আফগানিস্তানের পট-পরিবর্তন ও কয়েকটি রাজনৈতিক প্রশ্ন
আফগানিস্তানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন অর্থাৎ আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও তার মিত্র ন্যাটো বাহিনীর সৈন্য প্রত্যাহার ও তালেবানদের প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত গতিতে ক্ষমতাদখল, দৃশ্যতঃই কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে তাহলো,
(এক) আফগানিস্তান থেকে সৈন্য অপসারণ কি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পশ্চাদপসরণ না কি নতুন কৌশল? এর ফলে এই অঞ্চলে মার্কিন ও তার মিত্রদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত কিভাবে নির্ধারিত হবে?
(দুই) এই পট-পরিবর্তন রাশিয়াসহ আফগানিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত সংশ্লিষ্ট চীন ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ভূ- রাজনীতির উপর এর প্রভাব কি?
(তিন) যেহেতু তালেবানরা চরম দক্ষিণ পন্থী ধর্মীয় মতাদর্শের অনুসারি, সেহেতু তাদের এই দৃশ্যমান বিজয় দক্ষিণ এশিয়া সহ আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে কোন গভীর প্রভাব ফেলবে কি না, ফেললেও তা কতটুকু?
সকল প্রশ্নের উত্তর এই মুহূর্তে পাওয়া সহজ নয়, কারণ এর বহু বিষয় নির্ভর করবে পরবর্তী বহুমাত্রিক ঘটনাবলীর উপর।
এটা মনে রাখা জরুরি, বাইরের কোন রাজনৈতিক অভিঘাত অন্য কোন দেশের উপর কতটুকু এবং কেমন প্রভাব ফেলবে তা বহুলাংশে নির্ভর করে সে দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা কি তার উপর। তবুও অনেক সময় পরোক্ষ প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই প্রবন্ধে দ্বিতীয় প্রশ্নটিতে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে।
চীন, রাশিয়া, ইরান ও অন্যান্য মধ্য এশিয় দেশগুলির উপর এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াঃ
আফগানিস্তানের সঙ্গে রাশিয়ার এই মুহূর্তে কোন সীমান্ত নেই। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভূক্ত এই সব দেশগুলিই এখন স্বাধীন দেশ হিসেবে রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ঐতিহাসিক কাল ধরেই আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে রাশিয়া সম্পৃক্ত। গত শতাব্দির ৭০ ও আশির দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সংশ্লিষ্টতা ও ব্যর্থতা শুধু আঞ্চলিক ক্ষেত্রে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এমনকি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আভ্যন্তরীণ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাশিয়ার এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতার আলোকেই রাশিয়া বর্তমান পরিস্থিতিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং নিবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
আর একটি বিষয় স্পষ্টতঃই দৃশ্যমান, তাহলো বৈশ্বিক মেরুকরণের বাস্তবতা। ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর এটা প্রায় স্বীকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দীর্ধকালীনভাবে একমেরু বিশ্বে পরিণত হলো। কিন্তু, একবিংশ শতাব্দির শুরুতেই পুঁজিবাদের বৈশ্বিক সংকট শুরু হয়। ২০০৮ সালে তা মহামন্দায় রূপ নেয়। সমান্তরালভাবে চীন উঠে আসে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে। রাশিয়াও কিছূটা ঘুরে দাঁড়ায়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য হলো, যে চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ ‘ঠান্ডা যুদ্ধে’র গোটা সময়কাল পশ্চিমা বিশ্বকে ঠান্ডা যুদ্ধে জিততে সহায়তা করেছে, কিছুটা আশ্চর্যজনকভাবে সোভিয়েত বিলুপ্তির পর রাশিয়া আর চীনের নতুন অক্ষশক্তি গড়ে ওঠার বাস্তবতা তৈরি হয়।যদিও অনেক ক্ষতির শেষে গত শতাব্দির আশির দশকের শেষ থেকেই চীন-সোভিয়েত বরফ গলার ইংগিত মেলে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা হারানোর প্রেক্ষাপটে দৃশ্যটারই বদল হয়ে যায়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিপরীতে ধীরে ধীরে হলেও গড়ে ওঠে জোট বা সমঝোতা, যা বিশ্বকে দ্বিমেরু বা বহুমেরুতে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। আজ সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিশেষ করে করোনা অতিমারিকালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দৃশ্যতঃই তার বিপরীত মেরুর কেন্দ্র চীনকে ঘেরাওএর নীতি গ্রহণ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি হয় এই পরিকল্পনার পূর্ব পদক্ষেপ অথবা এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হওয়ার বাস্তবতা তৈরি করলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলি তেমনিই ইংগিত করছে।
আফগানিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত রয়েছে পাকিস্তান (২,৬৭০ কিমি), ইরান ( ৯২১ কি মি ), তুর্কমেনিস্তান (৮০৪ কি মি) , তাজিকিস্তান ( ১,৩৫৭ কি মি ), উজবেকিস্তান ( ১৪৪ কি মি ) ও চীনের ( ৯১ কি মি) । ১৫ আগস্ট তালেবানদের কাবুল দখলের আগে থেকেই আইনী বেআইনী পথে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে প্রবেশ করেছে এবং করছে। চীনের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্ত খুবই সরু (৭৯ কিলোমিটারের মত ), কিন্তু বাকী সবগুলির সংগেই রয়েছে বিস্তৃত সীমান্ত। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জাতিগোষ্ঠি, সংস্কৃতিরও রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহাসিক পরম্পরা। ফলে আফগানিস্তানের কোন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আশু ও সুদূরপ্রসারি প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর উপর পড়বে সন্দেহ নেই।
ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দের প্রেক্ষাপটেই আফগানিস্তানের এই পরিবর্তন ইরানের উপর এক বিশেষ প্রভাব তৈরি করবে। ইরান আফগানিস্তানে মার্কিন কোন আধিপত্য বা প্রভাব ভালোভাবে নেবে না। তালেবানদের সংগেও ইরানের গভীর সুসম্পর্ক নেই। তবুও মার্কিন ও ন্যাটোর সৈন্য অপসারণ ইরানের জন্য স্বস্তিকর হতে পারে। সেক্ষেত্রে তালেবানের সঙ্গে ইরানও শর্তসাপেক্ষে সম্পর্কের কথা ভাবতে পারে। ইতিমধ্যে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে মিলিতভাবে ইরান তাঁর অবস্থান নির্ধারণ করতে চাইছে।
তুর্কমেনিস্তান সীমান্তে ইতিমধ্যে তালেবানদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। তুর্কমেনিস্তানের সমৃদ্ধ গ্যাস ফিল্ডের সঙ্গে একটি প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপ আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে। ফলে তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সরাসরি অর্থনৈতিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। প্রাসঙ্গিক ভাবে উল্লেখ করা যায় তুর্কমেনিস্তানের গ্যাস রফতানির ৭০ শতাংশই যায় চীনে। তাই চীনের সংগে এই গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্কও গুরত্বপূর্ণ। এ ছাড়া আফগান ও তুর্কমেনদের রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। ধর্মীয়ভাবে উভয়ের মধ্যে নৈকট্য থাকলেও তুর্কমেনিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তালেবানদের থেকে আলাদা, ফলে দ্বন্দ বা সংঘাতের বাস্তবতা রয়েই গেছে।
তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ইতিমধ্যেই তাদের সীমান্তে বিশাল সেনাবাহিনী সমাবেশ করেছে। আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতায় আরোহণের ঘটনা এই দেশগুলোর মধ্যে একধরণের অস্বস্তি তৈরি করেছে সন্দেহ নেই। এই দেশগুলোর সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সংশ্লিষ্টতার প্রেক্ষাপটেই রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, চীনের সঙ্গে তাদের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রভৃতি আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক দ্বারাও প্রভাবিত হবে। এ ছাড়া সোভিয়েত পরবর্তীকালে এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ও অবস্থানও বিবেচনার বিষয়।
ঐতিহাসিকভাবেই পাকিস্তানের সঙ্গে আফগান সংকট এবং পরিবর্তনের সম্পর্ক দীর্ঘকালীন। সবচাইতে বড় সীমান্ত শুধু নয়, ঐতিহাসিকভাবে আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের রয়েছে বহুমাত্রিক সম্পর্ক। গত শতাব্দির আশির দশকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মোজাহিদিনদের প্রধান পশ্চাদ্ভূমি ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের সরাসরি সহায়তার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব তৎকালীন আফগান সরকার ও তাঁর সহায়তাকারী সোভিয়েত সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যহত রাখে। মোজাহিদিনদের অস্ত্র, অর্থ ও লোকবলের প্রত্যক্ষ সহায়তা হয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সহায়তায়। এরপর মোজাহিদিনরা ক্ষমতায় আসার পর তালেবানের জন্মও হয় পাকিস্তান সীমান্তে ও অভ্যন্তরে। প্রথম বার তালেবানের ক্ষমতায় যাবার পিছনে পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী, সেনা ও গোয়েন্দাবাহিনীর হাত ছিল বলতে গেলে প্রত্যক্ষ। এর পর ৯/১১ এর ঘটনার অভিঘাতে ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর সরাসরি আঘাতের মধ্য দিয়ে যখন তালেবানদের পতন হয়, তখনও পাকিস্তানের সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীসহ রাজনৈতিক শক্তির তালেবানদের সঙ্গে ছিল গভীর সম্পর্ক। এই প্রশ্নে আমেরিকা ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐক্য –অনৈক্যের সম্পর্ক ছিল। মার্কিন সৈন্য অপসারণের পর তাই স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সরকারই তালেবানদের সবচাইতে নিকট বন্ধুত্বের অবস্থানে রয়েছে। তবে এটা মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানদের নিরংকুশ বন্ধুত্ব নেই। তাদের রয়েছে দীর্ঘকালীন দ্বন্দ, জাতিগত বিরোধ, উপজাতি গোষ্ঠী, দল উপদল্ভিত্তিক সংঘাত। ফলে আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখল পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের ঐক্য –অনৈক্যের বহুমাত্রিকতা থাকবে। সব চাইতে বড় কথা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতেও প্রত্যক্ষ প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না।
চীনের সংগে পাকিস্তানের বর্তমান সম্পর্কও অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবক হতে পারে।
এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পূনর্মূল্যানের প্রশ্ন খোদ মার্কিন কংগ্রেসেও উঠেছে। সেটাও বিবেচনার আর একটি দিক।
চীনের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্ত সব চাইতে ছোট, কিন্তু, আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনৈতিক নিরিখে আফগান সংকট বা পরিবর্তনে চীনের প্রতিক্রিয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চীনের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণে এমনকি আভ্যন্তরীণ নীতিকেও তা প্রভাবিত করতে পারে।
তালেবানদের ব্যাপারে চীনের মনোভাব নিয়ে বিস্তর বিচার বিশ্লেষণ রয়েছে। রয়েছে পশ্চিমা মিডিয়ার সুকৌশল প্রচারণা। গত প্রায় চার দশক ধরে এই অঞ্চলে চীনের গৃহীত নীতিগুলির ঐতিহাসিক ‘লিগেসি’ কেও বিবেচনায় রাখতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে তালেবানদের ক্ষমতা দখল প্রশ্নে স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে চীন কোন একমুখী বা চটজলদি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। তালেবানদের পক্ষ থেকে চীনকে তাদের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলে পত্র প্ত্রিকায় বলা হচ্ছে। তবে চীন এ বিষয়ে যে ধীরে এবং পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিচ্ছে তার ইংগিত পরিষ্কার। প্রথমতঃ মার্কিন ন্যাটো সৈন্য অকস্মাৎ প্রত্যাহারের ঘোষণায় চীন এ অঞ্চলে জংগী কার্যক্রম বাড়তে পারে বলে আশংকা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু মার্কিন-ন্যাটো সৈন্যের আফগানিস্তানে উপস্থিতি যে স্বস্তিদায়ক ছিল না এটা স্পষ্ট ছিল চীনের কাছে । ফলে, এই প্রশ্নে চীন রাশিয়া এবং ইরানের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে অগ্রসর হবার নীতি গ্রহণ করছে বলেই মনে হয়। গত ১৫ ই আগস্ট তালেবানরা কাবুল দখলের পরই দ্রুত এই পট পরিবর্তনের দায় এবং বিগত বিশ বছর আফগান জনগণের উপর গণবিরোধী গৃহযুদ্ধ চাপিয়ে দেবার জন্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দায়ী তা চীন স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করে এবং আফগান জনগণই আফগানিস্তানের ভাগ্য নির্ধারক এই বক্তব্য রাখে। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে বা তার বাইরে যে কোন জংগী তৎপরতা বা সহায়তা না দেবার জন্য প্রথম থেকেই চীন সতর্ক করে দেয়। চীন স্পষ্টতঃই চীনের অভ্যন্তরে বা আঞ্চলিকভাবে কোন ধরণের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তালেবানদের অবস্থান সুস্পষ্ট রাখার জন্য চাপ অব্যহত রাখছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আফগানিস্তান প্রশ্নে গৃহীত সর্বশেষ প্রস্তাবে চীন ও রাশিয়া বিরোধীতা করে এবং ভোটদানে বিরত থাকে। চীন মনে করে, এই প্রস্তাব মার্কিন ও তার মিত্রদের চাপে তড়িঘড়ি করে নেওয়া হচ্ছে। আবার অন্যদিকে, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য অপসারণের পাশপাশি, যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর তার কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখছে তাও স্পষ্ট। অতি সম্প্রতি ভিয়েতনামসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসের কূটনৈতিক সফর এই ইংগিতই দেয়। ফলে আফগানিস্তানের তালেবান প্রশ্নে দু’টি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে চীনের সামনে আসবে। (এক) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের আফগানিস্তানে ব্যর্থতার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ফলাফল কিছুটা হলেও চীনকে স্বস্তি দিতে পারে। (দুই) কিন্তু,পাশাপাশি চীনের অভ্যন্তরে এবং আঞ্চলিক ক্ষেত্রে যে কোন ধরণের জংগী সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে চীন আগের চেয়ে অনেক সতর্ক থাকবে। তাই যে কোন ধরণের ইসলামিক জংগীবাদকে যদি তালেবানরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা দেয় চীন তা সহ্য নাও করতে পারে। শেষতঃ আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় আসায় চীনের নিকটতম প্রতিদ্বন্দি ভারত যে আর্থিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে অনিশ্চয়তা মধ্যে আছে –চীন এ বিষয়েও সতর্ক থাকছে সন্দেহ নেই, তবে এক্ষেত্রেও তাকে বহুমাত্রিক ভাবে দেখার ইংগিতই মেলে। ঘটনার আরো অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নগুলোর উত্তর আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তবে আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত সম্পর্ক এ অঞ্চলে তার অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার কৌশলগত অবস্থানের ভিত্তিতেই নিরূপিত হবে এবং তা এই অঞ্চলে চীনসহ সকল শক্তির সঙ্গে তালেবানদের সম্পর্ক ও প্রভাবিত হবে।
তবে এই প্রশ্নে স্পষ্ট থাকতে হবে, তালেবানের জন্ম মতাদর্শগতভাবে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শকে বিরোধীতা করার মধ্য দিয়েই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার পশ্চিমা মিত্রদের বিরোধীতার মধ্য দিয়ে নয়। পশ্চিমা পুঁজিবাদের সঙ্গে তাদের আদর্শগত বিরোধ মৌলিক নয়। ফলে মার্কিন ও তার মিত্রদের সঙ্গে অন্তর্লীন বোঝাপড়া নেই তা মনে করা বোকামি। চীনও এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখবে নিশ্চিতভাবেই ও একই ভাবে তা জরুরিও । যতই জাতীয় বা আঞ্চলিক স্বার্থ থাক তালেবান ও তাদের মিত্র শক্তির কাছে চীনের সমাজতন্ত্রমুখী অর্থনৈতিক বিকাশ এবং সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। চীনের পার্টি ও জনগনের কাছেও এ বিষয়টি যতটা পরিষ্কার থাকবে আফগান প্রশ্নে চীনের ভূমিকাও ততটাই কার্যকর হবে। এ ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক উভয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও এ ব্যাপারে চীনের এই কার্যকর ভূমিকা আগের চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও প্রত্যাশিতও বটে।
সবশেষে এটা বলা যায়, আফগানিস্তানে এই নতুন রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন সার্বিকভাবে এই অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মতাদর্শিক ক্ষেত্রে এক বহুমাত্রিক লড়াই ও গুণগত পূনর্বিন্যাসের বাস্তবতা তৈরি করেছে।