১৬ ই ডিসেম্বর। বাংগালী জাতির শোক ও আনন্দের এক মিশ্র অনুভূতির দিন। ৫০ বছর আগে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই জাতি বিজয়ের উত্তোলিত হাত তুলে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছেছিল। প্রায় এক লক্ষ গর্বোদ্ধত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রকাশ্যে মাথা নত করে তাদের অস্ত্র সমর্পন করেছিল সোরাওয়ার্দী উদ্যানে। যে স্থানে ৭ মার্চ, ১৯৭১এ, ১০ লক্ষাধিক জনতার সামনে, মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি বংগবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সেই ঘোষণা,’এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ করেছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়েছিল ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দিয়ে। এই মুক্তিযুদ্ধে বাংগালী জাতি বন্ধু হিসেবে পেয়েছে বিশ্বের শত শত কোটি মুক্তিকামী মানুষকে। ভারতের জনগণ, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে তৎকালীন ভারতের সরকার, সে দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলির। সোভিয়েত ইউনিয়ন, কিউবাসহ সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলি বাংগালী জাতির মুক্তিসংগ্রামে সর্বান্তকরণে সমর্থন জুগিয়েছিল। আবার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহায়তায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য প্রয়াস, সৌদি আরবের নেতৃত্বে মধ্য প্রাচ্যের মার্কিন তাবেদার শক্তি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। মাও সে তুং এর নেতৃত্বে চীনের তৎকালীন নেতৃত্ব বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে হতবাক ও হতাশ করে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেনি। ত্রি-বিশ্ব তত্বের অন্ধকার কানাগলিতে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার মুক্তির আকাংখা তাঁদের কাছে দৃশ্যমান হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের জনগণ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে কোটি বিশ্ববাসীকে যারা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিল।
কেটে গেছে ৫০ বছর। আবেগ আর উচ্ছাস এখন ইতিহাসের গর্ভে ধীরে ধীরে স্থিত হচ্ছে। পালটে গেছে বিশ্ব পরিস্থিতি। সোভিয়েত নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শক্তিবলয় নেই। এই প্রেক্ষাপটে সময়ের পরিক্রমায় নতুন বাস্তবতায় সময় আরও প্রাসংগিকভাবে দাবী করছে এক নির্মোহ সাল তামামির। বাংগালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে কি আকাংখা নিয়ে মরণপন লড়াই করেছিল, আজ তার কতটুকু অর্জিত হয়েছে, তার কতটুকু এখনো প্রাসঙ্গিক? এই মুহূর্তে কে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধু, আর কেই বা শত্রু? এই প্রশ্ন যেমন প্রাসঙ্গিক, উত্তরটাও তেমনি জরুরি। শুধু অতীত বা বর্তমানের আহাজারির জন্য নয়, ভবিষ্যতের পথ চলার জন্য। তাই আজ, ৩০ লক্ষ শহীদ ও ৩ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাবনত স্মরণের মধ্য এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে, নির্মান করতে হবে ভবিষ্যতের যাত্রাপথ, কারণ ইতিহাসের উল্টোযাত্রা অসম্ভব।
উত্তরটা যথাযথ হতে হলে প্রয়োজন বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতির নির্মোহ হিসেব ও তার ক্রমবিকাশে বর্তমান বাস্তবতার নিরিক্ষণ। কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ কোন পথে এগুবে তা বহুলাংশে নির্ধারিত হয় সে দেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক দল কি অবস্থায় আছে, কি করতে চাচ্ছে তার উপর। সংক্ষেপে ইতিহাসের সময় রেখা টানলে গত ৫০ বছরের শাসনকাল স্পষ্ট করে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত বংগবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসনকাল। খন্দকার মুস্তাককে সামনে রেখে ক্যু দে তা কারী সামরিক নেতৃত্বে স্বল্পকালীন সময়ের ঘটনাবহুল সময়ের মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আসে ( ১৯৭৫-১৯৮১)। আর এক সামরিক হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে জিয়ার শাসন কাল শেষ হয়। কার্যতঃ ক্ষমতায় আসে আর এক সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ ( ১৯৮২-১৯৯০) । ’৯০ এর গনঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে জেনারেল এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার রূপান্তরকাল (১৯৯০- ১৯৯১)। সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রথম বারের মত বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসে (১৯৯১-১৯৯৬)। ১৯৯৬ সালের ঘটনাবহুল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা প্রধান মন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। (১৯৯৬-২০০১)। ২০০১ সালে নির্বাচনে বি এন পি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসে (২০০১-২০০৬)। কিন্তু, বেগম খালেদা জিয়া শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর বা নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হন। তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত চলে আর এক ধরণের সামরিক শাসন। গন-আন্দোলন এবং গন বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে নির্বাচনে ৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনা মহাজোটের নেতা হিসেবে পুনরায় প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০১৪ সাল, ২০১৮ সালের আরও দু’টি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এখনো ক্ষমতায়।
বিগত বছরগুলোতে অসংখ্য রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে, যার প্রভাব দেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করেছে। প্রতিটি ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ রয়েছে। রয়েছে প্রভাবক ভূমিকা। ইতিহাসের সময় রেখায় দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ বছরের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামাত বি এন পির হাত ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে যায় এবং মুক্তিযুদ্ধকে তারা ইতিহাসের দূর্ঘটনা হিসেবে চিত্রিত করে। তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে ’৭১ সালে কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। তাদের ছত্রছায়ায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এমকি প্রজাতন্ত্রবিরোধী ধর্মীয় জঙ্গীবাদ (বাংলা ভাই ইত্যাদি) গোটা দেশে প্রভাব বিস্তার করে।
৫০ বছরের ঘটনাবহুল রাজনৈতিক সময়কালে ’৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা ধারণকারি সংবিধানের সংশোধনী হয়েছে ১৫ বার। তার মধ্যে ৫ম ও ৮ম সংশোধনী সরাসরি ’৭২ এর সংবিধান মৌল বিষয়কেই পালটে দেয়। সংবিধানের মূল স্তম্ভ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা অপসৃত হয়। ১৫ তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে এই চার মূল নীতি প্রতিস্থাপিত হলেও এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক ৮ম সংশোধনীতে গৃহীত ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ বিধান এখনো রয়ে গেছে। সংবিধানের এই সাংঘর্ষিক বিধান দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও নির্ধারক প্রভাব ফেলছে।
ইতিহাসের সময় রেখা এবং তার ঘটনার গতিপ্রকৃতি প্রমান করে গোটা ৫০ বছরকাল ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক আঁক-বাঁক হয়েছে। ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত একটি পর্যায়কাল – যাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারাকে প্রধান ধারা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে, সেই বিতর্কের বাস্তব ভিত্তিও রয়েছে-তবুও এই কালকে ভিত্তি কাল হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। তাঁর হত্যাকান্ডের পর যদিও স্বল্প সময়ের জন্য আওয়ামী লীগেরই নেতা খন্দকার মোস্তাক ক্ষমতায় থাকে। কিন্তু যে লক্ষ্যে বংগবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল, সেই রাজনীতির মূল্ধারা শুরু হয় জেনারেল জিয়ার ক্ষমতাদখল ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তির রাজনৈতিক পূনর্বাসনের পর্বকাল দিয়ে। বলা চলে ইতিহাসের উল্টোযাত্রা। প্রশ্ন হলো কারা এই পরিবর্তনের মূল নায়ক? আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মূলতঃ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি- যার নেতা হিসেবে জেনারেল জিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যদিও তিনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ ছাড়া যারা অনেকে বৈজ্ঞানিক সামজতন্ত্র বা আরও রেডিক্যাল পরিবর্তন চেয়েছিল তারাও এই পরিবর্তনে পরোক্ষে সহায়ক শক্তি হিসেবেই কাজ করেছে –এটা ইতিহাসের বাস্তবতা। পিছনে যে শক্তি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তা আজ অনেকটাই প্রকাশিত-তারা হলো মার্কিনী গোয়েন্দা বাহিনী। তৎকালীন সময়ে গোটা পৃথিবী জুড়েই তারা এই কাজ করেছে। এই গোটা পরিবর্তনের প্রধান দিক হলো, বহির্বিশ্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ’৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে পরাজয় হয়েছিল, মুজিব পরবর্তী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তার প্রতিস্থাপন শুরু হয়ে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। কেন এই পরিবর্তন হতে পারলো, শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কি ব্যর্থতা। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বংগবন্ধুরই বা কি সীমাবদ্ধতা ছিল তা আলাদা আলোচনার বিষয়, সে আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু এই পরিবর্তন ইতিহাসের গতিধারাকে কোন দিকে নিয়েছে আজকের আলোচনায় সেটাই প্রধান বিবেচ্য। এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ধর্মীয় মৌলবাদ যার মূল নেতৃত্ব ছিল জামাতে ইসলামের হাতে তাদের পূনর্বাসন ও শক্তি সঞ্চয় হয়েছে –এটাই বাস্তব সত্য। । সামরিক বেসামরিক আমলা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে তাদের শক্তি গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। শুধু রাষ্ট্র শক্তি নয়, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও যেমন, ব্যংক-বীমা, শিল্প ব্যবসায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছে, তৈরী হয়েছে তাদের নিজের ধরণের এক রাজনৈতিক অর্থনীতি – যা এখনও বিদ্যমান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, মতাদর্শ, সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও এক আমূল পরিবর্তনের চিহ্ন রাখতে শুরু করেছে এই পরিবর্তন, অন্ততঃ সুযোগ পেয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে জিয়াউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত ধারা সৃষ্টির পরিকল্পিত পদক্ষেপই গ্রহণ করে। স্বল্পকাল ক্ষমতায় থাকলেও জিয়াউর রহমান রাজনীতির ক্ষেত্রে এক গুণগত পরিবর্তন করে-তাহলো মুক্তিযুদ্ধকে এবং তাঁর মৌল চেতনাকে সরাসরি বিরোধীতা না করে তার বিপরীত চেতনাকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি সমান্তরাল ধারা তৈরি করায় প্রয়াস রাখে – এখনো যা চলমান। জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর আর এক সামরিক একনায়ক জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনাকে নস্যাত করার প্রক্রিয়া আরও গভীর হয়ে যায়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে একধরণের ঐক্য জাতীয় ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, সেই আন্দোলনের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দল, বি এন পি র নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও ৫ দলীয় বামসহ আরও কিছু বামদল সবাই মিলে তিন জোটের রূপরেখার এক ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক মোর্চা গড়ে ওঠে। প্রায় ৯ বছরের ঘটনাবহুল আন্দোলনের সময়কালে ছাত্রদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ জেনারেল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অন্যতম মুখ্য ও নির্ধারক ভূমিকা রাখে। অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনও নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে । তবে উল্লেখ করা উচিত ছাত্রদের মধ্য থেকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ‘ছাত্র শিবির’ নামে বিপুল শক্তি অর্জন করে। তারা মূলতঃ বাম প্রগতিশীল ছাত্র ও রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা অব্যাহত রাখে। (রাজশাহী মেডিকেল কলেজে জামিল আখতার রতনসহ আরও অনেকে এর শিকার) জেনারেল এরশাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠার আড়ালে তারা শক্তি সঞ্চয় করে, যাদের মূল দল জামাতে ইসলাম ইতিমধ্যে মূল রাজনৈতিক শক্তিতে অংশগ্রহণ করে ও চতুরতার সঙ্গে এই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করে। । যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে এদেশের ধর্মীয় জঙ্গীবাদী শক্তির ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। তারা ভিতরে ভিতরে রাজনৈতিকভাবে কতটা শক্তিশালী হয়ে তা দৃশ্যমান হয় পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ,
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনীতির সার-সংক্ষেপ করলে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার মৌলিক নির্যাস সংবিধানের ৪ মূল স্তম্ভের উপর স্থাপিত তার বিরুদ্ধে প্রধান বিপদ ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি এবং তাদের স্বাভাবিক মিত্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তি। অনেক ক্ষেত্রে এটাও আজ দেখা যাচ্ছে, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভাবাদর্শের সঙ্গে আপোষ করছে। শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যে সকল সংকীর্ণ দলিয় স্বার্থ, জঙ্গণের গণতান্ত্রিক অধিকারের সংকোচন, দূর্নীতি বা বৈদেশিক শক্তির চাপে জনগণ বা জাতীয় স্বার্থের যে কোন খেলাপ তাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে এবং তা তাঁর প্রধান বিরোধী পক্ষ দক্ষিণ পন্থী শক্তিকেই সহায়তা করছে, যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভাবাদর্শ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্য দিকে, বিভিন্ন ধারার বাম শক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মৌল ধারণাকে ধারণ করে তাঁরাও বহুধা বিভক্ত। আওয়ামী লীগের জনবিচ্ছিন্নতার সুযোগে জনগণের মধ্যে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে প্রগতির পথে দেশকে এগিয়ে নেবার সুযোগ তাঁদের জন্য সীমিত হয়ে পড়ছে। বাম-পন্থীদের একটি অংশ মৌলিকভাবে প্রধান বিপদ হিসেবে শাসক আওয়ামী লীগ বিরোধীতার কৌশল নিয়ে অথবা বি এন পি জামাত ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমদূরত্বের রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করছে, তাঁরা মূলতঃ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির পরোক্ষ, কোন কোন সময় প্রত্যক্ষ সহায়তার অবস্থান নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক শক্তির কাছে বাংলাদেশ এখন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব-রাজনীতির নতুন প্রেক্ষাপটে, ’৭১ এর শক্তিবিন্যাসের অনেক পরিবর্তন দৃশ্যমান। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারতের আগ্রহ ও স্বার্থ রয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ’৭১ এর পর থেকেই বাংলাদেশে তাদের প্রভাব বলয় বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের প্রধান ভিত্তি বি এন পি-জামাত নির্ভর দক্ষিণপন্থী শক্তি। আওয়ামী লীগকেও তারা ব্যবহার করতে চায়, যা তাদের দ্বৈতনীতির পদ্ধতি। সেখানে পাকিস্তান তার আঞ্চলিক সহায়ক। ভূ-রাজনীতির নতুন মেরুকরণ বিশেষ করে এশিয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণনীতি ( Asia Pacific Pivotal Strategy ) যা মূলতঃ চীনকে ঘেরাও বা প্রতিহত করার কৌশল, তারই অংশ হিসেবে ভারতের নতুন শাসক দলের সঙ্গে মার্কিনের নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত-মার্কিন অবস্থানের বৈপরীত্যও রয়েছে, সেটাও বিবেচ্য বিষয়। এই প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের যে কোন সমান্তরাল সম্পর্ক ভারত গ্রহণ করবে না। এখানেই ভারত-মার্কিন দ্বন্দ ও ঐক্যের ভিত্তি রয়েছে। বিগত এক দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে চীনের অবস্থান এখন অনেক সংহত। রাশিয়ারও প্রভাব দৃশ্যমান। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি চাপ বাড়ছে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক ত্রিমুখী প্রভাব এখন অনেকটাই স্পষ্ট। সৌদি আরবের নেতৃত্বে মধ্যপ্রচ্যের যে শক্তি ’৭১ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে তারা মার্কিন নেতৃত্বে তাদের অবস্থান অব্যাহত রেখেছে।
আভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবেই বি এন পি-জামাত নেতৃত্বাধীন শক্তিই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক শক্তির প্রধান বিরোধী। বামপন্থী শক্তির ক্রমাগত শক্তিক্ষয় এবং অনৈক্যের ফলে বাম শক্তি বা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আগ্রহ কমেছে এবং কমছে। আওয়ামী লীগ বরং ধর্মীয় ভাবাদর্শের একটি অংশের একটি রাজনৈতিক শক্তি যেমন হেফাজতের সঙ্গে আপোষ সম্পর্ক তৈরি করতে আগ্রহী। ফলে অর্থনীতির মৌল দিক যাকে বিশ্ব নয়া-উদারনীতিবাদের প্রভাব বলা যায়, তার দিকে ঝুঁকে পড়াটাই যেমন প্রধান, তেমনি গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের আমলাতন্ত্র এই নীতি দ্বারাই চালিত হবার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থা এবং তাদের স্বাভাবিক মিত্র সাম্রাজ্যবাদের বিপদই প্রধান হয়ে উঠছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিমূর্ত একটি ধারণার মধ্যে না রেখে নির্দিষ্টভাবে জনগণের ক্ষমতার গণতন্ত্রায়ন, অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিকাশ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি যা মূলতঃ নয়া- উদানীতিবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা জরুরি। এই শক্তি জনগণের মধ্যে তাদের অবস্থান দৃঢ় করতে পারলে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষের অবস্থানকে কার্যতঃ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধি দক্ষিণ-পন্থী শক্তিবিরোধীতায় কার্যকর হতে পারে। শুধুমাত্র আওয়ামীলীগের উপর নির্ভর করে দক্ষিণ-পন্থার বিপদকে ঠেকানো যাবে না। নির্ভরতার রাজনীতিকে প্রধান না করে, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে তাই নিজের পায়ের জোরে জনগণের মধ্যে অবস্থান নেবার কৌশলকেই প্রধান কৌশল হিসেবে নিতে হবে। তাঁদের নিজেদের ঐক্যকে জনগণের নিজস্ব সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সংহত করলেই মূল শ্ত্রুর বিরুদ্ধে কার্যকর মিত্র শক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। জাতির কপালের অশনি শক্তির সংকেত পড়তে না পারলে সামনে সমূহ বিপদ। বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে এটাই আজ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।