স্মৃতিতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Sharing Helps!

১৯৯২ থেকে ২০১৭ সাল প্রায় ২৬ বছর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছি। ১৯৯১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ফলে একটি শিশু বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার বিচিত্র পথযাত্রায় সঙ্গে থাকতে পেরেছিলাম, এটা  ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া তো বটেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যোগদানের ঘটনাটি আর পাঁচটি চাকুরিতে যোগদানের মত ছিল না । ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়ে ওঠার গতিপ্রবাহে আমার সংশ্লিষ্টতাও আর পাঁচজনের মত হয়নি। ১৯৭৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের  পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্মাতকোত্তর ডিগ্রি ( মুক্তযুদ্ধের ফলে দু বছর দেরী হয়েছিল) নিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা চাকরিতে যোগদান না করে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রায় বিশ বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ধরণের আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত থেকে প্রকৃতপক্ষে ‘একাডেমিক’ জগত থেকে দূরেই ছিলাম। ’৯০ এর গণ-অভ্যূত্থানে ‘জেনারেল এরশাদের’ পতনের আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত থাকায়   ‘রাজনীতির তকমাটা ভালোভাবেই পিঠে লেগে গিয়েছিল। ’৬৯ এর গণ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ  তখন প্রায় তামাদি হয়ে গিয়েছে। তবুও এ বিষয়গুলো বারবার এসেছে এই ছাব্বিশ বছরে।  ব্যক্তিগত প্রসংগটি আসার জন্য ক্ষমা চাইছি, কিন্তু শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘একাডেমিক’ বা  নন-একাডেমিক’ বহু বিষয়ে আমার অংশগ্রহণের সময় বিষয়গুলো বিবেচিত হয়েছিল, ফলে প্রসংগটি আর অপ্রাসংগিক থাকেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের বিষয়টি ছিল একেবারেই অকস্মাৎ। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য প্রফেসর ড. ছদরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান, এই বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রথম প্রফেসর ও শিক্ষক প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী, রাজশাহী  বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস প্রফেসর ড. অরুন কুমার বসাক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার সরাসরি শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. বজলুল মোবিন চৌধুরী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আমার প্রিয় শিক্ষকদের একজন ছিলেন। ফলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার প্রাক্কালে রাজনৈতিক কারণে সিলেটে আসার সুযোগেই স্যারদের সঙ্গে প্রায় দু দশক পর দেখা হয়। আমার বয়স তখন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। ফলে চাকরির আশা বা ইচ্ছা কোনটাই আর থাকার মত  ছিল না। স্যাররাই  আমাকে উৎসাহিত, কিছুটা উদ্বুদ্ধ করলেন, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে আবেদন করার জন্য। বিষয়টি  সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার জন্য সহজ ছিল না রাজনৈতিক কারণে, পারিবারিক কারণেও। আমার সহধর্মিনী হাইকোর্টে এডভোকেট পেশায় যুক্ত ছিলেন। ( যিনি পরবর্তীতে ডেপুটি এটর্নি জেনারেল হয়েছিলেন )।  তবুও একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের লোভ বোধহয় সামলাতে পারিনি। এই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না ঠিক ছিল তা ইতিহাসের উপরই ছেড়ে দিতে হবে। সকল প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯২ সালের ১৫ এপ্রিল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে  যোগদান করলাম। আমার সমবয়সী অনেকেই তখন অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক। ফলে চাকরির ক্ষেত্রে এই অসামঞ্জস্য অনেক বিপত্তি তৈরি করেছে। তা আর এখন প্রাসঙ্গিক নয়। নিজের পরিবার, রাজনৈতিক পরিবেশ ছেড়ে একটি শিশু বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রক্রিয়ায় আরও অনেকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। আজ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অনেক কারণেই প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় এবং এখান থেকে বিদ্যা পাঠ শেষে অনেক ছাত্র এখন বিশ্বের অনেক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাগারে অনেক যশ এবং খ্যাতি অর্জন করায়, বিশ্বের আসরেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে উজ্জল্ভাবেই। তাছাড়া, যে সকল শিক্ষকরা কিছুকালের জন্য এখানে কাজ করে পরবর্তীতে দেশের বা পৃথিবীর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজে রয়েছেন, তাঁরাও এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ভুলতে পারেননি। নিশ্চয়ই তার সংগত কারণ রয়েছে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে শিক্ষা কারিকুলামের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম থেকেই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পৃথক ধারায় যাত্রা শুরু করে। প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া স্বত্বেও এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় কয়েকটি মূল বিষয় নিয়ে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, পরিসংখ্যান, অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান ছিল প্রথম বিষয়। শুরুর এই বিষয়টার মধ্যেও বৈচিত্র্য ছিল। কারণ প্রযুক্তিও যে মূল বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই এগোয়, এ চিন্তাটা ছিল। প্রথম উপচার্য প্রফেসর ড. ছদরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের খ্যাতনামা শিক্ষক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়ে ওঠার পিছনে তাঁর নিজের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। তাই  এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ রূপকল্প তৈরি করতে তাঁর অসুবুধা হয়নি। আর প্রথম থেকেই এই রূপকল্প  কার্যকর করার জন্য তিনি যোগ্য সহযোগী পেয়েছিলেন বা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে পেরেছিলেন। যেমন পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর ড. অরুন কুমার বসাক, , গণিতের প্রফেসর ড. মিরাজ উদ্দিন মন্ডল, রসায়নের প্রফেসর খলিলুর রহমান, অর্থনীতির প্রফেসর ড. ইসমাইল হোসেন, প্রফেসর বজলুল মোবিন   চৌধুরী, অপেক্ষকৃত তরুনদের মধ্যে ড. জয়নাল আবেদিন, ড. গৌরাংগ দেব রায় সহ আরোও কিছু পরিশ্রমী মেধাবী শিক্ষক প্রথম থেকেই যোগ দিয়েছিলেন। তাছাড়া, তিনি প্রতিটি বিভাগে বেছে বেছে  দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেধাবী তরুণ প্রভাষকদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে, কোন আপোষ করেননি। পরবর্তী বিভিন্ন সংকটকালে  এটা প্রমান হয়েছে যে, এই যথাযথ নিয়োগ  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম অক্ষুন্ন রেখেছে। তিনি কম্পিউটার প্রযুক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ করার ইচ্ছা থেকে কম্পিউটার কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য প্রফেসর অরুন কুমার বসাককে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও প্রণোদনা দেন। যা পরবর্তীকালে প্রফেসর গৌরাংগ দেব রায় ও প্রফেসর ড. জাফর ইকবালসহ অনেকের প্রচেষ্টায় দেশের শ্রেষ্ট কম্পিউটার কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে।  কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ খোলার জন্য তিনি তরুণ  কিছু শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন যার মধ্যে জনাব হুমায়ুন কবিরের নাম বলতেই হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররা তখন এ বিভাগে নিয়োগ পেয়েছিল। তিনি ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের প্রখ্যাত অধ্যাপক  সাবেক উপাচার্য  ড. রকিবকে সুপার নিউমারারি প্রফেসর হিসেবে আনতে পেরেছিলেন। পরবর্তিতে প্রফেসর ড. জাফর ইকবালকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের ব্যাপারেও তিনিই ভূমিকা পালন করেন। প্রফেসর হাবিবুর  রহমানকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে পেরেছিলেন সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, উপ-উপাচার্য ও উপাচার্য হয়েছিলেন। তখন  সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগে কিছু তরুণ প্রভাষক তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন যারা পরবর্তীকালে এবং বর্তমানে তাঁদের একাডেমিক ও গবেষণা দিয়ে দেশে ও বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বয়ে এনেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রভূত ভূমিকা রেখেছেন।

প্রশাসন বিশেষ করে, রেজিস্ট্রার দফতর, হিসাব ও পরিকল্পনা দফতর, লাইব্রেরী, কম্পিউটার কেন্দ্রসহ  বিভিন্ন প্রশাসনিক দফতরে এই সময়ে যারা নিয়োগ পেয়েছিলেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রভূত ভূমিকা রেখেছেন, এখনও রাখছেন। ( স্থানাভাবে সবার নাম উল্লেখ করছি না)। সাধারণ তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর অনেক কর্মী যারা নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিবার মনে করতেন, চাকরি ভাবতেন না। বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার প্রথম পর্যায়ে এটা ছিল একটি যৌথ পরিবার। উপাচার্য হিসেবে প্রফেসর চৌধুরী তাঁর অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তাতে পেশাগত ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিপত্তি ঘটলেও, সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

প্রথম উপাচার্য যাবার পর, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্যরা নিয়োগ পেয়েছেন, প্রফেসর হাবিবুর রহমান ছাড়া আর কেউ  এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয় বড় হয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম বেড়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তরুণ শিক্ষকরা যোগদান করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা  ছাত্ররাও শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু  পরিমাণগত পরিবর্তন হয়নি, গুণগত পরিবর্তনও  হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের  অবয়ব পরিপূর্ণ হবার পর থেকে পারিপার্শিক এলাকায় তাঁর  আর্থ-সামাজিক প্রভাব, কাঠামোগত পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। যার ফলে রাজনৈতিক প্রভাবও অনিবার্য হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সকল ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন হয়েছে তাঁর উপর এ বাস্তবতা স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বাড়তে থাকে। বারান্তরে তাঁর কিছুটা হয়তঃ উল্লেখ করতে  হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা উপাচার্য হিসেবে  দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের সবার সঙ্গেই আমার কর্মজীবনে কাজের সংশ্লিষ্টতা হয়েছে। তাঁদের সবার কাজের অনুপুংখ বিচার কারুর একার পক্ষে করা সম্ভব নয়, আমার পক্ষে তো নয়ই। তবুও বলবো, ভালো অভিজ্ঞতা যেমন আছে,  খারাপ অভিজ্ঞতাও আছে, যার কিছু কিছু  বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিপুল সহায়তা করেছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রচন্ড নেতিবাচক প্রভাবও ফেলেছে।

শিক্ষাকার্যক্রমের ক্ষেত্রে বলতে গেলে বলতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের  তরুণ শিক্ষকদের মধ্যে সুযোগের অপ্রতুলতা সত্বেও গবেষণার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। প্রধানতঃ দুটি কারণে। (এক) পেশাগত জীবনে উন্নতির জন্য তাঁদেরকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়। দ্বিতীয়তঃ সীমিত হলেও সিনিয়র  শিক্ষকদের উৎসাহ ও সহযোগিতা তাঁরা পেয়েছিলেন। ফলে তরুণ শিক্ষকরা যেমন দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন  বিশ্ববিদ্যালয়ে উচশিক্ষার সুযোগ করে নেন, তেমনি নতুন এবং তরুণ বহু শিক্ষক নিয়োগ পান। তাঁরা    বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসার ফলে তাঁদের মাধ্যমে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্রক্রিয়ায় এরা  যুক্ত হতে পারেন। ফলে দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একধরণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর মধ্যে একধরণের  প্রতিযোগিতা (যা নেতিবাচক ও ইতিবাচক উভয়ই ছিল) তৈরি হয়। এটাও গবেষণার ক্ষেত্রে গতি সঞ্চার করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে ছাত্ররা শিক্ষা শেষ করে  অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে,  অনেকে দেশের সরকারি বেসরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সুযোগ করে নেয়। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার ফলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে তাঁদের অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হয় বলে তাঁরা আরও মনোযোগী এবং পরিশ্রমী হয়। যার ফলে তাঁদের মধ্যে সাফল্যের আকাংখাও বেড়ে ওঠে, প্রকারান্তরে তা পরবর্তী প্রজন্মের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

দু’টি বিভাগের সঙ্গে সরাসরি একাডেমিকভাবে যুক্ত ছিলাম। শেষ বছরটি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তাই সংক্ষেপে হলেও এই দু’টি বিভাগ সম্পর্কে না বললে অপরাধ হবে। পদার্থবিজ্ঞান  বিভাগ এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ও প্রথম সারির বিভাগগুলির মধ্যে একটি। শিক্ষা কার্যক্রমের  উৎকর্ষতা, গবেষণা এবং তরুণ ছাত্রদের গবেষণায় সংশ্লিষ্টতার বিবেচনায় এ বিভাগ তাঁর সুনাম অক্ষুন্ন  রেখেছে। প্রফেসর অরুণ কুমার বসাক তাঁর মেধা আর ঐকান্তিকতা দিয়ে যে ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন, আমার ধারণা তা পরবর্তীকালে অব্যাহত থেকেছে। জনাব নাজমুল আহসাব, প্রফেসর হাবিবুল আহসান, প্রফেসর ইয়াসমিন হক, প্রফেসর বদিউজ্জামান ফারুক যারা প্রথম দিকের সিনিয়র ছিলেন তাঁরা যোগ্যতার সঙ্গে তাঁদের ভূমিকা রেখেছেন। আমি যথাসাধ্য তাঁদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি। এখন বর্তমানে অনেক তরুণ অধ্যাপকরা তাঁদের সুনামের ধারাবাহিকতা রেখেছেন। এই বিভাগ থেকে যারা স্নাতক হয়েছেন, তাঁদের অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ( প্রফেসর ড. নাজিয়া চৌধুরী এখন বিভাগীয় প্রধান)। অন্য অনেকে দেশে বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও গবেষণাগারে, দেশের সরকারী, বেসরকারি কলেজ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অনেক সরকারি কর্মকর্তার পদে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রকল্পের অধীনে গবেষণা কাজ এখন দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম কুড়িয়েছে। নন-লিনিয়ার ল্যাব, লেজার ল্যাব, অপ্টো-ইলেকট্রনিক্স ল্যাব, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, এস্ট্রো-ফিজিক্স, কম্পিউটেশনাল ফিজিক্স সহ আরও অনেক ক্ষেত্রে গবেষণা এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে  প্রশংসা পাচ্ছে। আশা করি এই গতি অব্যাহত থাকবে।

ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও এই বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব  পেয়েছিলাম। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এই বিভাগের তরুণ শিক্ষক ও ছাত্ররা দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করছেন। নিঃসন্দেহে কিছুটা শ্লাঘা মনের মধ্যে আছেই।

কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগসহ ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি এখন শুধু দেশ নয় দেশের বাইরেও তাঁদের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে-এটা বলা অত্যুক্তি নয়। সমাজবিজ্ঞানের অনেক শাখার  গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিকভাবে প্রসংশিত হচ্ছে। বিগত তিন দশকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শিক্ষায় যে অবদান রেখেছে অনেক ক্ষেত্রে তা একেবারেই নতুন, তাই তাকে অস্বীকার করার উপায় নাই।

তবে বিগত তিন দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষাক্রম বা উন্নয়নযাত্রা অবিমিশ্র বাধাহীন ভাবে হতে পেরেছে তা নয়। নিজেদের জীবন দিয়েই আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। অনেক সংকট এবং বিপত্তি এসেছে। এসেছে অনেক দূরতিক্রম্য বাধাও। বিস্তৃত না বলেও উদাহরণস্বরূপ কিছু ঘটনার উল্লেখ করা যেতেই পারে। নব্বই দশকের শেষের দিকে ‘তথাকথিত নামকরণ’ বিরোধী আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়কে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এ আন্দোলনের  নানান ছকের  আড়ালে ছিল মতাদর্শ আর রাজনৈতিক সংঘর্ষ।  তারফলে পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কাজকে তা  প্রভাবিত করেছিল। এ ছাড়াও প্রশাসনিক নানা অসংগতির ফলে  শিক্ষকদের দাবীর প্রেক্ষিতে দীর্ঘ আন্দোলন, পরিণতিতে উপাচার্যের  পদত্যাগ,  পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত হবার ঘটনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন উপাচার্যের পদত্যাগ, ছাত্রী নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন, ছাত্রদের রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে উত্থিত সংঘর্ষের জেরে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবার ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বিঘ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। এ সব ঘটনায় প্রশাসন সব সময় ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে তা নয়। বরং  অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের প্ররোচনাতে বা সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থ মুষ্টিমেয় হলেও ছাত্রদেরকে প্ররোচিত করেছে শিক্ষকদের ন্যায্য আন্দোলনে বাধা দিতে এবং শিক্ষকদের শারীরিকভাবেও  হেনস্থা বা  অসম্মান করতে। এ গুলোর লজ্জা শিক্ষক হিসেবে আমাদেরকেই বহন করতে হয়েছে। আমরা শিক্ষকরাও এই প্ররোচনায় অংশীদার হইনি, এ দাবীও করতে পারিনা। তবে এটা ঠিক, বিশ্ববিদ্যলয়ের অধিকাংশ শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, এবং বিশেষ করে ছাত্ররা অনেক ক্ষেত্রেই সংকট মোকাবিলায় ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। আগেই বলেছি সকল উপাচার্যই সঠিক বা উপযুক্ত পদক্ষেপ বা ভূমিকা  নিয়েছেন তা  নয়। ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রকৃত মনোভাব উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সঠিক এবং পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পারেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে, একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে, অনেক সময় শিক্ষকদের  প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষকদের দাবীদাওয়া, ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যা, আন্দোলন ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। তাতে প্রশাসনের সঙ্গে মতদ্বৈতাতেও যেতে হয়েছে। শিক্ষকসহ সবাইকে  ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি।  অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছি, অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থও হয়েছি। এ সকল বিচারের ভার এখন ইতিহাসের হাতে ন্যস্ত হয়েছে। আজ জীবন সায়াহ্নে এসে একটি কথা মনে হয়, যাই হোক  শত প্রতিকূলতা স্বত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আমরা ছেড়ে যাইনি।  

সব শেষে একটা কথা বলতেই হয়, রাজনীতি যত সংকটই তৈরি করুক, নিরাজনীতিকরণ বা রাজনৈতিক চেতনা বিবর্জিত বুদ্ধিবৃত্তি  কখনই সমাজের কাজে লাগে না কারণ তা অন্যের দ্বারা চালিত হয়, অথবা অন্যের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সমাজ বিকাশের অপরিহার্য প্রক্রিয়া। কিন্তু এই রাজনীতি যখন কলুষতা দিয়ে আবৃত হয়, তা সমাজকে যেমন, শিক্ষাংগনকেও তেমনি কলুষিত করে।  বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক চেতনা ঐতিহাসিক ভাবে অর্জন করেছে, তাকে বাদ দিয়ে কোন প্রগতিশীলতা, অগ্রগতি বা উন্নয়ন স্থিতিশীল হতে পারে না এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। আর যারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষে বলে নিজেদের দাবী করেন, তাঁদের মধ্যকার অনৈক্য বা সংকীর্ণস্বার্থে তাকে বর্জন যে কি পরিণতি আনতে পারে তা আমরা পেশাগতজীবনে বহুবার উপলদ্ধি করেছি। জানিনা তা আমাদের কতটুকু অভিজ্ঞ করেছে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তিন দশক ধরে নিরন্তর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের লড়াই প্রত্যক্ষ করেছে।এর মধ্য দিয়েই এর শিক্ষাকার্যক্রম গতিশীল থেকেছে। অনেক কিছু অর্জিত হয়েছে  সন্দেহ নাই, অনেক কিছু অর্জন করতে বাকী আছে, এটাও ঠিক। তাই এগিয়ে যাবার এ চ্যালেঞ্জটাও নিতে হবে। এটা আজ সময়েরও দাবী। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে এর চাইতে বেশী আর কি চাওয়া থাকতে পারে?   


Sharing Helps!