জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা -কমরেড অমল সেনের পথনির্দেশক শিক্ষা

Sharing Helps!

১৭ জানুয়ারী, ২০২২  কমরেড অমল সেনের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতি বছরের মত এবারো এ দেশের প্রগতিশীল মানুষ শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করছেন তাঁর স্মৃতিসৌধে এই বৈশ্বিক মহামারি ও সংকটকালে।  

এই বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে আজ বিশ্বব্যাপী এই প্রশ্ন প্রায় সর্বত্র উচ্চারিত , জনগণের ক্ষমতায়ন কিভাবে হবে?  শ্রেণিবিভক্ত সমাজে, এমনকি উন্নত পুঁজিবাদী দেশের সমাজে গণতন্ত্র আজ প্রশ্নবিদ্ধ। নয়া উদারনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমর্থক অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিদরাও আজ বিকল্প ‘কাঠামোগত’ বা ‘structural’ পরিবর্তনের প্রস্তাবনা করছে। সংগত কারণেই আজ প্রশ্ন উঠছে এই বিকল্প কাঠামোগত  পরিবর্তন কি? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে যারা উচ্চারণ করেছিল, ইতিহাসের পরিসমাপ্তি হয়েছে, দু দশকের মধ্যেই তাঁরা নতুন করে ভাবনার কথা বলছে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর সমাজতান্ত্রিক সমাজের চিন্তকদের মধ্যেও স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠেছে জনগণের ক্ষমতায়নের বিষয়টি যে বিপ্লবে মুখ্য সেখানে এই বিচ্যুতির উৎস কি? কমরেড অমল  সেন  সোভিয়েত ইউনিয়নের নানা বিচ্যুতির  এবং দেশে দেশে কমিউনস্ট আন্দোলনের নানা বিচ্যুতির প্রেক্ষাপটে তাঁর  দীর্ঘ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের নির্যাস হিসেবে জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার তাত্বিক বিশ্লেষণ দিয়েছেন তার ‘জনগণের বিকল্প শক্তি’ বইতে। সেটা শুধু এদেশের কমিউনিস্টদের পথ নিদের্শক নয় ধ্রুপদী মার্কসবাদ ও রাস্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক চিন্তায় এই বইএর  ভূমিকা অনস্বীকার্য। শোষকশ্রেণীর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপরীতে জনগণের নিজস্ব  গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কিভাবে গড়ে উঠতে পারে তা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। আজ আমরা যখন বিভিন্ন রাষ্ট্রের  স্বৈরতান্ত্রিক  ব্যবস্থার মুখোমুখি তখন অমল সেনের জনগণের ‘বিকল্প শক্তির ধারণাকে ভিত্তি করেই এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক শক্তি গড়ে তোলার কাজ আমাদের এগিয়ে নিতে হবে । এই কাজ বিপ্লবের আগে বা পরে সব সময়ই প্রাসঙ্গিক।

 ২০২০ সাল  ভারতের  কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রতিষ্ঠার শতর্বষ পার করেছে।  আবার ২০২০ সাল থেকেই  বিশ্ব সভ্যতা অতিক্রম করছে কোভিড -১৯ নামের   ভাইরাস   সৃষ্ট এক   ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। এই বিপর্যয়ের মুখে মানুষ আবার করে দেখছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার  অন্তর্নিহিত দূর্বলতার এক মূর্তিমান চিত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত   পুঁজিবাদী বিশ্বের  সর্বাধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার মুখ ব্যাদান করা দুরবস্থা দেখছে গোটা বিশ্ব।  দেখছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত গণতন্ত্রের সংকট। পাশাপাশি স্বল্পোন্নত অথচ মানবিক মূল্যবোধের মৌলিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ সমাজতন্ত্রমুখী দেশ কিউবা, ভিয়েতনাম, চীনের এই বিপর্যয়রোধে সাফল্য নয় শুধু, বিপন্ন মানুষের পাশের দাঁড়ানোর সমাজতান্ত্রিক ভাবমানসের জলজ্যান্ত উদাহরণ। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কমরেড অমল সেনের শিক্ষা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। মানুষের সামনে আজ নতুন করে জিজ্ঞাসা দানা বাঁধছে – পুঁজিবাদ না তার বিকল্প কোন পথে মানব সভ্যতা টিকে থাকবে?

     আজ থেকে একশত আট   বছর আগে, ১৯১৪ সালের ১৯ জুলাই কমরেড অমল সেনের জন্ম যশোর জেলার আফরা গ্রামে এক জমিদার পরিবারে। তিনি জন্মেছিলেন মানব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে।  লেনিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে শ্রমিক শ্রেণী রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠা করে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই বিপ্লবের অভিঘাত, বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে তৈরী করে এক যুগান্তকারী চেতনা। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম নতুন গতিবেগ আর দিকনির্দেশনা পায়। তৎকালীন ভারতবর্ষে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের আবহে বেড়ে ওঠা কমরেড অমল সেনও অতি অল্প বয়সেই জড়িয়ে পড়েন বৃটিশবিরোধী সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে এদেশেও। তিনি দ্রুতই আকৃষ্ট হন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শের প্রতি। কঠিন সেই প্রেক্ষাপটে তরুণ এক যুবকের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া অত সহজ ছিল না। এ  ক্ষেত্রেও  তিনি ছিলেন বিশিষ্ট এবং ব্যতিক্রম। তিনি সামন্ত পরিবারের আবহ অগ্রাহ্য করে, জায়গা করে নেন নড়াইলের বাকড়ির গরীব কৃষকের কুঁড়েঘরে। গড়ে তোলেন যশোর নড়াইল অঞ্চলের ঐতিহাসিক তেভাগা কৃষক আন্দোলন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের আবহে  এই কৃষক সংগ্রাম এক নতুন মাত্রা যোগ করে। বৃটিশবিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে শ্রমজীবি তথা কৃষকসমাজের ভূমিকার ঐতিহাসিক অবস্থান নির্ধারিত হয়ে যায়। বাংলার এই ভূখন্ডে  বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই কৃষক আন্দোলনে কৃষকদের রয়েছে অনেক বীরোচিত ভূমিকা, কিন্তু তা সত্বেও কমরেড অমল সেনের  নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যশোর নড়াইল এলাকার এই আন্দোলন সাফল্য, চেতনা আর সংগঠনের দিক দিয়ে এক অনন্য অবদান রেখেছিল, যার ধারাবাহিকতায় শুধু ঐ অঞ্চলে নয়, গোটা বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে গড়ে ওঠে বিপ্লবী সংগ্রাম আর সংগঠনের দৃঢ় ভিত্তি। পাশাপাশি এই আন্দোলনের দোলাচলে যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে পড়ে থাকা মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর চেতনার এক নব দিগন্ত। কমরেড অমল সেনের লেখা ’নড়াইলের তে-ভাগা আন্দোলনের সমীক্ষা’ বইটিতে তিনি তাঁর অভূতপূর্ব বিশ্লেষণী দক্ষতায় তা ভবিষ্যতের বিপ্লবীদের পথনির্দেশিকা হিসেবে রেখে গেছেন। বইটি পাঠ্য তাই প্রতিটি বিপ্লবী কর্মীর, সঙ্গে সঙ্গে সকল রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের।  এ ক্ষেত্রে  তিনি শুধু আমাদের পার্টির পথিকৃত নন, এ দেশের সকল প্রগতিশীল, সমাজসচেতন মানুষের পথিকৃত। তিনি তাঁর জীবন সংরামের মধ্য দিয়েই জনগণের বিকল্প শক্তির ধারণাকে মূর্ত করতে পেরেছিলেন। তাই আজও তা বিপ্লবী শক্তি বিকাশে অনন্য পাথেয়।   

     নড়াইলের তেভাগা আন্দোলন স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসে। এ আন্দোলনের রয়েছে সমষ্ঠিগত সাফল্য, পাশাপাশি  কি ত্যাগ তিতিক্ষা  করতে হয়েছিল এ এলাকার জনগণের সেটাও ইতিহাসের অংশ। কত পরিবার ধ্বংস  হয়েছে, কত জেল জুলুম আর নিপীড়ণ সহ্য করতে হয়েছে, তা কি সময়ের সাথে সাথে ভুলে যাবে ভবিষ্যত প্রজন্ম? কমরেড অমল সেনের বৈশিষ্ট ছিল, তিনি সংগ্রামে ছিলেন সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা নেতা, যখন নির্যাতন, নিপীড়ন নেমে এসেছে, তখনও তিনি সামনে দাঁড়িয়েই তা সহ্য করেছেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তি যা করতে পারেনি, তথাকথিত স্বাধীনতা  লাভের পর, পাকিস্তান আমলে, বিপ্লবী সংগ্রামীদের জীবনে নেমে আসে সেই নির্যাতন। পাকিস্তান আমলে ১৯ বছরই তাঁকে কাটাতে হয়েছে জেলে। শুধু তাই নয়, জেলের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী হায়েনাদের  হাতে তাঁকে সীমাহীন ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, যা নাৎসী ’কনসেনট্রেসন’ ক্যাম্পের কথা মনে করিয়ে দেয়, এ ইতিহাস অনেকেরই জানা নেই। তিনি শত নিপীড়ন আর নির্যাতনে দেশত্যাগ করেননি, বিপ্লবীজীবন ত্যাগ করেননি।

       ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিটি বাঁকে তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। দেশবিভাগের প্রাক্কালে তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গৃহীত রনদিভে লাইনের বাম বিচ্যুতি পার্টিকে যে জনগণ  থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, তা তিনি তাঁর কৃষক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক চেতনা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন  এবং তার বিরোধীতা করেছিলেন। ষাটের দশকে যখন বিশ্বব্যাপী চীন-সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতাদর্শগত বিতর্ক, দেশেদেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে দ্বন্দ এবং ভাঙনের মুখোমুখি করে, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিও সে বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পারেনি। তার ফলশ্রুতিতে, পার্টির ভাঙন আর তার ফলাফল এখন ইতিহাস। তিনি গোটা বিষয়টিকে তাত্বিকভাবে যেভাবে মোকাবিলা করেছেন তার দু’টি ঐতিহাসিক দলিলে তা তিনি লিখেছেন।  একটি ‘বিশ্ব   সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্যা প্রসঙ্গে’ অন্যটি ‘কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শগত বিতর্ক প্রসঙ্গে’। মতাদর্শগত যে কোন বিতর্কের পরিসমাপ্তি হলো পার্টির ভাঙন। সাংগঠনিকভাবে তিনি সারাজীবন এর বিরোধীতা করেছেন।  পার্টির বহুধা বিভক্তিতে তিনি যন্ত্রনাবিদ্ধ হয়েছেন কিন্তু হতাশ হননি।  ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে সামনে নিয়ে তিনি যেমন রাজনৈতিকভাবে অবস্থান নিয়েছেন, তেমনি তৎকালীন পূর্ববাংলার কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রামে অবতীর্ন  হয়েছেন আজীবন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ  বিরোধী লড়াইএ যেমন সেই তরুণ  বয়সে জীবনবাজি রেখেছিলেন, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সংগঠক হিসেবে, নেতা হিসেবে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কমিঊনিস্ট বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করার  যে কাজ তিনি শুরু করেছিলেন, তা তিনি আমৃত্যু অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি সত্তর, আশি এবং নব্বই এর দশকের সকল রাজনৈতিক সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা কি হওয়া উচিত, তা যেমন নির্দেশ করেছেন,নেতৃত্ব দিয়েছেন,  তেমনি কমিউনিস্টদের ঐক্যের প্রতিভু হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছেন।

   তিনি বারবার উচ্চারণ করেছেন কমিউনিস্ট পার্টি শ্রেণী সংগ্রামের পার্টি। শ্রেণীসংগ্রাম ছাড়া শ্রমজীবি  মানুষের নেতা হয়ে ওঠার অন্য কোনো বিকল্প রাস্তা নেই। তেমনি তিনি এটাও বলেছেন কোন যান্ত্রিক শ্রেণীসংগ্রামের ধারণা নয়, যে শ্রেণিসংগ্রাম জনগণকে তাঁর বিকল্প শক্তিতে শক্তিমান করতে না পারে তা  আসলে মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে শ্রেণী সংগ্রাম নয়। তাই তিনি বহুবার বলেছেন,  কোন দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের আঁকেবাঁকে পার্টিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে হয়, প্রয়োজনও বটে, কিন্তু সে সকল রাজনৈতিক সংগ্রামে শ্রমজীবি মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে, শ্রমজীবি মানুষের শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য দিয়ে, তার নিজস্ব  বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতেই হয়। সাম্রাজ্যবাদের নয়া-উদারীকরণ নীতি শুধু বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আর সামরিক বিপর্যয় এর কারণ হয়নি, ভোগবাদ আর ব্যক্তিসর্বস্ব স্বার্থান্ধতার সাংস্কৃতিক আবহে সমাজজীবন আর নৈতিকতাকে ঠেলে দিয়েছে এক অন্ধকার আবহে। তরুণ যুব সমাজও নিমজ্জিত হচ্ছে এক অন্ধকার হতাশাচ্ছন্ন দিক নিশাহীন আবর্তে।  বর্তমান সমাজব্যবস্থার এই সার্বিক অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে তাঁর লেখা ‘কমিউনিস্ট জীবন ও আচরণ রীতি প্রসঙ্গে’  বইটি শুধু কমিউনিস্টদের নয়, সার্বিকভাবে ব্যক্তি ও সমাজ কল্যাণের  আদর্শিকক্ষেত্রে এক   দিক নির্দেশক দর্শনের ভূমিকা পালন করতে পারে।  

ইতিহাস তার গতিপথে কিছু মানুষ সৃষ্টি করে, আবার কিছু মানুষ তাঁদের জীবন দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তাঁরা কিংবদন্তি। কমরেড অমল সেন তেমনি একজন মানুষ, যাঁরা বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে, পথভ্রষ্টদের পথ দেখান। তিনি বিপ্লবী জীবনাদর্শ ও মনুষত্বের প্রতীক।

প্রায়শই এ কথাটি উচ্চারিত হয় যে, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক যে, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জের নির্দিষ্ট রূপ কি? উত্তর খুবই ব্যাপক এবং সঠিক অর্থে বলতে গেলে এর অনেক কিছুই এখনো মানুষের অজানা। আর এ নিয়ে দ্বিমত বা বহুমত থাকাই স্বাভাবিক। তবুও সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই চ্যালেঞ্জের কয়েকটি দিকের আশু রূপ নির্দিষ্ট করা সম্ভব। এই চ্যালেঞ্জ রয়েছে-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশে, রয়েছে অর্থনৈতিক-সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে, রয়েছে বিশ্বজাগতিক ক্ষেত্রে মানুষের নতুন কোথায়ও পদার্পনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে। ভৌতবিজ্ঞান আজ উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহন করেছে বলা যায়। তবুও সেক্ষেত্রেও রয়েছে বড় বড় চ্যালেঞ্জ। পদার্থবিজ্ঞানে মহাজাগতিক ও মৌল বলসমূহের একীভূতকরণ, রসায়ন, প্রাণ-রসায়ন, জিনপ্রযুক্তির বহু অজানা প্রশ্ন, কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তির বাস্তবায়ন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্যান্সার বা এইড্স এবং এই মুহূর্তের করোণার মত ভাইরাস সৃষ্ট  ঘাতক ব্যাধির মোকাবিলা সবই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আরও বড়। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত কাঠামোগত সমস্যা আজ আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। অর্থনীতির বৈশ্বীকরণ-অতি  কেন্দ্রীকরণ ও বৈষম্য সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে।  ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগত উল্লম্ফন একদিকে যেমন উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধির দ্বার উন্মোচন করছে, তেমনি তা বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে শ্রমজীবি মানুষের বেকারত্বের হাতছানি দিচ্ছে। এই সংকটের সমাধানের রাস্তা কি? অমল সেন শিখিয়েছেন  এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য মার্ক্সের মতাদর্শ, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনার সৃজনশীল প্রয়োগ প্রয়োজন। আর তাই আমাদের মত দেশের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায় মার্ক্সবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ  ছাত্র হিসেবে কমরেড অমল সেন তাঁর যে প্রয়োগলব্ধ জ্ঞান আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন, তা আমাদের নতুন প্রজন্মকে আত্মস্থ করতে হবে, প্রয়োগে নিতে হবে, অনুশীলনে নিতে হবে। সৃষ্টিশীল এই প্রয়াসই অমল সেনের কাছ থেকে বড় শিক্ষা।  এই সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী পথই একমাত্র পথ।  ইতিহাসের জটিল পথপরিক্রমায় আমরা আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে সামনে এগুনোই  আমাদের একমাত্র রাস্তা। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সংকট, বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের লগ্নীপুঁজির আগ্রাসন, নয়া-উদারনীতিবাদের শোষণ, বিশ্বায়ন, গোটা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে চরম সাম্প্রদায়িক  শক্তির উত্থান, শ্রমজীবি ও গণতান্ত্রিক শক্তির বিভক্তি ও বিভ্রান্তি,  কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল শক্তির বিভাজন ও হতাশা – এ সব সংকটকে মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কমরেড অমল সেন তার জীবদ্দশায় এর প্রতিটি সংগ্রামে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাত্বিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তার মৃত্যুর পর আমরা নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সামনে চলছি। তার রেখে যাওয়া তাত্বিক লেখা  জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক    অমূল্য  শিক্ষা।  তার দেখানো পথকে সামনে রেখে ইতিহাসের এই দায়কে কাঁধে নিতে হবে এই প্রজন্মকেই।  

১৪ জানুয়ারী, ২০২২

ঢাকা।


Sharing Helps!