনে হয় এই প্রতিবাদ আমাদেরকে চপেটাঘাত করে জাগিয়ে দিতে পারে।  

জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়ে গরীয়ান। প্রকৃতির নিয়মে সব মানুষই মাতৃহারা হয়, কিন্তু মানূষ কি জন্মভূমি হারা হয়? জন্মভূমি বহুবার বহু বাইরের শক্তি দ্বারা অধিকৃত হতে পারে । তখন তাকে ফিরে পেতে বহু রক্ত দিতে হয়। সে অভিজ্ঞতা জাতি হিসেবে আমাদের আছে।  কিন্তু কিছু  ঘটনার মধ্য দিয়ে  নিজের ভাইকে দ্বারা  যখন কেউ জন্মভূমি হারা হয়, সেই জন্মভূমি  তো আর উদ্ধার করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে  এই বিশ্বাসটা আমরা পেয়েছিলাম, এই বংগ ভূখন্ডের কেউ  কখনো আর জন্মভূমি হারা হবে না।  এই দৃঢ় প্রত্যয়  নিয়েই এদেশের মানুষ লড়াইটা করেছিল। কিন্তু মাঝে নামে অমানিশা । তখন  রাস্তায় শ্লোগান দেওয়া কিশোরীরা আবার প্রমাণ করে  এ প্রত্যয় হারিয়ে যাবার নয়। জীবন সায়াহ্নের জন্মদিনে এর চাইতে পাওনা আর কি হতে পারে?  

 

নীরোর বাঁশি বাজানোর ইতিহাসটা পরে একদিন বলার ইচ্ছে রইলো। আজ কিশোরিদের উদ্যত হাত আর বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো তরুণেরা আমাদের ভবিষ্যত হোক।  

মানুষ বুদ্ধিশ্বর, আমার বাল্যবন্ধু

 

আমার এক ছেলেবেলার বন্ধু-নাম বুদ্ধিশ্বর প্রামানিক। মা বাবা কেন তার নাম বুদ্ধিশ্বর দিয়েছিল জানি না, কারণ লেখাপড়ায় তার বুদ্ধির কোন ছাপ ছিল না। ফলে তৃতীয় কি চতুর্থ শ্রেণী থেকেই স্কুলের মায়া কাটিয়ে সে জীবন পাঠশালায় চলে যায়। পেশায় কাঠমিস্ত্রী হয়।কিছুটা পৈতৃক পেশা। তারপর বহুকাল দেখা হয়নি। প্রায় ৬০ বছর। জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে ও কোথায় তাও জানি না। আমার জীবনও এক জায়গায় ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি শেষ করে দেশের বাড়ি গেলাম। মা বাবা গত হয়েছেন বহু বহুবছর। ভাইবোন কেউ এদেশে নাই। শুধু আছে পৈতৃক ভিটা। শৈশবের স্মৃতি। হাতড়ে বেড়ালাম পুরনো বন্ধুবান্ধব, ছোটবেলার সাথীদের। অনেকেই গত অথবা গ্রাম ছেড়ে শহরে। হঠাৎ করে এক পরিচিত অনুজপ্রতীম একজনের কাছে শুনলাম বুদ্ধিশ্বর এখনো আছে। তাকে নিয়ে গেলাম বুদ্ধিশ্বরের বাড়িতে। বিগত ৬০ বছরে কোন পরিবর্তন হয়নি। দারিদ্র তাকে ছাড়েনি। নাম ধরে ডাকতে বেড়িয়ে এলো একটি মেয়ে। যুবতী। চেহারায় অবিকল বুদ্ধিশ্বরের প্রতিকৃতি। বুঝলাম তার সন্তান হবে। বললাম, ‘বুদ্ধিশ্বর আছে?’. সে বললো, ‘বাবা রিলিফ তুলতে গেছে। ‘ আমি বললাম, তোমার বাবা এলে বলবে আমি তার ছোটবেলার বন্ধু, পারলে যেন বিকালে আমার সংগে দেখা করে’। মেয়েটার চোখেমুখে এক অবাক বিস্ময় মনে হলো। বিকালে যথারীতি গ্রামের বটতলায় বসেছি। অনেক পরিচিত, অনেকে নাম শুনেছে, এবারই প্রথম দেখলো। স্কুল কলেজে পড়ে অনেক ছেলেমেয়েরা অনেকে অনেক প্রশ্ন করলো। প্রায় অন্ধকার। হঠাৎ দেখি পক্বকেশ এক বৃদ্ধ এককোনে বসে আছে। দেখে মনে হলো চিনি। তাইতো, এতো বুদ্ধিশ্বর। আমি ডেকে বললাম, বুদ্ধিশ্বর এদিকে আয়। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে বললো, কেমন আছেন? আমি জোরে হেসে বললাম, তুই আমাকে আপনি বলছিস কেন, তুই বল’। বুদ্ধিশ্বরের চোখে জল। বললো, তুই বলবো? হাত দুটো জড়িয়ে ধরে ধাতস্থ হলো। তারপর হাসলো। অনেকগুলো দাঁত নেই। তবুও তার হাসি তাকে আমাকে ছোটবেলায় নিয়ে গেল। নানা গল্প হবার পর আমার ছোটবেলার নাম ধরে বললো, ‘একটা কথা বলবো?’ আমি বললাম, ‘ বল’। ও বললো, ‘তুই আমার বাড়ি গিয়েছিলি। তাই দেখে আমার স্ত্রী এই প্রথম আমাকে মানুষ বলে গণ্য করে দুপুরে যত্নআত্তি করলো। আমি অবাক হয়ে বউকে বললাম কি ব্যাপার? আমার মেয়ে বললো, বাবা, আজ সকালে তোমার এক বন্ধু এসেছিল। মা তাকে দেখে বলেছে তোর বাবার এমন বন্ধু আছে? ‘। বুদ্ধিশ্বর বললো, বন্ধু, এতোকাল পর আমি মানুষ হিসেবে পরিচয় পেলাম। আমি কি বলবো বুঝলাম না। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দুই ছোটবেলার বন্ধু নিজেদের শৈশবের উত্তাপ অনুভব করলাম। এতকাল পর বুঝলাম ওর বাবা মা কেন ওর নাম বুদ্ধিশ্বর রেখেছিল। মানুষ হবার আকাঙ্ক্ষা যে কতবড় দার্শনিক বোধ এটা আমরা ভুলে যাই। জীবনের সব ক্ষেত্রে হেরে যাওয়া বুদ্ধিশ্বর তা ভোলেনি। সে মানুষ হতে পারার গর্বে তার বন্ধুকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছে। শুনলাম, বুদ্ধিশ্বর, পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনন্তের পথে যাত্রা করেছে। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ভাবলাম, বন্ধু, তুই মানুষ হয়েছিলি। মানুষ হবার এই দার্শনিক বোধ শেখানোর জন্য তোর কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো।

 

 

 

 

 

                                                                                                  

 


Sharing Helps!